চালকবিহীন গাড়ি

কালবেলা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হলেন। দাঁড়ালেন মূল ফটকে। গ্যারেজ থেকে আপনার গাড়ি বেরিয়ে ফটকের সামনে এসে থামল। আপনি গাড়িতে উঠলেন, গাড়ি চলল অফিসের উদ্দেশে। রাস্তায় গাড়িতে বসে আপনি ল্যাপটপ খুলে অফিসের কিছু কাজও সেরে নিলেন। আধা ঘণ্টা পর এসে গাড়ি থামল অফিসের সামনে, আপনি নেমে গেলেন আর গাড়ি তার নির্দিষ্ট পার্কিং স্পটে চলে গেল। ভাবছেন, এ আর নতুন কী! গাড়ির চালক আছে, আপনি চালককে নির্দেশ দিচ্ছেন কখন কোথায় আসতে হবে, কোথায় যেতে হবে—আর চালক সেইমতো গাড়ি চালাচ্ছে। এখন ধরুন, গাড়িটি চালকবিহীন, চলছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বাসার সামনে থেকে আপনাকে তুলে নিয়ে চলেছে ব্যস্ত সড়ক দিয়ে, ট্রাফিক লাইট লাল হওয়ার পর নিজে নিজেই থেমে যাচ্ছে, রাস্তায় ডানে-বাঁয়ে মোড় নেওয়ার সময় পথচারীদের দেখে গতি কমিয়ে দিচ্ছে, আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে নিজে নিজেই গাড়িটি তার নির্দিষ্ট পার্কিং স্পটে গিয়ে থামছে। এখন মনে হচ্ছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, তাই না?

মোটেই নয়, প্রযুক্তির কল্যাণে এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে খুব শিগগিরই। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় এখনই পরীক্ষামূলকভাবে চলছে টেসলা, গুগল, উবারের চালকবিহীন গাড়ি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ রকম স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হওয়া শুরু হবে; ১৫-২০ বছরের মধ্যে আশা করা যাচ্ছে সারা বিশ্বের সব ব্যস্ত রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে।

গত চার-পাঁচ বছরে গাড়িতে বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় ফিচার যোগ হয়েছে। সেগুলো নিরাপদে গাড়ি চালাতে চালককে সাহায্য করে। যেমন ধরুন, অ্যাডাপ্টিভ ক্রুজ কন্ট্রোল (Adaptive cruise control)—ক্রুজ কন্ট্রোল প্রযুক্তি গাড়িকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা নির্দিষ্ট গতিতে চালাতে সাহায্য করে, যা গাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে দুই দশকের ওপর। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অ্যাডাপ্টিভ প্রযুক্তি। এর সাহায্যে রাস্তায় অন্য গাড়ির গতির সঙ্গে মিল রেখে গাড়ির গতি কমানো-বাড়ানো যায়। আরও আছে ব্লাইন্ড-স্পট ওয়ার্নিং, অটোমেটিক ইমার্জেন্সি ব্রেকিং, লেন-কিপিং অ্যাসিস্ট, সেলফ-পার্কিং ইত্যাদি বিভিন্ন নিরাপত্তাজনিত ফিচার যা চালকের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এসব স্বয়ংক্রিয় ফিচার সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন রকমের সেন্সর প্রযুক্তির কারণে। গাড়ি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য প্রয়োজন এ রকম আরও অনেক সেন্সর, যার মাধ্যমে গাড়ি চলার সময় চারপাশের একটি সম্পূর্ণ ভিজ্যুয়াল ম্যাপ তৈরি করা যায়। এর ওপর ভিত্তি করে তাত্ক্ষণিকভাবে গাড়ির গতি, দিক ইত্যাদি প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

গাড়িকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলার জন্য যেসব সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্যামেরা, রেডার (radar) এবং লিডার (lidar)। ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা ইমেজ ব্যবহার করে গাড়ির পারিপার্শ্বিক অবস্থা-যেমন রাস্তার লেনের দাগ কোথায় আছে, গাড়ির সামনে বা পেছনে কোনো গাড়ি, পথচারী বা অন্য কোনো বস্তু আছে কি না, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে গাড়ির চারপাশের সম্পূর্ণ দৃশ্যসীমা নির্ধারণ করতে হলে প্রয়োজন সারি সারি অনেকগুলো ক্যামেরা। ক্যামেরায় ধারণ করা ইমেজ সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য জটিল কম্পিউটেশন অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। লাখ লাখ পিক্সেলের ইমেজের ওপর এই জটিল কম্পিউটেশন করার জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি কম্পিউটিং ক্ষমতা। তবে ক্যামেরা অনেক মূল্যসাশ্রয়ী, তাই স্বয়ংক্রিয় গাড়ির সেন্সর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটি এখন পর্যন্ত অপরিহার্য।

রেডার (Radio detection and ranging) রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে গাড়ির আশেপাশের বস্তুর আপেক্ষিক অবস্থান এবং গতি নির্ধারণ করে। ক্যামেরা থেকে রেডার অনেক বেশি কম্পিউটেশন সাশ্রয়ী। তা ছাড়া রেডার যেকোনো ধরনের প্রতিকূল অবস্থায়, যেমন ধরুন মুষলধারায় বৃষ্টির মধ্যেও, সামনে বা পেছনে থাকা বস্তু শনাক্ত করতে পারে। তবে রেডার পুরোপুরি নিখুঁতভাবে বস্তুর কৌণিক পরিমাপ নির্ধারণ করতে পারে না, তাই গাড়ির চারপাশের ভিজ্যুয়াল ম্যাপ পুরোপুরি নির্ভুল নাও হতে পারে। রেডার সেন্সর হিসেবে সুপ্রমাণিত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন অনেক বেশি কার্যকর, পাওয়ার সাশ্রয়ী এবং ছোট আকারের রেডার-ভিত্তিক সেন্সর বানানো সম্ভব, তাই স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ক্ষেত্রে রেডারের ব্যবহারও অপরিহার্য। ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা টেসলা তাদের গাড়িতে যোগ করেছে অটো-পাইলট ফিচার, যেটি ক্যামেরা এবং রেডারভিত্তিক সেন্সর ব্যবহার করে গাড়িকে সীমিত সময়ের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাতে পারে।

গাড়ি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য লিডার (Light detection and ranging) প্রযুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিডার অনেকটা রেডারের মতোই কাজ করে। তবে রেডিও তরঙ্গের পরিবর্তে লেজার ব্যবহার করে ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে থাকা যেকোনো বস্তুর অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারে, যার মাধ্যমে গাড়ির পারিপার্শ্বিকের একটি সমপূর্ণ ত্রিমাত্রিক (3D) ম্যাপ তৈরি করা যায়। এই ম্যাপের ওপর নির্ভর করে গাড়ি তার গতি, অবস্থান ইত্যাদি তাত্ক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। লিডারে থাকে একাধিক চ্যানেল, প্রতিটি চ্যানেলে থাকে দুটি করে লেজার বিম—যত বেশি লেজার বিম থাকবে, লিডারের ধারণকৃত ত্রিমাত্রিক ইমেজ তত বেশি নিখুঁত হবে। লিডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এর দাম। একটি লিডার ইউনিটের দাম সবচেয়ে কম চ্যানেলের (১৬-চ্যানেল) ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে ৬৪-চ্যানেলের একটি ইউনিট কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গুগলের চালকবিহীন গাড়ি (বর্তমানে যেটি ওয়েমো নামে পরিচিত) এবং উবারের চালকবিহীন গাড়িতে লিডার ব্যবহূত হচ্ছে। তবে যত দিন পর্যন্ত এটি মূল্যসাশ্রয়ী না হবে, স্বয়ংক্রিয় গাড়ির গণ-উত্পাদনের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত থাকবে। বর্তমানে তাই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মূল্যসাশ্রয়ী লিডার বানানোর কাজ জোরেশোরে এগিয়ে চলছে।

চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি পুরোপুরি নিরাপদে চলার জন্য প্রয়োজন অব্যর্থ সেন্সর প্রযুক্তি, যাতে গাড়ির চলার পথের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের একটি সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। তাই স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে সেন্সর প্রযুক্তি হিসেবে ক্যামেরা, রেডার ও লিডার এ তিন প্রযুক্তিই একসঙ্গে হবে। এরা একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। ওয়েমোর চালকবিহীন গাড়ি আজ পর্যন্ত ৩০ লাখ মাইলের বেশি রাস্তা পাড়ি দিয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে প্যাসেঞ্জার নিয়ে দৈনন্দিন কাজে তাদের গাড়ি এখনই চলছে শহরের রাস্তায়। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যখন আপনাকে কাজে নেওয়ার জন্য সে রকম একটি গাড়ি আপনার বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হবে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন মুখ্য হার্ডওয়্যার প্রকৌশলী, ওরাকল করপোরেশন, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত