জামাল স্যারকে যেমন দেখেছি

আজ বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের ৮১ তম জন্মবার্ষিকী। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই দ্য আল্টিমেট ফেট অব ইউনিভার্স  বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন কপি। অনূদিত হয়েছে ১০টিরও বেশি ভাষায়। ১৯৩৯ সালে আজকের দিনে ঝিনাইদহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন গবেষক হিসেবে কাজ করছেন কেমব্রিজ, প্রিন্সটন, ক্যালটেকসহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আটটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন। 

আমি জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের সরাসরি ছাত্র নই, তবে তাঁর সান্নিধ্য ও স্নেহ পেয়েছি বলে আমার ভেতরে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। তাঁর নাম প্রথম শুনি অগ্রজপ্রতিম (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক শিক্ষক) ড. শাহীন ইসলামের কাছে। তখন আমি সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া মাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তাঁর সম্পর্কে বিশদ কিছু জানতাম না। তবে এটুকু জানতাম, তিনি লন্ডনের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে পরিবারসহ ফিরে এসেছেন এবং মহাবিশ্বের সুদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে মৌলিক কাজ করে যাচ্ছেন। স্যারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু চট্টগ্রাম শহর বা বিশ্ববিদ্যালয় কোনোটিতে যাওয়ার পারিবারিকভাবে অনুমতি পাইনি। তাই জামাল স্যারের সাক্ষাৎ পেতে আমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়।
বলতে গেলে একপ্রকার কাকতালীয়ভাবে আমার সঙ্গে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের সাক্ষাৎ হয় আশির দশকের শেষ দিকে। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করেছে। আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রায়ই দীর্ঘ ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু টানা ছুটিতে ভালো লাগে না, কতই আর মহল্লার মাঠে ক্রিকেট খেলে সময় কাটানো যায়! তাই মাঝেমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধুবান্ধব আর স্যারদের সঙ্গে দেখা করি। এ রকম একদিনই দেখা হয়ে গেল প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে হারুন স্যারের (আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর এ এম হারুন অর রশীদ) কক্ষে। সৌম্যদর্শন, সদা স্মিত হাসির মানুষটিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল।
হারুন স্যারের কাছে পরিচয় জানার পর আমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন, কী পড়ছি। আমতা আমতা করে জানালাম, জেনারেল রিলেটিভিটি শেখার চেষ্টা করছি। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী প্রশ্ন, ‌‘কোন বই পড়ছ?’
বলে রাখা ভালো, ইন্টারনেটের বদৌলতে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপে এখন শত শত বইয়ের সফটকপি থাকে, আশির দশকের শেষেও বিজ্ঞানের উচ্চতর পর্যায়ের বই এতটা সহজে পাওয়া যেত না। তখন সবেধন নীলমণি হয়ে আমাদের হাতের কাছে ছিল, হারুন স্যারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা স্টিভেন ওয়েনবার্গের বইটা। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার পুরো বইটা ওই যুগে ফটোকপি করাও ছিল পদ্মা সেতু তৈরি করার মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার (সে সময় প্রতিটি পৃষ্ঠা ফটোকপির জন্য ২ টাকা লাগত, অন্যদিকে কুর্মিটোলা–ফার্মগেট বাসভাড়া ছিল ২.৫০ টাকা)। তাই এরশাদ ভ্যাকেশনের ওপর ভরসা রেখে ঠিক করলাম পুরো বইটা হাতে কপি করব। হারুন স্যারকে প্ল্যানটা জানানোর পর স্যার তাঁর বইটা এক ‌এরশাদ ভ্যাকেশনের জন্য ধার দিলেন। আমিও খুব উৎসাহের সঙ্গে সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে কোরআন কপি করার স্টাইলে তিনটি মোটা নোট খাতায় বইটির প্রতিটি অধ্যায় কপি করে ফেলি।
সুতরাং জামাল স্যারের সঙ্গে আমার যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন আমার শুধু এই বইয়ের সঙ্গেই পরিচয় ছিল। বইয়ের নাম শুনেই জামাল স্যার বললেন, ‘ও বইয়ে তো আপেক্ষিকতা আধুনিক জ্যামিতির ভাষায় প্রকাশ করা নেই।’ তিনি আমাকে বার্নার্ড শুটজের লেখা একটি বইয়ের নাম বললেন। পরে সেটার একটি ফটোকপি তিনি হারুন স্যারের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমার খেদ, স্যারের পাঠানো ফটোকপিটি হারিয়ে ফেলেছি বা অন্য কেউ আমাকে না জানিয়ে হস্তগত করেছে। অবশ্য বর্তমানে ইন্টারনেটের বদান্যতায় বইটির সফটকপি আমার সংগ্রহে আছে। প্রথম পরিচয়েই জামাল স্যারের উদারতার যে পরিচয় পেলাম, পরেও তা অব্যাহত ছিল।
এর বছর কয়েক পরে আমি যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ছাত্র হিসেবে যোগদান করি। তখন আমার আপেক্ষিকতা কোর্সের শিক্ষক রাফায়েল সর্কিন (বর্তমানে ক্যানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউটে কর্মরত) জানতে পারলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, আমি কখনো জামাল নজরুল ইসলামের নাম শুনেছি কি না। রাফায়েল জানতেন না, জামাল স্যার বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। আমার কাছে বিস্তারিত শুনে তিনি অবাক হলেন, কারণ, জামাল নজরুল ইসলামের মতো খ্যাতিমান লোক কেন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন? পরে জানতে পারি, রাফায়েল সর্কিন ও জামাল নজরুল ইসলাম সত্তরের দশকে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। প্রতিবছর ঢাকায় গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতাম, প্রতিবার রাফায়েল জামাল স্যারের কথা জিজ্ঞেস করতেন।
জামাল স্যার ছিলেন কম্পিউটারবিমুখ মানুষ। তাই ইন্টারনেটের ব্যবহারে তিনি কাঁচা ছিলেন। রাফায়েল বা বিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন চিঠি লিখে। সেই চিঠি লেখা হতো টাইপরাইটারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। সেই আমন্ত্রণপত্রগুলো সবই লেখা হতো স্যারের টাইপরাইটার ব্যবহার করেই।
ইন্টারনেটের মতো জামাল স্যারের মোবাইলেও ছিল অনীহা। ২০১৩ সালের চট্টগ্রামে বিভাগীয় পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে এর প্রমাণ মেলে। জামাল স্যার ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। পুরস্কার বিতরণী পর্বটি ছিল শুক্রবার জুমার নামাজের পরপরই। কিন্তু নানা কারণে অনুষ্ঠানটি বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগীরা সারা দিনের ধকলে ক্লান্ত, তবু তাঁরা জামাল স্যারের দীর্ঘ বক্তৃতা না শুনে কেউ বেরিয়ে যাননি।
দেশের তরুণদের বিজ্ঞান গবেষণায় আকৃষ্ট করার তাঁর একটি স্বপ্ন ছিল। তাঁর ধারণা ছিল, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কেবল টেলিভিশন, মোবাইল ইত্যাদির দিকে বেশি নজর দেয় এবং এ কারণে তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। ওই দিন বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি বলেই ফেলেন, ‌‘তোমাদের মোবাইলগুলো পুকুরে ফেলে দাও।’ তিনি নিজে, ক্যালকুলেটর আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন না, সে ব্যাপারটা ছিল সর্বজনবিদিত।
জামাল নজরুল ইসলাম নিজে জটিল গণিত নিয়ে কাজ করতেন, তবে স্ট্রিং তত্ত্বের মতো উচ্চাভিলাষী তত্ত্ব তাঁর অপছন্দ ছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিজ্ঞানের পরিচিত গণ্ডিকেই আমরা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারিনি, সেখানে অপরিচিত ও অপরীক্ষিত জগতে পা বাড়ানো হবে অবিবেচকের কাজ। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে আমি এক বক্তৃতায় গ্লাশো-সালাম-ওয়েনবার্গ তত্ত্বের গণ্ডির ভেতরই নতুন ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আলোচনা করেছিলাম। স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়াও যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে নতুন ধারণার কিছু করা সম্ভব, সেটা তাঁকে দেখাতে পেরে আমারও ভালো লেগেছিল। জামাল স্যরের খ্যাতি ছিল মূলত তাঁর মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে গবেষণার জন্য। আমার বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করা হয়নি। এটা আমার জীবনের একটা বড় খেদ।
একবার এক অনুষ্ঠানে জামাল স্যারের বক্তৃতার সময় মিলনায়তনে বিদ্যুৎ চলে যায়। স্যার ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই পুরো এক ঘণ্টা বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা জামাল স্যারের ঠোঁটস্থ ছিল, সেদিন তার প্রমাণও পেয়েছিলাম। তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের চারটি কঠিন সমস্যা। সেগুলো নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। সমস্যাগুলো পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে। একমাত্র জামাল নজরুল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব ছিল ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোতে সাবলীলভাবে বিচরণ করা। তিনি বরাবরই চাইতেন নতুনেরা সমাধান না হওয়া চারটি পুরোনো সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করুক। এর মধ্যে একটি ছিল মাধ্যাকর্ষণের জন্য আইনস্টাইনের উৎসহীন সমীকরণের সর্বজনীন সমাধান বের করা।
আমরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের কোনো হিসাব দু-তিন পাতার বেশি লম্বা হলে কম্পিউটারের শরণাপন্ন হই। জামাল স্যার কম্পিউটারের ধার ধারতেন না। এক বক্তৃতায় ১০ পৃষ্ঠা লম্বা একটা সমীকরণই দেখিয়েছিলেন কম্পিউটার ব্যবহার না করে! দিব্যদৃষ্টি ছাড়া এ রকম লম্বা সমীকরণ সমাধান করা একেবারেই অসম্ভব। কম্পিউটার শুধু সেই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে, যেগুলোকে একটা গৎবাঁধা নিয়মের অধীনে ফেলা যায়। অন্যদিকে জামাল স্যারের মতো দিব্যদৃষ্টি শুধু কাগজ ও কলমের সুচিন্তিত ব্যবহারের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এ কারণেই বোধ হয় জামাল স্যারের কম্পিউটার ব্যবহারে অনীহা ছিল।
বিদেশে লেখাপড়া করা অনেক শিক্ষার্থী ছুটিতে এসে জামাল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ দেন, টানা পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ না করে দেশে ফিরে আসার। তাঁর মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানী যদি বিদেশে নিশ্চিন্ত জীবনের লোভ আর মোহ ত্যাগ করে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন, তবে আমাদের মতো সাধারণেরা কেন ব্যক্তিগত লাভের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য সময় ব্যয় করতে পারব না? জামাল স্যারের মতো নিবেদিত ও নির্মোহ বিজ্ঞান-সাধক আরও কেন পাচ্ছি না, তা জাতি হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাঁর মাপের বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এই দেশে আবার কবে পাব, তা অবশ্যই একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষ দ্রষ্টব্য :  লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায়।