জিনোম এডিটিং ও ক্রিসপার-ক্যাস৯

জীবকোষে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বা পরিবর্তন আনতে কোষের ডিএনএকে পরিবর্তন করার টেকনিক হলো জিনোম এডিটিং। সহজ কথায় ডিএনএ শিকলের কোনো একটি নিউক্লিওটাইডকে সরিয়ে সেই স্থানে আরেকটি নিউক্লিওটাইড প্রতিস্থাপন করা। এটি সুনির্দিষ্ট ও সুদক্ষভাবে ডিএনএ রূপান্তরের পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ডিএনএ বা জিনোম সিকোয়েন্সের কোনো একটি অংশ নতুন করে সংযোগ বা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বা পরিবর্তন আনা সম্ভব।

জিনোম এডিটিং করতে ইঞ্জিনিয়ার্ড নিউক্লিয়েজ নামের একধরনের এনজাইম ব্যবহূত হয়। এটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত, প্রথমটি হলো নিউক্লিয়েজ ও অন্যটি ডিএনএ টার্গেটিং অংশ। সাধারণত যখন নিউক্লিয়াসের ডিএনএ শিকলে কোনো অংশ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিস্থাপিত হয় অথবা এটিকে কৃত্রিমভাবে জিন সংযোজন বা বিয়োজন করে জিনোম পুলে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

জিনোম এডিটিংয়ের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন একটি ইঞ্জিনিয়ার্ড নিউক্লিয়েজ এনজাইমকে ডিএনএর একটি নির্ধারিত স্থানে প্রতিস্থাপন, প্রক্রিয়াটি যখন প্রাকৃতিকভাবে ঘটে, তখন শতভাগ সঠিকভাবে হয় না কিন্তু কৃত্রিমভাবে এর যথার্থ প্রতিস্থাপন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। প্রাকৃতিকভাবে যখন একটি ডিএনএতে জিনটি সঠিকভাবে পরিবর্তিত হয় না, তখন কোষের বা জীবের প্রাকৃতিকভাবেই কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। একে বলে মিউটেশন। জিনোম এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে নানা ইঞ্জিনিয়ার্ড নিউক্লিয়েজ ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর প্রতিটিই দুটি ভাগ—নিউক্লিয়েজ ও ডিএনএ টার্গেটিং অংশ নিয়ে গঠিত। তবে এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো একটি আরএনএভিত্তিক, যেটি ক্ষুদ্র আরএনএ সিকোয়েন্সের মাধ্যমে ডিএনএ কাঙ্ক্ষিত অংশ নির্ধারণ করে অপরটি প্রোটিনের ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অংশ চিহ্নিত করে।

জিনোম এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহূত নানা পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো সাম্প্রতিক সময়ে গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর জীবনরহস্য উদঘাটনে ব্যবহূত ক্রিসপার-ক্যাস৯। এটি জিনোম এডিটিংয়ের অতি ব্যবহূত, সুলভ ও কার্যকর পদ্ধতি। এর দুটি অংশ। এর মধ্যে ক্রিসপার হলো কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অংশ, যে অংশের সাথে আবার পথ প্রদর্শনের জন্য আরএনএ থাকে। আর ক্যাস৯ হচ্ছে ক্রিসপার সহযোগী প্রোটিন৯। এটি নিউক্লিয়েজ অংশ, যা দিয়ে ডিএনএ কাটা বা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। এটি প্রথমত ব্যাকটেরিয়ায় আবিষ্কার হয়েছিল, যা বিশেষ পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রমণকারী ভাইরাস ধ্বংস করে।

জিনোম এডিটিংয়ের আরেকটি পদ্ধতি জেডএফএন বা ‘জিংক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ’। এর ডিএনএ বাইন্ডিং পার্ট হলো জিংক ফিঙ্গার প্রোটিন, যেটির প্রতিটি তিনটি করে ডিএনএ ক্ষারক ধারণ করে। যদিও এটি যাচাই না করে ধারণা করা কঠিন। জেডএফএনের নিউক্লিয়েজ অংশ হলো একটি ফকআই (FokI) নিউক্লিয়েজ, যেটি ডিএনএ কর্তন বা সংযোজন-বিয়োজন করে। দুটি ফকআই (FokI) অণু যুক্ত হয়ে একটি ডিএএন অংশ বা একটি জেডএফএন, যেটি আরেকটি অংশের সঙ্গে পরস্পর যুক্ত থাকে।

জিনোম এডিটিংয়ের তৃতীয় পদ্ধতির নাম টালেনস। পুরো নাম ‘ট্রান্সক্রিপশন অ্যাক্টিভেটর-লাইক এফিক্টেটিভ নিউক্লিয়েজ’। এর প্রতিটি ডিএনএ বেসে চারটি টালেন ডোমেইন থাকে। ফলে এটি জেডএফএনের তুলনায় সহজে বিশেষ ডিএনএ সিকোয়েন্স গঠন করতে পারে। জেডএফএনের মতো নিউক্লিয়েজ অংশ হলো একটি ফকআই (FokI)। দুটি ফকআই (FokI) অণু একত্রে যুক্ত হয়ে একটি ডিএনএ অংশ বা একটি টালেন তৈরি করে, যা টালেন অংশের সঙ্গে পরস্পর যুক্ত হয়ে শিকল তৈরি করে।

সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, মানবকোষে বাসা বেঁধে থাকা এইচআইভি-এইডস ভাইরাসকে জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে জিনোম থেকে আলাদা করার পথ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা—ঠিক কম্পিউটার থেকে ফাইল ডিলিট করার মতোই। এ দাবি করেছেন টেম্পল ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম ক্রিসপার-ক্যাস-৯ জিনোম এডিটিং সিস্টেম। এ আবিষ্কার বাস্তবায়িত হলে এইডস গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্য আসবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। হাসি ফুটবে বিশ্বের প্রায় কয়েক কোটি আক্রান্ত মানুষের মুখে। এইচআইভি ভাইরাস মানবকোষে একবার ঢুকতে পারলে আর বেরোয় না। ঘাঁটি গেড়ে বসে। আক্রান্ত ব্যক্তির ডিএনএতে ঢুকিয়ে দেয় এর মরণ জিনোম। ফলে বাকি জীবন ওষুধ আর হাজারো চিকিত্‍সার ওপর ভরসা করেই কাটাতে হয় রোগীকে। নয়া আবিষ্কার সেই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। টেম্পলের নিউরোসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক দলের প্রধান কামেল খলিলি বলেন, ‘এইডস পুরোপুরি সারিয়ে তোলার পথে এটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।’ অবশ্য একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘এটা ফাটাফাটি আবিষ্কার ঠিকই, কিন্তু ক্লিনিক পর্যন্ত একে পৌঁছে দিতে এখনো দেরি আছে।

গত প্রায় ১৮ বছরে এইচআইভির সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষের হাতিয়ার হাইলি অ্যাক্টিভ অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি। এইচআইভি-১ ভাইরাসের বাড়াবাড়ি ঠেকিয়ে রেখেছে এই থেরাপিই। খলিলির কথায়, ‘ভাইরাস কম সংখ্যায় বাড়লেও (লো লেভেল রেপ্লিকেশন) আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এমন সব রোগ বাসা বাঁধে, যেগুলো সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে কার্ডিওমায়োপ্যাথি, হাড়ের অসুখ, কিডনির অসুখ ও স্নায়ুর রোগ। ভাইরাসকে বশে রাখতে যেসব ড্রাগ শরীরে ঢোকানো হয়, অনেক সময় তা এই রোগগুলোকেই আরও আক্রমণাত্মক করে তোলে। তাই বিজ্ঞানীরা সেই পথ খুঁজেছেন, যে পথে এগোলে এইচআইভি ভাইরাসকে একেবারে ঠেঙিয়ে মানবকোষ থেকে বিদায় করা যাবে। খলিলি ও তাঁর সহকর্মীরা ল্যাবে দিনের পর দিন গবেষণার সেই পথের সন্ধানও পেয়েছেন অবশেষে। গবেষকেরা ২০-নিউক্লিওটাইডের গাইড আরএনএকে পাঠিয়েছেন এইচআইভি-১ ডিএনএ লক্ষ্য করে আক্রমণ করতে। আরএনএকে শক্তিশালী করা হয়েছে তার সঙ্গে ডিএনএ-পৃথকীকরণ উত্‍সেচক (এনজাইম) ক্যাস-৯-কে জুড়ে দিয়ে। এই গাইড আরএনএ মূলত আক্রমণ শাণায় জিনের কন্ট্রোল রিজিয়নে, যার পোশাকি নাম লং টার্মিনাল রিপিট (এলটিআর), যা এইচআইভি-১ জিনোমের দুদিকেই থাকে। এদের টার্গেট করে ক্যাস৯ নিউক্লিয়েজ, এইচআইভি-১ জিনোমের অন্যতম উপকরণ নিউক্লিওটাইডকে ছিঁড়ে নিয়ে চলে আসে।

এ ছাড়া ক্রিসপার-ক্যাস৯ সার্জারি ব্যবহার করে বার্ধক্যজনিত ক্ষীণদৃষ্টি, ছানি বা অন্ধত্ব সারানোর ঘোষণা দিয়েছেন সেন্টার ফর জিনোম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিজ্ঞানীরা। সায়েন্স ডেইলিতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বেসিক সায়েন্সের (আইবিএস) অধ্যাপক কিম জিন সু বলেন, ভাসকুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টরজনিত (VEGF) কর্নিয়াল নিওভাসকুলারাইজেশনকে (CNV) দমিয়ে রাখতে পারে আমরা এমন সার্জারি পদ্ধতি তৈরি করতে পেরেছি। এই পদ্ধতিতে ক্রিসপার-ক্যাস৯-এর মাধ্যমে রোগ সৃষ্টিকারী উপকরণকে ছিঁড়ে ফেলে নতুন ডিএনএ অংশ সংযোজন করে রোগীকে চিকিত্সা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বেসিক সায়েন্সের আরেক অধ্যাপক কিম জেওয়ং হুন বলেন, এর আগে এ সুবিধা ব্যবহার করে শুধু জন্মসূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্যানসার বা অন্য কোনো রোগ চিকিত্সার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো কিন্তু এখন এটি নতুন করে উদ্ভব কোনো রোগের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যাবে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি., গাজীপুর

সূত্র: জিনোম রিসার্চ লিমিটেড এবং সেন্টার সেন্টার ফর জিনোম ইঞ্জিনিয়ারিং, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত