ভালো দাবাড়ু হতে হলে

আমাকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন শুনতে হয়, কীভাবে ভালো দাবাড়ু হওয়া যায়। উত্তরটা এককথায় দেওয়া যায়, অন্য যেকোনো কিছুতে ভালো হওয়ার জন্য যেমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, দাবায়ও তা-ই। আপনাকে দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। আমি মনে করি, সেই প্রক্রিয়াটা প্রথম পর্যায়ে চার বছর। টানা চার বছর ঠিকমতো চেষ্টা করলে একজন ভালো দাবাড়ু হতে পারবেন। এবার প্রক্রিয়াটা নিয়ে কিছু বলা যাক।

শুরুতেই আপনাকে শিখে নিতে হবে নিয়মকানুনগুলো। দাবায় গাণিতিকভাবে হাজারো সম্ভাবনা হলেও মূল নিয়ম কিন্তু খুব অল্প। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ দাবা খেলতে জানে। চায়ের দোকানে কিংবা ধানখেতেও আমি দাবা খেলতে দেখেছি। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন অল্প কিছু নিয়মকানুনের মধ্যেও দু-একটা ভুল ধারণা ঢুকে গেছে। যেমন খেলার শুরুতে দুটো ভিন্ন ভিন্ন সৈন্য একই সঙ্গে চাল দেওয়া যাবে। আসলে এমন কোনো নিয়ম নেই। তাই আসল নিয়মগুলো আপনাকে শিখতে হবে। অনেককেই দেখি ক্যাসলিং বোঝেন না। অথচ ক্যাসলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা চাল, যেকোনো লেভেলে দাবা খেলার জন্য। এরপর শিখতে হবে নোটেশন। দাবা খেলায় চালগুলো লিখে রাখার জন্য বিভিন্ন নোটেশন-পদ্ধতি আছে। সবচেয়ে প্রচলিত বীজগাণিতিক নোটেশন। এই পদ্ধতি ফিদের অফিশিয়াল নোটেশন-পদ্ধতি। অফিশিয়াল খেলায় খেলোয়াড়কেই প্রতিটি চাল লিখে রাখতে হয় এ পদ্ধতিতে।

দাবা খেলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সারা বছর ধরে যেমন আমরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করি, তেমনি দাবাও নিয়মিত রুটিনের মধ্যে রাখতে হবে। চার বছরে ভালো খেলোয়াড় হতে চাইলে টানা চার বছরই চর্চা করতে হবে। মাঝে বিরতি দিলে ভুল হবে।

দাবা খেলা মস্তিষ্কের খেলা, তাই মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার করতে হবে। এ জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পড়তে হবে সব ধরনের বই। যাঁদের খুব বই পড়ার অভ্যাস, তাঁদের জন্য এটা সহায়ক হবে। দাবাবিষয়ক বই অবশ্যই পড়তে হবে। আমার বড় একটা বুকশেলফ আছে, যেখানে পুরোটা দাবার বই দিয়ে ভর্তি। সব কটিই আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। তবে শুরুতে পড়তে হবে একেবারে প্রাথমিক কোনো বই। আমাদের দেশের তারকা দাবাড়ু রানী হামিদ আন্টি অনেক বই লিখেছেন। তাঁর কোনো একটা বই দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। ধাপে ধাপে পড়তে হবে আরও অনেক বই। দাবার বইয়ের বাইরে মনোবিজ্ঞানের কিছু বই পড়া যেতে পারে। কীভাবে লক্ষ্য স্থির করতে হয়, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কীভাবে ছুটতে হয়—এ বিষয়ে কোনো ভালো মনোবিজ্ঞানের বই পড়া কাজে দেবে। আমার ক্ষেত্রে অনেক কাজে দিয়েছে এটা।

এবার আসি খেলায়। খেলতে হবে অনেক অনেক ম্যাচ। এর কোনো বিকল্প নেই। রক্ত-মাংসের মানুষের সঙ্গে যেমন খেলতে হবে, তেমনি খেলতে হবে কম্কিউটারের বিপক্ষেও। মানুষের সঙ্গে খেলার জন্য কোনো বন্ধুকে সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে কোনো দাবা ক্লাবে যুক্ত হয়ে যাওয়া হবে ভালো বুদ্ধিমানের কাজ। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন নিয়মিত নানা টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। বিভিন্ন লেভেলের জন্য। সেগুলোতে খেলা শুরু করা উচিত নিজের লেভেল বুঝে। এর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় হয় স্থানীয় টুর্নামেন্ট, যদিও এখন এর সংখ্যা খুব কমে গেছে। ওই টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিতে হবে নিয়মিত। অর্থাত্, খেলতে হবে যত বেশি পারা যায়।

এখন বেশ সুবিধা হয়েছে। সবার হাতে এসেছে স্মার্টফোন। কম্কিউটার বা স্মার্টফোনে খেলতে হবে দাবা। আমার প্রিয় চেসবেজ (chessbase.com)। এখানে প্রায় ৫০ লাখের বেশি খেলার ডেটাবেজ রয়েছে। কম্কিউটার ও স্মার্টফোন দুই জায়গায়ই এটি ফ্রি ডাউনলোড করে নেওয়া যায়। ওই ওয়েবসাইটে গেলেই পাবেন। আর খেলার জন্য চেজবেজেরই ইঞ্জিন playchess.com। এটাও ডাউনলোড করে নেওয়া যায়। এরপর আপনি খেলতে পারবেন চাইলে কম্কিউটারের সঙ্গে। অফলাইনে বসেই। আর অনলাইনে গেলে পাবেন নানা লেভেলের খেলোয়াড়। তাদের সঙ্গেও খেলতে পারবেন। আমার পরামর্শ, এই সফটওয়্যার দুটি কম্কিউটারে অথবা স্মার্টফোনে নামিয়ে এর প্রতিটি ফিচারের সঙ্গে পরিচিত হোন। স্মার্টফোনের জন্য পাওয়া যায় প্লে ম্যাগনাস* নামের একটা অ্যাপ। এটিতে আপনি বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্কিয়ন ম্যাগনাস কার্লসনের বিভিন্ন বয়সের অনুরূপ ইঞ্জিনের সঙ্গে খেলতে পারবেন।

দাবা খেলাকে অনেকে যুদ্ধের মতো চিন্তা করেন। এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আছে, ট্যাকটিক্স এবং স্ট্র্যাটেজি। ট্যাকটিক্স হলো ছোট পরিকল্পনা, দু-একটা চালের পরিকল্পনা। স্ট্র্যাটেজি হলো দীর্ঘ বা অনেকগুলো চালের পরিকল্পনা। বহু বছরের দাবা খেলার মাধ্যমে অনেক ট্যাকটিক্স ও স্ট্র্যাটেজি গড়ে উঠেছে, সেগুলো বইয়ে-ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে, এগুলো আস্তে আস্তে শিখে নিতে হবে।

দাবার গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, খেলার ওপেনিং। নানা ধরনের ওপেনিং আছে। সাদা নিয়ে খেললে এক ধরনের, কালো নিয়ে খেললে এক ধরনের। সেগুলোও শিখতে হবে। আমার পছন্দের ওপেনিংগুলোর মধ্যে আছে ইংলিশ ওপেনিং, সিসিলিয়ান ডিফেন্স, কুইন্স পন ওপেনিং। ওপেনিং শিখতে হবে, খেলা শেষ করা শিখতে হবে। আর শিখতে হবে গেম ডেভেলপমেন্ট। একটা ছোট্ট স্ট্র্যাটেজি বলি, ফুটবলের মতো দাবায়ও মধ্য মাঠ খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাঝের চারটি ঘর দখলে রাখা খেলায় এগিয়ে থাকার ভালো একটা স্ট্র্যাটেজি।

শেষ যে কাজটা করতে হবে, অন্যের খেলা দেখতে হবে। সরাসরি উপস্থিত থেকে যেমন দেখা যেতে পারে, অনলাইনেও দেখা যেতে পারে। তেমনি দেখতে হবে পড়েও। বড়-ছোট সব ধরনের খেলোয়াড়ের খেলা অনলাইনে পাওয়া যায়, চেসবেজেই আছে ৫০ লাখের বেশি। সেগুলো থেকে বিভিন্ন খেলার চালগুলো দেখতে হবে। তাহলেও শেখা যাবে অনেক কিছু। খেলাগুলো নিয়ে বড় বড় দাবাড়ুরা কমেন্ট্রি দেন, সেগুলোও শুনতে হবে বা পড়তে হবে। বিখ্যাত ম্যাচগুলোর প্রতিটি চালের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তা-ও পড়তে হবে নিয়মিত। সবশেষে, খেলতে হবে অনেক, পড়তে হবে অনেক, সময় দিতে হবে নিয়মিত। নিজের একটা লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। ছুটতে হবে সে লক্ষ্যের পেছনে। তবেই হওয়া যাবে ভালো দাবাড়ু।

*প্লে ম্যাগনাস সম্কর্কে বিস্তারিত পাওয়া যাবে ৮৭ পৃষ্ঠায়

লেখক: বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার

অনুলিখন: ইবরাহিম মুদ্দাসসের