দাবা খেলায় শুরু যেভাবে

নিয়মকানুন শিখে নেওয়ার পর দাবায় শিখতে হবে ট্যাকটিকস, স্ট্র্যাটেজি। দাবা খেলাকে ভাগ করা হয় তিন ভাগে। শুরুর ভাগ, মধ্যভাগ আর শেষ ভাগ। প্রথম ভাগে থাকে গেম ডেভেলপমেন্ট। মধ্যভাগে খেলা আর শেষে হয় কিস্তিমাত। পরের দুই ভাগ নির্ভর করে শুরুর ভাগে একজন খেলোয়াড় কতটা ভালো গেম ডেভেলপ করতে পারল তার ওপর। সাধারণত প্রথম ১৫ চালকে বলা হয় শুরুর ভাগ। এ সংখ্যায় আলোচনা করা হলো শুরুর ভাগের খেলার বুদ্ধি নিয়ে।

খেলার শুরুতে নানা ধরনের চালের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, তাই হিসাব করে চাল দেওয়াও খুবই কঠিন। প্রতিটি চাল এবং তার ফলাফল চিন্তা করা শুরুতে সম্ভব নয়। তাই ছোট্ট কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে খেললে সহজ হবে এ ভাগে বিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকা।

যুদ্ধের মাঠে দাবা খেলা

দাবা খেলার মাঠটাকে চিন্তা করা যায় যুদ্ধের মাঠের মতো। ১ নম্বর ছবির মাঝের লাল দাগটাকে বলা হয় ফ্রন্টিয়ার লাইন। এর সামনে আপনার শত্রু এলাকা। সে এলাকায় আপনার যত দখল থাকবে, আপনি খেলায় তত এগিয়ে থাকবেন। দখল থাকা মানে আপনার কোনো ঘুঁটি থাকা অথবা কোনো ঘুঁটি দিয়ে ওই ঘরের ওপর আক্রমণ করার মতো অবস্থা থাকা।

ফুটবল খেলার মতো দাবায়ও মধ্যমাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উভয় খেলোয়াড়ের সমান শক্তি আছে এমন অবস্থায় মাঝের চারটি ঘরে (১ নম্বর ছবির সবুজ বর্গ) যে খেলোয়াড়ের দখল বেশি সাধারণভাবে বলা যায় সে-ই এগিয়ে আছে খেলায়।

১ নং ছবি

গেম ডেভেলপমেন্ট

খেলার শুরুতে উভয় খেলোয়াড়ের ঘুঁটি থাকে ৩২টি, আর ফাঁকা ঘর থাকে ৩২টি। শুরু খেলা, এই ৩২ ঘরের দখল নেওয়া। খেলা যত এগোতে থাকে, উভয় খেলোয়াড়ের ঘুঁটি কাটা পড়তে থাকে, ফাঁকা ঘরও বাড়তে থাকে। সে ঘরগুলোতেও দখল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

খেলা শুরুর মূলমন্ত্র গেম ডেভেলপমেন্ট। গেম ডেভেলপমেন্ট মানে ঘুঁটিগুলোকে এমন অবস্থায় নেওয়া যাতে ফ্রন্টিয়ার লাইনের ওই পাশে অর্থাত্ বিপক্ষের ঘরে দখল বাড়ে। দখল যত বাড়বে, খেলায় তত এগিয়ে যাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হবে গণতান্ত্রিকভাবে, প্রতিটি ঘুঁটিকে চেষ্টা করতে হবে কাজে লাগানোর। শুধু মন্ত্রী দিয়ে বড় একটা অঞ্চল দখল করে ফেলব, তা চিন্তা করলে শেষে হেরে যেতে হবে।

২ নম্বর ছবিতে এবার সাদার চাল। গেম ডেভেলপমেন্ট করে খেলা নিজের দিকে নিতে চাল হতে পারে তিনটি। (১) Bb2, এতে বড় একটা কর্ণ দখলে আসবে। (২) Re1, এই চাল দিলে দখলে আসবে একটা পূর্ণাঙ্গ ফাঁকা ফাইল (কলাম)। (৩) Ne4, ঘোরাকে সেন্টারে বসানো হচ্ছে, মধ্যমাঠে অবস্থান। খেলার এই মুহূর্তে সাদার উচিত হবে এই চালগুলো চিন্তা করা এবং আস্তে আস্তে এই পজিশনগুলো দখল করা।

এক লাইনের বুদ্ধি

এই কথাটা খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে, পরপর দুবার একই ঘুঁটি চালা যাবে না খেলার শুরুতে। এতে খেলায় পিছিয়ে পড়তে হবে। এমনভাবে প্ল্যান করতে হবে চালগুলো, যাতে এক ঘুঁটি দুবার চালতে না হয়। অন্য ঘুঁটিকেও ডেভেলপ করতে সুযোগ দিতে হবে।

২ নং ছবি
৩ নং ছবি

সৈন্যের ঘুঁটিবাজি কম

যুদ্ধের মাঠে সৈন্যরা গিয়ে মারামারি করে। কিন্তু দাবায় লড়াইটা করতে হবে অন্য ঘুঁটি দিয়ে। সৈন্যের চাল দেওয়া মানে একটা চাল অপচয় করা, এভাবে ভাবতে হবে। আর এক চাল অপচয় করলে আপনি বিপক্ষের চেয়ে এক চাল পিছিয়ে গেলেন। শুধু তখন সৈন্য চালা যাবে, যখন সৈন্য মধ্যমাঠ (গুরুত্বপূর্ণ চারটি ঘর) দখলে সাহায্য করবে বা বিপক্ষের মধ্যমাঠ দখলকে প্রতিহত বা মোবিলাইজ করবে। ল্যাস্কারের মতে, সবচেয়ে ভালো হয় খেলার শুরুতে আপনি যদি এক বা দুটি সৈন্য চেলে খেলা এগিয়ে নিতে পারেন।

বিপক্ষের সৈন্যও শুরুতে খাওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই। ব্যতিক্রম মধ্যমাঠের চার ঘুঁটির জন্য।

মধ্যমাঠের চার ঘরের সৈন্য সব সময় খেয়ে ফেলতে হবে, যদি এ জন্য শক্তিশালী কোনো ঘুঁটি হারানোর সম্ভাবনা না থাকে বা কোনো ফাঁদে না পড়তে হবে। মধ্যমাঠের চার ঘরের দখলের জন্যই শুধু সৈন্য কাটা যেতে পারে।

ডেভেলপড ঘুঁটির দাম বেশি

খেলার সময় বিপক্ষের ঘুঁটি যেমন কাটতে হবে, তেমনই নিজের ঘুঁটিও দু-একটা কাটা যেতে দিতে হবে। অনেক সময় বিপক্ষের ঘুঁটি কাটতে গিয়ে নিজের একটা ঘুঁটি কাটা পড়তেই পারে। একে বলে বিনিময় বা এক্সচেঞ্জ।

বিনিময় করার সময় প্রথমতো মাথায় রাখতে হবে বিপক্ষের চেয়ে বেশি শক্তির ঘুঁটি যাতে হারাতে না হয়। ঘুঁটিগুলোর শক্তি হলো: সৈন্য=১, হাতি=৩, ঘোড়া=৩, নৌকা=৫, মন্ত্রী=৯। দ্বিতীয়ত মনে রাখতে হবে, যাতে নিজের ডেভেলপ করা ঘুঁটিই কাটা না যায়। যেমন ছবি ৪-এ সাদার উচিত হবে না ডেভেলপ করা হাতির বিনিময়ে বিপক্ষের ডেভেলপ না করা ঘোড়া খাওয়া। আবার উল্টোটাও সত্য, নিজের ডেভেলপ না করা ঘুঁটির বিনিময়ে একই শক্তির বিপক্ষের একটা ডেভেলপ করা ঘুঁটি কাটতে পারলে বিনিময় করা যেতে পারে।

দুর্গ প্রতিষ্ঠা করতে হবে দ্রুত

ক্যাসলিং বা দুর্গ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। ক্যাসলিং করার মাধ্যমে সৈন্যের চাল না দিয়েই নৌকাকে ডেভেলপ করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর রাজা হয় সুরক্ষিত।

কয়েকটি প্রচলিত খেলার শুরু

শত শত বছরের খেলায় শুরুর ভাগে খেলার জন্য কিছু সহজ সূত্র দাঁড়িয়ে গেছে। একে বলে ওপেনিং। দক্ষ দাবাড়ুরা এগুলো ব্যবহার করেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। নবীন খেলোয়াড়দের জন্য ওপেনিংগুলো শিখে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার খুব সহজ নয়। সেগুলো শিখতে হবে পরের ধাপে। প্রথমে চাই এসব ট্যাকটিকস রপ্ত করা।

শেষে সংক্ষেপে

খেলার শুরুর ভাগের উদ্দেশ্য গেম ডেভেলপমেন্ট, বিপক্ষকে আক্রমণ করা নয়। একই সঙ্গে করতে হবে নিজের রাজাকে সুরক্ষিত, সাধারণভাবে ক্যাসলিং করে। অহেতুক সৈন্য চেলে চাল নষ্ট করলে খেলায় পিছিয়ে পড়তে হবে। চেষ্টা করতে হবে প্রতিটি ঘুঁটি (সৈন্য বাদে) ডেভেলপ করার। একই ঘুঁটি দুবার চালা অত্যন্ত বোকামি। মধ্যমাঠে দখল রাখলে যেকোনো সময়ই এগিয়ে থাকা যায়। বিনিময় করার সময় মাথায় রাখতে হবে, যাতে ডেভেলপড ঘুঁটি না হারাতে হয়। শিখে নেওয়া যেতে পারে কয়েকটি ওপেনিং।

এক খেলায় এসব ট্যাকটিকসের প্রতিটি প্র্যাকটিস করার দরকার নেই। একটা একটা করে ট্যাকটিকস ধরুন, সেটা আত্মস্থ করুন। শেষ হলে ধরুন আরেকটা ট্যাকটিকস। ভালো শুরুর ভাগ শিখতে পারলে, পরের ভাগেও পারবেন ভালো খেলতে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং

সূত্র: My System/ Aron Nimzoitsch I How To Reassess Your Chess/ Jeremy Silman

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত