স্ট্রিং তত্ত্ব: কেন?

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের জগতে স্ট্রিং তত্ত্ব এমন এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বিষয়ে গবেষণা করলেই বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার লোকজন বেশ সমীহ করেন। কারণ, আইনস্টাইনের একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব (unified field theory) প্রণয়নের যত ধরনের প্রচেষ্টা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে এই তত্ত্ব। হয়তোবা এ কারণেও পদার্থবিজ্ঞানে একদম হাতেখড়ি হয়েছে এমন শিক্ষার্থীরাও স্ট্রিং তত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহী। আসলেই কি এর কোনো সত্যিকারের অর্জন আছে, নাকি এর সব অর্জন ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’? এই প্রশ্নের উত্তর নিরপেক্ষভাবে বের করতে হলে আমাদের এই তত্ত্বের ব্যুত্পত্তির দিকে তাকাতে হবে।

আমরা বর্তমানে স্ট্রিং তত্ত্বকে মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম ব্যাখ্যার একটি প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করলেও এর শুরু হয়েছিল সবল কেন্দ্রীণ (strong nuclear) বলের একটি মডেল হিসেবে। বিজ্ঞানীরা ১৯৫০-এর দশকে দেখতে পেলেন প্রোটন অথবা নিউট্রনের সঙ্গে পাই মেসনের (এই কণাগুলোর মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানচিন্তার আগের সংখ্যাগুলোয় সামান্য লিখেছিলাম) বিক্রিয়ায় অনেক অনুনাদ (resonance) কণার উত্পত্তি হয়, যারা খুবই ক্ষণস্থায়ী। আরও দেখা গেল, শক্তির মান বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ রকম নতুন নতুন অনুনাদ কণা আবিষ্কৃত হচ্ছে তো হচ্ছেই। যেন এর শেষ নেই। কথিত আছে, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী উইলিস ল্যাম্ব এই সময় কৌতুকোচ্ছলে নতুন কণা আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পরিবর্তে ১০ হাজার ডলার জরিমানার প্রস্তাব করেছিলেন। তবে এসব অনুনাদ কণার অস্তিত্ব বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত কোয়ার্ক নকশার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা গেলেও ওই সময়ে এই ক্রমবর্ধমান অনুনাদ কণাগুলোর ব্যাখ্যা দিতেই স্ট্রিং তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। একটিমাত্র তারের অনেকগুলো কম্পাঙ্ক থাকে (যেটা আমরা গিটার বা অন্য যেকোনো বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে দেখে থাকি)। আর এই ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের সংখ্যা অসীম। বিজ্ঞানীরা এই (সবল) কেন্দ্রীণ মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী কণাগুলোকেও (যাদের আমরা হ্যাড্রন বলে থাকি) এ রকম একটি মৌলিক তার বা সুতার ভিন্ন ভিন্ন উত্তেজিত অবস্থা (excited state) হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। এই তত্ত্বের শুধু একটি প্যারামিটার (parameter) আছে। আর সেটা হচ্ছে তারের টান (tension)। সবল কেন্দ্রীণ বলের ধর্ম ব্যাখ্যার জন্য এই টানের মান ১০৯ ইলেকট্রনভোল্ট (সংক্ষেপে বঠ) হওয়া প্রয়োজন।

সাধারণ কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে আমরা যে মৌলিক কণা নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তারা সময়ের বিবর্তনে স্থানকালে (spacetime) একটা লাইন তৈরি করে, যেখানে আমরা ওয়ার্ল্ডলাইন (worldline) বলি।

স্ট্রিং দুই প্রকার হতে পারে: খোলা বা বন্ধ। কণার বিবর্তন যেমন একটি লাইন দেয়, ঠিক তেমনি স্ট্রিংয়ের বিবর্তন দেবে একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ (surface )। খোলা স্ট্রিংয়ের জন্য এটা হবে একটা চাদরের মতো, আর বন্ধ স্ট্রিংয়ের জন্য পৃষ্ঠটি হবে একটি নলের মতো।

কিন্তু এই ব্যাখ্যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ করলেও একটা জায়গায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়মানুসারে এই তারের বিভিন্ন দশার মাঝে একটা দশা পাওয়া গেল, যেটা একটা ভরহীন কণা হিসেবে দেখা দেবে (যেমন: আলোর কণা, ফোটন), কিন্তু তার স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা হবে ২। এ রকম কোনো হ্যাড্রন পরীক্ষাগারে দেখা যায় না। এ জন্য যাঁরা তার বা স্ট্রিংয়ের মাধ্যমে সবল কেন্দ্রীণ বল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা একটু দমে গেলেন। একই সময়ে কোয়ার্কের ধারণা প্রচলিত হওয়ার কারণে অনেকেই এই ধাঁচের স্ট্রিং তত্ত্ব, যা বর্তমানে উঁধষ ত্বংড়হধহপব মডেল নামে পরিচিত, নিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন। তারপরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী এই তত্ত্বের ওপর কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭৪ সালে জন শোয়ার্জ ও জোয়েল শার্ক মিলে (এবং আলাদাভাবে তামিয়াকি ইয়োনেয়া) দেখালেন, তারের টান ১০৯ বঠ-এর পরিবর্তে ১০১৯ বঠ হলে স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা ২-বিশিষ্ট এই অস্বাভাবিক ভরহীন কণাটিকে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম কণা গ্রাভিটন (মত্ধারঃড়হ) কণা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ, এটি সাধারণ আপেক্ষিকতার আইনস্টাইনের সমীকরণ মেনে চলে। তাঁদের এই আবিষ্কার স্ট্রিং তত্ত্বকে শুধু নিশ্চিত অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাই করেনি, বরং এর মাধ্যমে স্ট্রিং তত্ত্ব এক লাফে মহাকর্ষের সঠিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের দাবিদার হিসেবে বিবেচিত হতে থাকল। এর পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন, স্ট্রিংয়ের সুষ্ঠু কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রণয়নের জন্য স্থানকালের মাত্রার সংখ্যা (তত্ত্বভেদে) ২৬ অথবা ১০ হওয়া প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ত্রুটি মনে হলেও, এটা আসলে একটি শাপে বর। এটা বুঝতে হলে আমাদের ১৯১৯ সালে ফেরত যেতে হবে। এ সময় থিওডর কালুজা দেখালেন, পঞ্চমাত্রিক জগতের জন্য লেখা আইনস্টাইনের তত্ত্বকে যদি চতুর্মাত্রিক জগতে প্রক্ষেপণ (Projection) করা হয়, তবে তার মাঝে ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বক সমীকরণগুলোও লুকিয়ে থাকে। এটা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব প্রণয়ন করার দিকে একটি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। তার মানে চারের বেশি মাত্রার জগতে স্ট্রিং তত্ত্ব প্রণীত হওয়ার কারণে এই তত্ত্ব আমাদের জগতে মহাকর্ষের পাশাপাশি অন্যান্য মৌলিক বলের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করে।

এদিকে আমরা যত মৌলিক কণা দেখতে পাই সেগুলোকে তাদের স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যার মান অনুসারে বোসন ও ফার্মিয়ন—এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এতক্ষণ পর্যন্ত যে স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম, তা শুধু বোসন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করে। তবে এর দ্বারা আমাদের দেখা কোনো ফার্মিয়ন কণার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এ জন্য এ ধরনের স্ট্রিং তত্ত্বকে বোসোনীয় স্ট্রিং তত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। এই তত্ত্বের বেশ কিছু দোষ আছে, যার ভেতর দুটি বেশি দৃষ্টিকটু। প্রথমত, কোনো কণার ভরকে অবশ্যই একটি বাস্তব রাশি হতে হবে। এর কারণে ভরের বর্গ কখনোই একটি ঋণাত্মক সংখ্যা হওয়া সম্ভব নয়। এটা হলে সিস্টেমের সবচেয়ে কম শক্তিবিশিষ্ট অবস্থা স্থিতিশীল হবে না। এটা নিচের চিত্র দিয়ে সহজেই বোঝানো সম্ভব:

বাঁয়ের চিত্রে শক্তির একটি সর্বনিম্ন মান আছে যে অবস্থানে এসে সিস্টেম থিতু হবে, কিন্তু সে রকম কিছু ডানের চিত্রে পাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সিস্টেমে কোনো সর্বনিম্ন শক্তিস্তর বলে কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সিস্টেম হতে আপনা-আপনি টানা শক্তি বিকিরণ চলতে থাকবে, যেটা আমাদের অভিজ্ঞতায় মেলে না। বোসনীয় স্ট্রিং তত্ত্বে ডানের অবস্থাটিই দেখা দেয়। আর দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, এই তত্ত্বের জন্য স্থানকালের মাত্রাকে ২৬ হতে হয়, যেটা আমাদের দেখা চতুর্মাত্রিক স্থানকাল থেকে অনেক অনেক ভিন্ন। এ দুটির মধ্যে প্রথম ত্রুটিটি বেশি দূষণীয়।

এই ত্রুটিটি সারাতে হলে বোসোনীয় স্ট্রিংয়ের পরিবর্তে সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। ‘সুপার’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়, কারণ এখানে সুপারপ্রতিসাম্য ব্যবহার করা হয়। সুপারপ্রতিসাম্য হচ্ছে এমন এক প্রতিসাম্য, যেখানে বোসন ও ফার্মিয়ন কণার স্পিন ছাড়া অন্য সব কোয়ান্টাম সংখ্যা একই থাকে। সুপারপ্রতিসাম্যবিশিষ্ট যেকোনো সিস্টেমের মোট শক্তি কখনোই ঋণাত্মক হতে পারে না। এ জন্য বোসোনীয় স্ট্রিং তত্ত্বের সমস্যাটি সুপারস্ট্রিংয়ের ক্ষেত্রে তৈরি হয় না। সুপারস্ট্রিং তত্ত্বের আরেকটি তুলনামূলক ভালো দিক হলো, এটার জন্য আমাদের জগেক ১০ মাত্রার হতে হবে, যেটা বোসোনীয় স্ট্রিংয়ের ২৬ মাত্রা থেকে ১৬ মাত্রা কম। আর পাশাপাশি সুপারস্ট্রিংয়ের কাঁপুনিতে বোসন কণার পাশাপাশি ফার্মিয়ন কণারও উদ্ভব হয়, যে কারণে আমাদের দেখা বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য বোসোনীয় স্ট্রিংয়ের পরিবর্তে সুপারস্ট্রিংই জুতসই।

কিন্তু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা যতই চমত্প্রদ আর আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করান না কেন, কোনো তত্ত্ব ঠিক কি না, তার নিরীক্ষা করার কষ্টিপাথর হলো পরীক্ষণের ফলাফল। স্ট্রিং তত্ত্বকে এই বিচারকাষ্ঠে দাঁড় করালে কী রায় আসে, তা বিজ্ঞানচিন্তার আগামী সংখ্যায় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়