পরমাণুর স্বরূপ সন্ধানে মানুষের অভিযাত্রা

পরমাণুর ধারণাটি এসেছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, এই কণাটিই পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা, অদৃশ্য এবং অবিভাজ্য। এরপর তাকে আর ভাঙা যাবে না, এটাই ‘দ্য আলটিমেট বিল্ডিং ব্লক অব ম্যাটার!’ অত দিন আগে যখন তিনি পরমাণুর কথা বলেছিলেন তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন—বহুকাল স্তিমিত থাকার পর সেই ধারণাটিই আবার ফিরে আসবে, উত্তর জোগাবে অনেক অজানা প্রশ্নের? মনে হয় না। কিন্তু তিনি কি হঠাৎ করেই এই ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন? না, তা নয়।

তাঁর প্রায় ২০০ বছর আগে আরেক দার্শনিক—থ্যালেস তাঁর নাম—খুঁজছিলেন একটি প্রশ্নের উত্তর—এই জগৎ কী দিয়ে তৈরি এবং কীভাবে সেটি কাজ করে? এই প্রশ্ন থেকেই পদার্থের মৌলিক উপাদান খোঁজার যাত্রা শুরু হয়েছিল। থ্যালেস হয়তো প্রকৃতির নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভেবেছিলেন, দেখেছিলেন—জগত্জুড়ে জন্ম-মৃত্যুর খেলা, সৃষ্টি-ধ্বংসের খেলা। মানুষ জন্ম নেয়, ছোট থেকে বড় হয়, একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একসময় তার সাধের দেহটি মিশে যায় মাটির সঙ্গে। ফুল ফোটে আবার ঝরেও যায়। প্রাণিজগৎ আর বৃক্ষজগতেও একই ঘটনা। তাহলে কি এমন কিছুই নেই, যা স্থায়ী; যাকে এই জগতের পরিচয়চিহ্ন হিসেবে ভাবা যায়, যা কোনো অবস্থাতেই ধ্বংস হয়ে যায় না? তিনি ভেবে ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে পানিই হচ্ছে সেই মৌলিক উপাদান, যার ধ্বংস নেই।

কেন তিনি এমনটি ভেবেছিলেন, বোঝা মুশকিল। হয়তো নানা কারণ ছিল। প্রাণী ও বৃক্ষের জীবনধারণের জন্য পানি এক অপরিহার্য উপাদান, আবার বস্তু যে রূপেই থাকুক না কেন যথেষ্ট পরিমাণ তাপ দিলে তা থেকে পানিই বেরিয়ে আসে; এমনকি পানি একই সঙ্গে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় রূপে থাকতে পারে এবং যেহেতু পানির বিবিধ রূপ আছে, হয়তো পানি থেকে মাটিরও সৃষ্টি হতে পারে। থ্যালেস কিছুটা ভাববাদী ছিলেন বোধ হয়। তিনি ভাবতেন এই জগত্টা পানির ওপর ভাসছে, ভাবতেন—চুম্বকের আত্মা আছে বলেই সে আকর্ষণ করতে পারে ইত্যাদি। যাহোক, থ্যালেসের এ প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে স্বয়ং প্রশ্নটিই ছিল দারুণ জরুরি। প্রশ্ন ছাড়া তো আর অনুসন্ধান হয় না! কিন্তু তাঁর সময়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০ সালের দিকে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা মিলে একটা মতৈক্যে পৌঁছান যে এই জগৎ কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কিত সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-তত্ত্বই হবে যুক্তিনির্ভর, অতীন্দ্রিয়ের ওপর ভরসা করলে চলবে না। সত্যি কথা বলতে কি, এই ঘোষণাটিই বিজ্ঞানের জন্ম দেয়। কারণ, বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে থাকে যুক্তির ওপর, অন্য কিছুতে তার আগ্রহ নেই। থ্যালেসের সমসাময়িককালে জগতের মৌলিক উপাদান নিয়ে আরও কিছু মতামত এসেছিল, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ পরিসর দরকার হবে, এই লেখায় সেদিকে আর যাচ্ছি না।

এই যে আলোচনা, তারই ধারাবাহিকতায় ডেমোক্রিটাসের ধারণাটি প্রবর্তিত হয়। তিনি ভাবছিলেন, কোনো বস্তুকে যদি টুকরো টুকরো করে কাটতে থাকি, তাহলে কত দূর পর্যন্ত কাটা যাবে? নিশ্চয়ই এমন একটি সময় আসবে যখন জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছুরি দিয়েও আর কাটা যাবে না ওটাকে, মানে ওটাই তার শেষ স্তর। সেই শেষ সীমাকে তিনি বললেন অ্যাটম, বস্তুর অবিভাজ্য মৌলিক উপাদান। তাঁর কল্পনাপ্রতিভা যে অসামান্য ছিল তা তো বোঝাই যায়, নইলে কেউ কি এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর এই ধারণাটি প্রায় পরিত্যক্ত হয় প্রধানত অ্যারিস্টটলের কারণে। ডেমোক্রিটাসের পরমাণুর ধারণাটি অ্যারিস্টটল গ্রহণ তো করেনইনি, বরং হাস্যকর হিসেবে গণ্য করে একে পরিত্যাগ করেন। এবং যেহেতু তিনি প্রভাববিস্তারি দার্শনিক ছিলেন তাই পরমাণুতত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন আর চর্চাই হয়নি।

এরপর দুই হাজার বছরের বিরতি! উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ রসায়নবিদ জন ডাল্টন আবার ধারণাটিকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে প্রতিটি পদার্থেরই কোনো মৌলিক উপাদান আছে। পরমাণুর ধারণা ফিরে এলেও ডাল্টন এর গঠন সম্পর্কে আর কিছু ভাবেননি। সেটি নিয়ে প্রথম কথা বলেন আরেক ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যার জোসেফ জন টমসন। ১৮৯৭ সালে তিনি প্রথম পারমাণবিক কণা হিসেবে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। টমসন জানতে পেরেছিলেন, ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধানবাহী কণা, কিন্তু সব বস্তুই আধান-নিরপেক্ষ। এই ধারণা থেকেই তিনি একটা পরমাণু-মডেল উত্থাপন করেন, অনেকটা এ রকম, ‘একটা পরমাণু মূলত ধনাত্মক আধান দিয়ে তৈরি, যেখানে ইলেকট্রনগুলো পুঁতে রাখা আছে।’ অনেকটা কেকের ভেতর কিশমিশ পুঁতে রাখার মতো ব্যাপার। কেকটা ধনাত্মক আধানের, কিশমিশগুলো ঋণাত্মক আধানবাহী ইলেকট্রন বা ধানখেতে ধানের চারা পুঁতে রাখার মতো ব্যাপার। খেতটা ধনাত্মক, চারাগুলো ঋণাত্মক ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের এই আবিষ্কারই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দরজা খুলে দেয়।

টমসনের পর, ১৯১১ সালে পরমাণুর গঠন বোঝার জন্য আর্নেস্ট রাদারফোর্ড চমৎকার একটি পরীক্ষা করেন। তিনি পরমাণুকে ভেঙে দেখতে চাইলেন—এর ভেতরে আর কী আছে! এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি আলফা রশ্মিকে ব্যবহার করলেন ‘বুলেট’ হিসেবে। আলফা কণা ধনাত্মক চার্জবাহী, আমরা এখন জানি এটা আসলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, তখন তা জানা ছিল না। এই রশ্মির দুটো বৈশিষ্ট্য মনে রাখতে হবে। এটি ধনাত্মক চার্জবাহী এবং এর গতিবেগ খুবই বেশি। রাদারফোর্ড রেডিয়ামকে আলফা রশ্মির উত্স হিসেবে ব্যবহার করলেন এবং সেই রশ্মিকে ছুড়ে মারার ব্যবস্থা করলেন একটা সোনার পাতের দিকে। পাতের পেছনে বসালেন একটা স্ক্রিন, যাতে সোনার পাতের ভেতর দিয়ে আসার ফলে আলফা রশ্মির পরিবর্তিত অবস্থাটা ‘দেখা’ যায়। তত দিনে যেহেতু থমসনের মডেল প্রতিষ্ঠিত, রাদারফোর্ড আশা করেছিলেন যে আলফা রশ্মি সোনার পাত ভেদ করে সোজা গিয়ে পড়বে স্ক্রিনের ওপর। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, অনেক রশ্মি পাত ভেদ করে গেলেও কিছু রশ্মি সোজা না গিয়ে বেঁকে গিয়েছে, আবার কোনো কোনোটি আদৌ ভেদ না করে সোজা ফেরত গেছে যে পথে সে এসেছিল সেই পথে। এই ফলাফল তাঁকে এতটাই বিস্মিত করেছিল যে তিনি বলেছিলেন—মাকড়সার জাল ভেবে পিস্তলের গুলি ছুড়ে মারার পর সেই গুলি যদি ফিরে এসে আমার গায়েই আঘাত করত, তবু আমি এতটা অবাক হতাম না। পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে পরমাণুর ভেতরে ধনাত্মক আধানগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই, থাকলে আলফা রশ্মির মতো শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন কণাকে তারা বাঁকিয়ে দিতে পারত না, কিংবা নিজ পথে ফেরত পাঠাতে পারত না। পরমাণুর জগৎ বোঝার জন্য আমাদের বাস্তব জগতের উদাহরণ খুব একটা কার্যকরী নয়, তবু একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা খানিকটা পরিষ্কার হবে।

মনে করুন, আপনারা ২০-২৫ জন বন্ধু মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, মানে সবাই যেভাবে আড্ডা দেয় আরকি। তখন হঠাৎ বাইরের থেকে একটা লোক খুব দ্রুতগতিতে দৌড়ে এসে আপনাদের আড্ডার ভেতর দিয়েই পার হয়ে যেতে পারে।

এবার ধরুন, আপনারা আর ওভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই, বরং সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, এখন যদি সেই বহিরাগত একই গতিতে দৌড়ে এসে আপনাদের ভেতর দিয়ে চলে যেতে চায়, পারবে? না, পারবে না। আপনাদের সম্মিলিত শক্তি তাকে ফিরিয়ে দেবে। ব্যাপারটা খানিকটা এ রকম। চার্জগুলো যদি এক জায়গায় ঘন হয়ে জড়ো হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সম্মিলিত শক্তি হবে অনেক। এবং যেহেতু তারা ধনাত্মক চার্জবাহী আবার আলফা কণাও ধনাত্মক চার্জবাহী, সে জন্য পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে তারা। ফলে আলফা রশ্মি যখন এদের কাছ দিয়ে যেতে চাইবে তখন বাঁকিয়ে দেবে, যখন ভেতর দিয়ে যেতে চাইবে তখন ফিরিয়ে দেবে, আর দূর দিয়ে যেতে চাইলে যেতে পারবে। অর্থাৎ, ধনাত্মক চার্জগুলো এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে, ইলেকট্রন রয়েছে একটু দূরে, মাঝখানের বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা, মানে শূন্যস্থান।

রাদারফোর্ড এই বিশ্বাস থেকে তাঁর মডেল উত্থাপন করলেন অনেকটা এভাবে, ‘প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে একটি ছোট্ট নিউক্লিয়াস, যার ভেতরে সব ধনাত্মক চার্জ এবং প্রায় সবটুকু ভর জড়ো হয়ে আছে, আর ইলেকট্রন কিছু দূর দিয়ে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা আসলে আমাদের সৌরজগতের মডেলের মতো। এই যে বলা হলো ইলেকট্রনগুলো কিছু দূর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই ‘কিছু দূর’টা আসলে কত দূর তা কি ধারণা করতে পারেন? তখন জানা ছিল না, কিন্তু এখন আমরা জানি—একটা পরমাণুর আকার তার নিউক্লিয়াসের আকারের চেয়ে প্রায় এক লাখ গুণ বড়। তার মানে, একটা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ যদি এক সেন্টিমিটার হয় তাহলে ওই পরমাণুর ব্যাসার্ধ হবে এক কিলোমিটার। অর্থাৎ ইলেকট্রনগুলো এক মিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্তাকার পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা এ রকম: পুরো পৃথিবীটাই যদি হয় একটা পরমাণু তাহলে তার নিউক্লিয়াসের আকার হবে একটা ফুটবল মাঠের মতো! নিউক্লিয়াস আর এই বৃত্তাকার পথের মাঝখানে কী আছে? ফাঁকা জায়গা, স্রেফ শূন্যস্থান। এই বিপুল শূন্যস্থানের কারণেই পরমাণুগুলো এত বড়, ফলে পরমাণু দিয়ে গঠিত বস্তুগুলোও এত বড় দেখায়।

যাহোক, আলফা রশ্মি আর সোনার পাতের এই পরীক্ষাটি করেই রাদারফোর্ড থেমে যাননি। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বোরন, ফ্লুরিন, সোডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেন ভেঙে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস বের করে আনেন। আমরা জানি, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে কেবল একটি মাত্র ধনাত্মক আধানবাহী কণা থাকে, সব সময় সেটাই পাচ্ছেন বলে তিনি এর নাম দেন প্রোটন। এটি একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ প্রথম; মানে এটাই প্রথম কণা, যা দিয়ে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছে। তিনি এও আবিষ্কার করেন যে, এই কণার ভর ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে ১৮৩৬ গুণ বেশি।

রাদারফোর্ডের এই মডেল নিঃসন্দেহে চমত্কার, কিন্তু একটা সমস্যাও দেখা দেয় এটিকে নিয়ে। ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎচৗম্বকীয় তত্ত্ব থেকে এটা আগে থেকেই জানা ছিল যে চার্জবাহী কণার যদি ত্বরণ থাকে তাহলে সে শক্তি বিকিরণ করবে। এই বিষয়টি পরীক্ষাগারে প্রমাণিতও ছিল। রাদারফোর্ডের মডেল অনুযায়ী ঋণাত্মক চার্জবাহী ইলেকট্রন যেহেতু নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং তার ত্বরণ আছে (ঘূর্ণনশীল যেকোনো বস্তুরই ত্বরণ থাকে)। আবার নিউক্লিয়াসে আছে ধনাত্মক চার্জ, ইলেকট্রন হলো ঋণাত্মক চার্জবাহী, ফলে তাদের ভেতরে একটা আকর্ষণ বলও কাজ করবে (যেহেতু বিপরীতধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে)। সে ক্ষেত্রে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনগুলো শক্তি বিকিরণ করে সর্পিল পথে নিউক্লিয়াসের ভেতরে গিয়ে পড়ার কথা এবং সেটি ঘটার কথা এক সেকেন্ডের কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে। আর তাই যদি হয়, তাহলে তো পরমাণুর অস্তিত্বই থাকে না! সে রকমটি তো হচ্ছে না! কারণটি কী? এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এলেন নিলস বোর নামক এক ড্যানিশ বিজ্ঞানী। অসামান্য প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী যে ধারণা দিলেন তা বিজ্ঞানের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচন করল। তিনি বললেন, চিরায়ত পদার্থবিদ্যার সূত্র সমভাবে (Equivalently) পরমাণুর জগতে বা কোয়ান্টাম জগতে খাটবে না। এর জন্য চাই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন সূত্র। পরমাণু মডেলের সমস্যা তিনি সমাধান করলেন দুটো ধারণার মাধ্যমে। প্রথমত, ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট কিছু কক্ষপথে (Orbit) ঘুরে বেড়াতে পারবে, যেকোনো জায়গা দিয়ে ঘুরতে পারবে না। এই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরার সময় তার নির্দিষ্ট শক্তি থাকবে, কিন্তু ত্বরণ থাকা সত্ত্বেও শক্তির বিকিরণ ঘটবে না।

দ্বিতীয়ত, শক্তির বিকিরণ তখনই ঘটবে যখন ইলেকট্রনগুলো উচ্চশক্তির কক্ষপথ থেকে নিম্নশক্তির কক্ষপথে লাফ দেবে। দুটো কক্ষপথে যেহেতু শক্তিস্তর আলাদা, এই লাফ দেওয়ার কারণে একটা শক্তির পার্থক্য ঘটে যাবে এবং সেই শক্তিটুকু বিদ্যুৎচৗম্বকীয় শক্তি হিসেবে বিকিরিত হবে। আবার ইলেকট্রন যদি নিম্নশক্তির কক্ষপথ থেকে উচ্চশক্তির কক্ষপথে লাফ দেয়, তাহলে পরমাণুটি শক্তি শোষণ করবে। তিনি হাইড্রোজেন পরমাণুর জন্য এই শক্তিস্তরের হিসাব করলেন, এক স্তর থেকে অন্য স্তরে লাফ দিলে কী পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসবে তারও হিসাব করলেন। হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালিগুলো ব্যাখ্যা করা হলো তার এই হিসাবনিকাশের মাধ্যমেই। তবে তাঁর মডেলের সীমাবদ্ধতা ছিল এটুকুই যে এটি দিয়ে হাইড্রোজেনের মতো সরল পরমাণুর বর্ণালি যত সহজে ব্যাখ্যা করা যায়, বড় পরমাণুর ক্ষেত্রে তা করা যায় না। এই সীমাবদ্ধতা দূর করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড। সে আলোচনা দীর্ঘ এবং অন্য কোনো দিন করা যাবে। পরমাণুর মডেলের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কারণ, এই আলোচনায় কখনোই নিউট্রনের প্রসঙ্গ আসেনি। নিউট্রন আবিষ্কৃত হয় ১৯৩২ সালে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইকের পরীক্ষায়, আর তখনই পরমাণু মডেল সম্পূর্ণতা পায়। অর্থাৎ নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন, আর ইলেকট্রনগুলো কিছু দূর দিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়। পরমাণুর মডেল নিয়ে, বিশেষ করে বর্ণালির প্রকৃতি ও ধরন-ধারণ ব্যাখ্যা করার জন্য, অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক তত্ত্ব এসেছে। তবে রাদারফোর্ড-বোরের মডেলটিই সাধারণভাবে সবার কাছে পরিচিত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

* লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত