পেনরোজের নোবেলপ্রাপ্তি ও বাঙালির দীর্ঘশ্বাস

নোবেলজয়ী রজার পেনরোজএএফপি

কৃষ্ণগহ্বর আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে যে সংশয় ছিল—এবারের নোবেল কমিটি স্যার রজার পেনরোজের ঝুলিতে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারটি দিয়ে তার অস্তিত্বকে তর্কের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেলেন। না, তিনি পুরস্কারের পুরোটাই উপভোগ করছেন না, তাঁর সঙ্গে আছেন আরও দুজন। তাঁরা হলেন আন্দ্রিয়া গেজ ও রাইনহার্ড গেনজেল। তাঁদের দুজনের অবদানকে খাটো না করেই বলতে চাই, তাত্ত্বিক হিসেবে আমার পক্ষে তাঁদের অবদানের পরিমাপ সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। সে জন্য আমি বরং রজার পেনরোজকে নিয়েই আলোচনা করি। তাঁর মাপের বিজ্ঞানী যদিও খুব বেশি জীবিত নেই, তবুও তাঁর নোবেল পাওয়াটা আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল।

প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার কে পাচ্ছেন তা নিয়ে আইপিএলের মতো জুয়াখেলা না হলেও, ২০১৯-২০ সালের মধ্যে সাড়া ফেলা যেসব বিষয় নিয়ে নোবেল জেতার ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছিল তার মধ্যে ছিল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের তোলা ছবি, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একচ্ছত্রতা (Supremacy) আর ডেনসিটি ফাংশনাল তত্ত্ব, যা বর্তমানে ন্যানোপদার্থ ডিজাইন করার প্রয়োজনীয় গণনার মূল ভিত্তি। এদিক থেকে বললে কৃষ্ণগহ্বরই এই প্রতিযোগিতায় জিতল। তবে এটা তো পিন্টারেস্টের জন্য ছবি তোলা নয়, সে জন্য কিসের ছবি তুলছি তা আগে সঠিকভাবে জেনে নেওয়া দরকার। সেখানেই স্যার রজারের কৃতিত্ব। ঠিক যেমন হিগস–বোসন আবিষ্কারের জন্য সবার আগে স্যার পিটার হিগসকে নোবেল পুরস্কার দিতে হয়, তেমনি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আধুনিক কালের আলোচনাটা রজার পেনরোজকেই ঘিরে। তাই তার নোবেলপ্রাপ্তিটাও ঠিক যেন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছি, রজার পেনরোজ সেখানে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে প্রায়ই আসতেন। সেখানে থাকাকালে তাঁকে দুবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। যে চার মাস তিনি সেখানে কাটিয়েছেন, পুরো সময়টাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় একটি সংস্করণ ওয়েভ বা তরঙ্গ ফাংশন প্রণয়নের ওপর নির্ভরশীল। এই সংস্করণে কোনো সিস্টেমের কিছু মাপার সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফাংশনটি ‘নাই’ হয়ে যায়। কেন এই ফাংশনটা ধ্বংস হয়, তার উত্তর কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গুদামে নেই। রজার পেনরোজের ধারণা, এই পুরো ঘটনায় মাধ্যাকর্ষণের একটা অদৃশ্য হাত আছে। তবে পেনরোজের এই ধারণার সঙ্গে একমত নন বেশির ভাগ পদার্থবিজ্ঞানী। তারপরও এই প্রশ্নের পেছনে পঞ্চাশ বছর ধরে একনিষ্ঠভাবে লেগে আছেন রজার পেনরোজ

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভাস্কর মিকেলাঞ্জেলো নিয়ে চালু একটা গল্প এ সুযোগে বলি। তিনি তখন তাঁর মাস্টারপিস ‘David’ ভাস্কর্য খোদাই করছিলেন। এ সময় তাঁর এক বন্ধু দীর্ঘদিনের বিদেশযাত্রা করার আগে দেখা করতে আসেন তাঁর স্টুডিওতে। বন্ধু প্রায় শেষ করা অবস্থায় শিল্পকর্মটি দেখতে পান। এরপর পাঁচ বছর চলে গেছে। সফর শেষে ওই বন্ধু আবারও দেখা করতে আসেন মিকেলাঞ্জেলোর সঙ্গে। দেখেন, মিকেলাঞ্জেলো মূর্তির ঠিক ওই একই জায়গায় ঠক ঠক করে হাতুড়ি–ছেনি চালাচ্ছেন।

‘এটা কি নতুন করে আবার বানাচ্ছ?’ বন্ধু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

মিকেলাঞ্জেলো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘ভালো করে তাকিয়ে দেখো, পায়ের পেশিতে ভাঁজ দেখা যাচ্ছে, চোখের পাপড়ি যোগ করেছি, আঙুলের ভাঁজগুলো সূক্ষ্ম করেছি...।’

রজার পেনরোজের কাজ এ রকমই। তাঁর প্রিয় একটা কোয়ান্টাম উপপাদ্যের ব্যাখ্যা তিন জায়গায় তিনভাবে শোনার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কোনোবারই তাঁকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস হয়নি আমার। এর পেছনে আমার গাণিতিক জ্ঞানের অপ্রতুলতাই বেশি দায়ী। বলে রাখি, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেও রজার পেনরোজের আদি পরিচয় গণিতবিদ হিসেবে। তাঁর প্রথমদিকের গবেষণাগুলো অ্যালজেব্রীয় জ্যামিতিতে করা। তাঁর বাবা ছিলেন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী লিয়োনেল পেনরোজ। তাঁরা দুজনে মিল পেনরোজ ট্রায়াঙ্গলের (Penrose Triangle) ধারণা প্রণয়নের জন্য পরিচিত ছিলেন।

পেনরোজ তাঁর ডক্টরেট করার পর ডেনিস শিয়ামা'র সঙ্গে কাজ করতে আসেন। সেখানে তাঁর জানা গণিতের নতুন কৌশলগুলো আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে প্রয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। তাঁর কৌশলগুলোর সঙ্গে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা আদৌ পরিচিত ছিলেন না। সে জন্য পেনরোজের বের করা ফলাফল বুঝতে তাঁদের বেগ পেতে হচ্ছিল। আধুনিক গণিত নিয়ে আমরা পদার্থবিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে হাসাহাসি করি যে, ১২ কে ৩ দিয়ে ভাগ করলে কত হয়? সেটার উত্তর বের করার চেয়ে গণিতবিদদের কাছে আরো জরুরি প্রশ্ন হলো, এটার উত্তর আদৌ আছে কি? আর থাকলে সেটার উত্তর কতগুলো?

এ রকম একটা সমস্যা ১৯৫০-এর দশকে নাকানি–চুবানি খাওয়াচ্ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের। ১৯১৬ সালেই আইনস্টাইনের সবচেয়ে প্রতিসাম্যিক অবস্থায় সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণ সমাধান করেছিলেন কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। কিন্তু গণিতের বাইরে তাঁর এই সমাধানের মানে কী, তা পরিষ্কার ছিল না । ১৯৩০ সালের দিকে শ্বেতবামন তারার ধারণা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের মনে আসন করে নিলে মার্কিন পারমাণবিক বোমার জনক বলে খ্যাত রবার্ট ওপেনহাইমার ও তাঁর ছাত্র হার্টল্যান্ড স্নাইডারের কাজের কারণে ব্ল্যাকহোলের ধারণাটি ছড়াতে থাকে। তবে অনেকেই নিশ্চিত নয় ব্ল্যাকহোল শব্দটি পরিহার করে Collapsed star বা চুপসানো নক্ষত্র শব্দটি ব্যবহার করতেন। কারণ, সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর ও জন হুইলারের গবেষণার ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের অন্তিম অবস্থা হিসেবে শ্বেতবামন অথবা নিউট্রন তারা (Neutron Star) সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন।

কিন্তু নিউট্রন নক্ষত্র তৈরি হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ যে ভর থাকতে পারে, তার চেয়ে বেশি ভরের নক্ষত্রের অন্তিম অবস্থা হিসেবে শোয়ার্জশিল্ডের সমাধান যে সঠিক সেটার পেছনে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ ছিল। এর পেছনে ছিল শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানের সব দিকের প্রতিসাম্যিক অবস্থার প্রয়োজনীয়তা। তার মানে, যে নক্ষত্রকে কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে দেখতে চাইব, সেটাকে একদম গোলাকার হতে হবে। কিন্তু আসলে এ রকম নক্ষত্র পাওয়া মুশকিল। সেটা ঘুরতে থাকে, তার চারপাশে গ্যাসের সমাহার থাকতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।

অন্যদিকে, সোভিয়েত রাশিয়ায় লেভ লান্ডাউয়ের ছাত্ররা বিশেষ করে খালাৎনিকভ (Khalatnikov) প্রমাণ করতে চাইছিলেন, নক্ষত্রের মধ্যের গ্যাসের গতি যদি কেন্দ্র থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হয়, তবে নক্ষত্র চুপসে যাওয়ার পর কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে না। এই দুই বিপরীতমুখী চিন্তাধারার মধ্যে বিজ্ঞানীরা দোলাচলে ছিলেন। পেনরোজ সোজা ক্রিকেটের দুসরা বল করার মতো পুরো ভিন্ন দিকে প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে দিলেন। এখনকার পরিভাষায় আমরা এটাকে সাধারণ আপেক্ষিকতায় গ্লোবাল টেকনিক ও টপোলজির (Topology) ব্যবহার বলি।

অমলকুমার রায় চৌধুরী
প্রথম আলো আর্কাইভ

আমরা আইনস্টাইনের কল্যাণে জানি, পদার্থ বা শক্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলো তার দিকে পরিবর্তন করে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পদার্থ বা শক্তিকে আমরা লেন্স হিসেবে চিন্তা করতে পারি। এই লেন্সের ধর্ম ঠিক কী হবে, তার একটা সমীকরণ বাঙালি বিজ্ঞানী অমল কুমার রায়চৌধুরী দিয়েছিলেন। একে আমরা রায়চৌধুরী সমীকরণ (Raychaudhuri equation) বলে অভিহিত করি। অবশ্য অমল রায়চৌধুরী এই সমীকরণ প্রণয়ন করেছিলেন কসমোলজি প্রসঙ্গে। কিন্তু এটা বলতে গেলে, একটা সর্বজনীন সমীকরণ। এটা ব্যবহার করেই পেনরোজ দেখালেন যে খালাৎনিকভরা কৃষ্ণগহ্বরের যে চিত্র আঁকতে চাইছিলেন, তা আদতে টেকে না। তার মানে কৃষ্ণগহ্বর থাকতে হলে শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য নয়।

এরপরের ইতিহাস লম্বা। কিন্তু খুবই সংক্ষেপে বললে, খালাৎনিকভরা তাঁদের একই যুক্তিতে বিগব্যাং মডেলের শুরুর মহাবিশ্বের বিন্দুসম অবস্থাকে অযৌক্তিক বলে প্রতীয়মান করতে চাইছিলেন। কিন্তু পেনরোজ ও হকিং একই কৌশলে দেখালেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতার চিরায়ত সংস্করণে বিগব্যাং এড়ানো সম্ভব নয়। এই কাজ থেকেই হকিংয়ের পরবর্তী উত্থান। কিন্তু সেটা আরেক গল্প। তবে হকিং আজ বেঁচে থাকলে তিনিও যে এই পুরস্কারের অংশীদার হতেন সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

শেষ করি, বাংলাদেশের সাথে পেনরোজের যোগসূত্র দিয়ে। এদেশে বিশুদ্ধ গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ আপেক্ষিকতা চর্চা আগে ছিল না। কিন্তু প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে RCMPS (Research Center for Mathematical and Physical Sciences) চালু করেন। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে তাঁর নামও জুড়ে আছে। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সে সময় রজার পেনরোজকে ওই গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানমালায় আনতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের ইমেরিটাস অধ্যাপক নিযুক্তির জন্য স্যার রজার পেনরোজ সুপারিশপত্রও লিখেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে বিষয়ের উপর কাজ করে পেনরোজের নোবেলপ্রাপ্তি, জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের প্রয়াণের সাথেই বাংলাদেশে এই চর্চার একরকম পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

আমরা হকিং আর পেনরোজের লেখা জনপ্রিয় বিজ্ঞানের ধারা, যাকে আমরা পপ-সায়েন্স বলি, নিয়ে যতটা মাতামাতি করি তার কানাকড়িও নিয়ে তাদের আসল কাজগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না। মনে রাখতে হবে, পেনরোজ কিন্তু তাঁর Emperor’s New Mind লেখার জন্য পুরস্কার পাননি। এটা অনস্বীকার্য যে, পেনরোজের কাজ একদিনে নাজিল হয়নি। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের বিশুদ্ধ জ্ঞানের যে দীর্ঘকালীন চর্চা তার পরিণতিই পেনরোজের ও তাঁর সহকর্মীদের অর্জন।

ভারতে স্বাধীনতা আসার আগে থেকেই এই চর্চাটা শুরু হয়েছিলো। বৈশ্বিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দৌড়ে শামিল হওয়ার পরও ভারতে মৌলিক জ্ঞানের উপর গবেষণায় কোনো ভাটা পড়েনি। আমাদের স্যারদের কাছে শুনেছি, স্বাধীনতার আগে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এগিয়ে ছিলো। কিন্তু গত অর্ধ শতাব্দীতে মৌলিক ও বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় আমরা সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি। এমনকি আণবিক শক্তি কমিশনেও বিগত ৩৫ বৎসর ধরে এই তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত ডিভিশনটির বিলুপ্তি ঘটেছে-যদিও বিদেশের প্রতিটি আণবিক কমিশন বা তার সমতুল্য প্রতিষ্ঠানে এরকম বিভাগের উপস্থিতি অতি সাধারণ ঘটনা। গাণিতিক ও তাত্ত্বিক তথা মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার এই ধারাটি না ফেরাতে পারলে বৈশ্বিক জ্ঞানের দৌড়ে আমরা আরো পিছিয়ে পড়তে থাকবো। সেইসাথে ফিবছর পেনরোজের মতো অন্যান্যদের নোবেলপ্রাপ্তিতে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের দায়িত্ব পালন করবো।

লেখক: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, ইনডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়