বিজ্ঞান অভিযাত্রা ১৯৬৫- ২য় পর্ব

চিত্র ১. অভিযাত্রার তিরচিহ্নিত যাত্রাপথ (বান্দরবান থেকে রিংখিয়াং লেইক বার্মা বর্ডার)সংগৃহীত

বার্ড স্টাফিং

মৃত পাখিটিকে সযতনে বুকের দিক কাঁচি দিয়ে কেটে পাখা ও পায়ের বাইরের অংশটুকু বাদ দিয়ে পুরো মাংসল অংশটুকু বের করে আনতে হয়। এখানে পাখির চামড়ায় লেগে থাকা মাংস ও রক্তে যাতে সংক্রমণ না হয়, এর জন্য সায়ানাইড যৌগ ও আটা মাখিয়ে ভেতরের মাপমতো লোহার তারে তুলা পেঁচিয়ে জায়গাটা ভরে দিতে হয়। মোটামুটি জীবন্ত পাখিটির আকার-আকৃতির কাছাকাছি হলে সুই-সুতায় তা সেলাই করে ফেলতে হয়। পাখায় রক্ত বা ময়লার দাগ লেগে থাকলে তা তুলায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড লাগিয়ে মুছে ফেলতে হয়। এ পর্যায়ে ‘স্টাফড’ পাখিটিকে রোদে দিলে ভালো হয়। এভাবে পাখিকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। ছোট ও মাঝারি পাখির স্টাফিং তেমন অসুবিধা হয়নি। তবে বড় পাখি বা অন্য কোনো জন্তু-জানোয়ার হলে এদের হাড় বড় ও শক্ত বলে তা গুছিয়ে আনতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

পাহাড় ডিঙিয়ে দুর্গম পথ ভাঙতে ভাঙতে স্যাররা মাঝেমধ্যেই থামছেন। জাকির স্যার দুরবিন ধরে ওপরের দিকে দেখছেন পাখি। নোট করছেন। কখনো বা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে সংগ্রহ করছেন পাখির মিষ্টি মধুর গান। সালার খান ছালার ব্যাগে তুলে রাখছেন বিরল সব ফুল-পাতা, গাছগাছালি। লাইনল ও পোহাই পাড়ায় পৌঁছে রাত কাটিয়ে আমরা ১৯ জানুয়ারি বিকেল চারটার দিকে রিংখিয়াং লেক এলাকায় পৌঁছে যাই। (চিত্র ১) এটাই ছিল আমাদের পূর্বনির্ধারিত টার্গেট লেক। তাই এখানেই আমরা ক্যাম্প গেড়ে বসি এবং চার দিনের বেশি সময় থাকি। এখানকার Fauna-flora, লেকের ও বনজঙ্গলের নানা দিক পর্যবেক্ষণই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। লেকের ওপারে বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) সীমান্ত।

চিত্র ২. একটি টিপরা ছেলে। এদের লম্বা চুল পেছনে বেঁধে রাখে
সংগৃহীত

অভিযাত্রা ১৯৬৫-এর অর্জন

১. শতাধিক সংগ্রহের মধ্য থেকে ৭০ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া আরও ২০টি প্রজাতি দেখা-শনাক্ত (Sight record) করার মধ্যে আমাদের মোট পাখির প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০টি। এর মধ্যে ছয়টি প্রজাতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হয়। সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আমাদের সংগৃহীত পাখিগুলো ভারতীয়, হিমাচল চৈনিক ও মালয়েশীয় কিংবা মিশ্র জাতের। ২. আমরা প্রায় ১৫০টি প্রজাতির গাছ সংগ্রহ করি। এর মধ্যে ১০টি প্রজাতি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে রেকর্ড করা হয়। ৩. এ ছাড়া আমরা কিছু প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী সংগ্রহ করি। ৪. কিছু জলজ উদ্ভিদের নমুনা ও সেমাইটেডে সংগ্রহ করি। পরিশেষে রুমা বাজার থেকে বার্মা বর্ডার পর্যন্ত উপজাতীয় গোত্রগুলোর একটা তালিকাও আমরা তৈরি করি। এর মধ্যে চাকমা, ব্যোম, মগ, টিপরা, মুরং উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলে টিপরা ও মুরংরা প্রাচীনতম বলে জানা যায়।

২৪ জানুয়ারি আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ গবেষণা ও সংগ্রহ শেষে ফেরার প্রস্তুতি নিই। ২৫ তারিখ চাকমা পাড়ায় রাত কাটিয়ে প্রাণসা পাড়ায় পৌঁছে যাই এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে এক দিন থেকে ফিরতি পথে রুমা বাজারের আস্তানা গাড়ি। রুমা বাজার থেকে বান্দরবান পৌঁছি ২৯ জানুয়ারি। এরপর বান্দরবান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ৩১ জানুয়ারি সকালে ঢাকায় ফিরে আসি।

এই বিজ্ঞান অভিযাত্রায় আমাদের সংগৃহীত ও শনাক্ত করা কিছু জনপ্রিয় পাখির প্রজাতির পরিচিতি এখানে দেওয়া গেল: ১. লাল জংলি মোরগ ২. লম্বা লেজবিশিষ্ট কালো বক কালিজ পাখি ৩. বড় চ্যাপ্টা মাথাওয়ালা কাঠঠোকরা ৪. সাধারণ আইয়োরা। অন্যদিকে পাহাড়ের এক টিলা থেকে আমরা বিশাল এক হর্নবিল পাখিকে উড়ে যেতে দেখেছি। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম পাখি সদস্যের একটি।

চিত্র ৩. রিংখিয়াং লেক (ওপর থেকে তোলা ছবি)
সংগৃহীত

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের (১৯৬৫-২০১৭) এই বিজ্ঞান অভিযাত্রার অর্জনের দিকে যদি ফিরে তাকাই তখন মনে হয়, জীববিজ্ঞানী হিসেবে সেই যে অভিজ্ঞতাও বাস্তব জ্ঞান আমার হয়েছিল, তা আজও আমাকে উত্সাহিত করে। আমাকে আকর্ষণ করে বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে এবং আরও আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রতিবারই আমি বনজঙ্গলে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। পেয়েছি নতুন চিন্তার খোরাক। এখানে একটা গ্রাম্য বচন স্মরণ করা যায়: জঙ্গলই মঙ্গল। আসলেও তাই। আমাদের পৃথিবীতে কত অজানা যে রয়েছে, এর কি শেষ আছে? কদিন আগে আমাজানের গহিন বনভূমিতে দেখা গেছে এক প্রাচীন মানবগোষ্ঠী, যা এর আগে কেউ কোনো দিন দেখেনি। আজকের এই উন্নততর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে কি তা সম্ভব? উত্তর ইতিবাচক। সুতরাং আমাদের সময়-সুযোগ হলেই যেতে হবে গ্রামে, বনজঙ্গলে, খালবিল, নদীনালায়। অচেনাকে দেখা, অজানাকে জানা বিজ্ঞানচর্চার অতি প্রয়োজনীয় এক অধ্যায়। সেখানে রয়েছে বিজ্ঞান ধাঁধার অনেক সমাধানও।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত