বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণের সন্ধানে প্লেটো

শিল্পীর কল্পনায় প্রায় ৩৪ টি টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা নিয়ে মহাকাশে নভোযান প্লেটো

২০১৬ সালের হঠাৎ একদিন। রাতে এক বন্ধুর ফোন। বন্ধুটি থাকে আমেরিকা। অন্য প্রান্ত থেকে বন্ধুটি কথা প্রসঙ্গে বেশ উত্তেজিতভাবে বলছিল, জানিস, এথেন্স থেকে জন হোয়েলারের এক বন্ধু কী অভিজ্ঞতা বয়ে এনেছিল? বলে নিই, জন হোয়েলার ছিলেন বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও কসমোলজিস্ট। তিনি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর ব্যাপক কাজ করেছেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোরের সঙ্গে নিউক্লিয়ার ফিশনের মৌলিক নীতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভবিষ্যদ্বাণী করা কৃষ্ণবিবর নিয়েও অনেক গবেষণা করেছেন। গবেষণা করেছেন কোয়ান্টাম ফোম, ওয়ার্মহোল। ওয়ান ইলেকট্রন ইউনিভার্স প্রকল্পের জন্য তিনি পরিচিত। যাহোক, বন্ধুটি হোয়েলারের জন্য এথেন্সের প্লেটোর একাডেমি থেকে আনা অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছিলেন। একটা পাথরও দিয়েছিলেন হোয়েলারকে। একাডেমির সামনে যে বাগান ছিল, যেখান দিয়ে অ্যারিস্টটল ও প্লেটো প্রায়ই হেঁটে বেড়াতেন আর আলাপ করতেন, সেখান দিয়ে হোয়েলারের বন্ধুটিও হেঁটেছেন।

পরে ওই বন্ধু যখনই তাঁর কাছে আসতেন, তখন দেখতেন হোয়েলার ওই কথাই ভাবছেন। ভাবছেন, এথেন্সের একাডেমির বাগানে সেই পাথরগুলোতে তাঁদের আলোচনার কোনো রেকর্ড প্রাকৃতিকভাবে বিধৃত নেই। প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের সব কথাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি আমাদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই রাখেনি? একদিন বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি সব সময়ই বিষয়টা নিয়ে এতটা ভাবছ কেন?’ হোয়েলার বললেন, ‘আমি ভাবতেই পারি না, একাডেমির বাগানে সেই আলাপের কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার মনে হয়, কোনো না কোনোভাবে তাঁদের আলাপের অডিও আছে। প্রকৃতি ভাবীকালের জন্য কিছুই রক্ষা করেনি, এটা আমি ভাবতেই পারি না। যখনই তাকাই দেখি, এথেন্সের সেই বাগানে প্লেটো আর অ্যারিস্টটল আলোচনা করতে করতে হেঁটে যাচ্ছেন।

আমার টেলিফোনে বন্ধুর এ কথাগুলো শুনে পৃথিবীটাকে ঘোরের মতো লাগছিল। আসলে কী কথা হচ্ছিল প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মধ্যে? তাঁদের আলোচনায় কি সক্রেটিস ছিলেন? সক্রেটিস বিষপান (হেমলক) করে কি ন্যায়বিচারের ব্যাপারে অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন? ২৩ শ বছরে মানবজাতি কি নতুন কোনো অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছিল? সমুদ্রজলের গর্জনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। অনুভব করছিলাম মানবজাতির ৪০ হাজার প্রজন্মের চলে যাওয়া স্রোত।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গভীরে দৃষ্টি দিলেও শুনতে পাব সেই শব্দ, দেখতে পাব ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র আর তাদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে সম্ভাবনাময় অনেক গ্রহ, বিজ্ঞানীরা অন্তত তা-ই বলেন। বহু দূরের এসব গ্রহ বা ‘এক্সোপ্লানেট’ সম্পর্কে তাত্ক্ষণিক খুব বেশি তথ্য পাওয়া কঠিন। তাঁদের আলোকচ্ছটা বিশ্লেষণ করে খুব বেশি হলে গ্রহের উপাদান সম্পর্কে জানা যায়। এসব দূরের গ্রহ সন্ধানের উদ্যোগ আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা নতুন এক অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। এই অভিযানে সৌরজগত্ সম্পর্কেও নতুন দিগন্ত উন্মোচনেও জোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রায় ৩৪টি টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা নিয়ে মহাকাশের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে মহাকাশযান প্লেটো। প্লেটো ছয় বছর ধরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গভীরের রহস্য উন্মোচন করবে। এ অভিযানের জন্য ধার্য করা হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি ইউরো। আর জার্মানির অ্যারোস্পেস সেন্টার ‘ডিএলআর’ থাকবে অভিযানের মূল দায়িত্বে। শুধু পৃথিবীর মতো গ্রহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ নয়, ‘প্লেটো’ আমাদের সৌরজগতের সঙ্গে অন্যান্য নক্ষত্রব্যবস্থার গঠনেরও তুলনা করবে। অবশ্য এ অভিযান শুরু হতে এখনো আট বছরের প্রস্তুতি বাকি রয়েছে।

প্লানেটারি ট্রানজিটস অ্যান্ড অসিলেশন অব স্টারসের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ প্লেটো। একঝাঁক ফটোমিটার ব্যবহার করে প্লেটো গ্রহ নড়াচড়াকে ধরতে পারবে, সূর্যের মতো লাল বামন, হলুদ বামন এবং সাবজায়ান্ট নক্ষত্রের চারদিকে সব আকারের পানির অস্তিত্ব বিরাজমান পাথুরে বহির্জাগতিক গ্রহগুলোকে বুঝতে পারবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে নাক্ষত্রিক কম্পাঙ্ক, নাক্ষত্রিক ভর ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা। প্লেটো নামটি শুধু প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত রূপই নয়, প্লেটো (৪২৮-৩৪৮) গ্রিসের ধ্রুপদি সময়ের দার্শনিকের নামও আগে যার কথা বলেছি। যাঁর শিক্ষক ছিলেন মহান সক্রেটিস আর ছাত্র ছিলেন অ্যারিস্টটল। গড়ে তুলেছিলেন একাডেমি (একাডেমিয়া) নামের প্রতিষ্ঠান; যা ছিল মুক্তচিন্তার পথ নির্দেশনাকারী একটি পথ, একটি প্রতিষ্ঠান। সেই চিন্তাধারা থেকে কি প্রতিষ্ঠানগুলো সরে গেছে, শুধু সার্টিফিকেট বিকিকিনির জায়গায় পরিণত হয়েছে? না হলে এত অসহিষ্ণুতা কেন, এত সংকীর্ণতা কেন? একটি চিন্তাধারা আরেকটি চিন্তাধারাকে সহ্য করতে পারছে না কেন?

পিথাগোরাসীয় আর সক্রেটিসীয় ধারা নিয়ে জীবনকে প্রবাহিত করেছিলেন প্লেটো। খুঁজেছিলেন গ্রহের কক্ষপথের ভৌত নিয়ম। দার্শনিকের হূদয়কে সন্তুষ্ট করার জন্য জগতের ঐক্য ও নিয়মানুবর্তিতার সন্ধান করছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, গণিত সম্পর্কে কোনো অজ্ঞ ব্যক্তি যেন তাঁর একাডেমির দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে।

২০২৪ সালে প্লেটো অবজারভেটরি মহাকাশে তার যাত্রা শুরু করবে এবং মহাকাশ থেকেই গ্রহের অনুসন্ধান চালাবে। শুধু পৃথিবীর মতো গ্রহ নয়। প্লেটো অনুসন্ধান করবে ১০ লাখ নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তিত গ্রহগুলোকে। স্পষ্ট করবে গ্রহগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া ও জীবনের উদ্ভব। উদ্দেশ্যগুলো সুসম্পন্ন করার জন্য মিশনটি দীর্ঘ প্রস্তুতির মধ্যে আছে।

দার্শনিক প্লেটোর গড়া একাডেমি

পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে L2 ল্যাগরাঞ্জিয়ান পয়েন্ট থেকে পর্যবেক্ষণ চালাবে প্লেটো। সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ থেকে দূরের এই অবস্থানের সুবিধা হলো, সেখান থেকে সারা বছর মহাকাশের গভীরে নজর রাখা যাবে। ‘প্লেটো’র মধ্যে থাকবে ৩৪টি ছোট টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা। তাদের মূল কাজ হবে পৃথিবীর মতো গ্রহগুলোকে আরও খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো এমন একটি গ্রহের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ৬০০টি বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদিকে ফেব্রুয়ারিতে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে নাসার স্পিটজার মহাকাশ টেলিস্কোপ একটি নক্ষত্রকে ঘিরে সাতটি পৃথিবীর আকৃতির গ্রহের সন্ধানের কথা বলেছে। এগুলোর তিনটি প্রাণ উপযোগী মণ্ডলেই অবস্থান করছে। এগুলো প্রাণের মহাজাগতিক বাস্তবতার কথাই জোরালো করছে।

সত্যি যদি পৃথিবীর মতো গ্রহের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে পৃথিবীর মতো কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কিছুর সন্ধান মিলবে। যদি মেলে তাদের দার্শনিক ভাবধারার গতি-প্রকৃতি কী হবে তা উন্মোচন করাও প্লেটো নামের কারণে অধিক গুরুত্ব পাবে।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত