ভূতত্ত্বের প্রথম পাঠ

কেন ভূমিকম্প হয়, কেন সৃষ্টি হয় আগ্নেয়গিরি? পৃথিবী সমতলই বা নয় কেন? পৃথিবীর মহাদেশগুলো এখন যে রকম দেখতে, চিরকালই কি এ রকম ছিল? পৃথিবীর বুকে যে অসংখ্য ভূতাত্ত্বিক-প্রক্রিয়া ঘটেছে, এখনো ঘটছে, এসবের জন্য রয়েছে কতশত তত্ত্ব। তবে একটা সাধারণ তত্ত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভূত্বকের প্রায় সব ব্যাখ্যা। সেটা থিওরি অব প্লেট টেকটনিক বা প্লেট টেকটনিক তত্ত্ব।

আলফ্রেড ওয়েগেনার। একজন দুর্ভাগা বিজ্ঞানী। তিনিই টেকটনিক তত্ত্বের প্রবক্তা। কন্টিনেন্টাল ড্রিফট অনুকল্পের মাধ্যমে এই তত্ত্বের জন্ম। আলফ্রেড বিজ্ঞান ইতিহাসের বৈপ্লবিক এ আবিষ্কার করেও স্বীকৃতি পাননি। তাঁর অনুকল্প অত্যন্ত যৌক্তিক এবং বেশ কিছু জটিল সমস্যার সমাধানে সক্ষম। তবু ভূতাত্ত্বিক মহলে পাগল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কারণ, তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে মহাদেশগুলো যে রকমভাবে আছে, অতীতে সে রকম ছিল না। বরং সব মহাদেশ একত্রে একটিমাত্র ভূখণ্ড ছিল। পরে সেগুলো নানা উত্থান-পতন, প্রাকৃতিক ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে আজকের অবস্থায় এসেছে মহাদেশগুলো।

ওয়েগেনারের যুক্তিতে খাদ ছিল না। তবু এই অনুকল্পের স্বীকৃতি দেননি ভূতাত্ত্বিকেরা। এত জমাট মহাদেশীয় ভূখণ্ড ভূপৃষ্ঠে সঞ্চরণশীল হয় কীভাবে, এত বিশাল শক্তিই বা আসে কোত্থেকে?—এই প্রশ্ন ছিল বিজ্ঞানীদের। পরে অবশ্য সমুদ্রতলের প্রসারণ, অর্থাৎ সি-ফ্লোর স্প্রেডিং তত্ত্বের মাধ্যমে এ ব্যাপারটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

ওয়েগেনারের যুক্তিটা কী, দেখে নেওয়া যাক। তিনি বলেছিলেন, এই যে মহাদেশগুলো একটি জিগ’শ পাজলের খণ্ডে প্রায় শতভাগ খাপে খাপে এঁটে যায়, এই ব্যাপারটি কাকতালীয় হতে পারে না। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাশে স্থল অঞ্চলে শিলাস্তর প্রকৃতি এক কেন? এদের বয়সও সমান। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার এপ্পালশিয়ান পর্বতমালার শিলাস্তর যে রকম, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, গ্রিনল্যান্ডের পর্বতমালার শিলাস্তরও একই রকম। কেন? তাহলে নিশ্চয়ই পর্বতমালা সৃষ্টির সময়ে এরা একত্রে ছিল। পরে এরা পৃথক হয়ে গেছে। ফসিল বা জীবাশ্মের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা যায়। কিছু কিছু জীবাশ্ম সমুদ্রের দুই প্রান্তেই পাওয়া যায়। জীবিত প্রাণী মরে গিয়ে মৃতদেহ অগ্ন্যুত্পাত বা বিভিন্ন ভৌগোলিক কারণে পাথরে পরিণত হয়। এই বিশেষ ফসিলগুলো যেসব প্রাণীর, তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে যাওয়া অসম্ভব ছিল। সে জন্য বলা যায় যে ওই প্রজাতিগুলোর বিচরণকালে ভূখণ্ডগুলো সব একত্রে ছিল। এসব ঘটনার ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সফল ছিল ওয়েগেনারের যুক্তি। কিন্তু সেকালের ভূবিজ্ঞানীরা সেটা বুঝে উঠতে পারেননি।

চৌম্বকীয় অস্বাভাবিকতা (ম্যাগনেটিক এনোমেলি) বলে একটা ব্যাপার আছে। যখন উত্তপ্ত ম্যাগমা এসে সমুদ্রের তলদেশ সৃষ্টি করে, তখন অতি উচ্চ তাপমাত্রার জন্য কিছু চৌম্বক পদার্থ বিগলিত অবস্থায় থাকে। এসব পদার্থ একসময় শীতল হয়। চৌম্বক ধর্ম অনুসারে উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর মুখ করে থাকে। তারপর আশপাশের শিলাখণ্ডের সঙ্গে জমাট বেঁধে যায়। ফলে তৈরি হয় একটি মেরু নির্দেশক রেখা। এভাবে সমুদ্রের তলদেশ থেকে আমরা উত্তর-দক্ষিণ মেরুর দিক খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দিকে উত্তর ও দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে এই নির্দেশক রেখা। এ ব্যাপারটা তিনভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ভূপৃষ্ঠ স্থির। দ্বিতীয়টা হলো, চৌম্বকীয় মেরু একই থাকে কিন্তু সমুদ্রের তলদেশ সঞ্চরণশীল। তৃতীয় ব্যাখ্যা হলো, এরা উভয়েই সঞ্চরণশীল। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে তৃতীয় ঘটনাটিই বাস্তবে ঘটে।

সাবমেরিন আবিষ্কারের পর সমুদ্রের তলদেশের নানা খবর তুলে আনছেন বিজ্ঞানীরা। সমুদ্রের মধ্যাঞ্চলকে বলে মিড-ওসেনিক রিজ। এই অঞ্চলে খুব কম পরিমাণ অধঃক্ষেপ পাওয়া যায়। অন্যদিকে রিজ অঞ্চল থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, উভয় দিকে তত বেশি অধঃক্ষেপ পাওয়া যায় সমুদ্র তলদেশে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে রিজ অঞ্চল অপেক্ষাকৃত নতুন এবং এর দুদিকের ভূমি অপেক্ষাকৃত পুরোনো। তবু বিজ্ঞানীরা অনুকল্পটা মানতে চাননি। দীর্ঘ গবেষণার পরে অবশেষে বিষয়টি আবিষ্কৃত হয়।

ভূপৃষ্ঠের কঠিন স্তরকে বলে লিথোস্ফিয়ার। এর দুটো অংশ; যা দুই ভাগে বিভক্ত—সামুদ্রিক ও মহাদেশীয়। ভূ-অভ্যন্তরের ম্যান্টেল স্তরের ওপর ভাসমান থাকে, এই লিথোস্ফিয়ার। ম্যান্টেল অংশের তাপমাত্রা খুব বেশি। তাই সেই অংশের শিলাখণ্ড গলিত অবস্থায় থাকে। গলিত শিলখণ্ডের মধ্যে একটি পরিচলন কোষের সৃষ্টি হয়। পরিচলন কোষের সান্দ্রতা বলের প্রভাবে সামুদ্রিক ও মহাদেশীয় লিথোস্ফিয়ার সঞ্চালনক্ষম হয়।

মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক পৃষ্ঠের যেসব খণ্ড ম্যান্টেলের ওপর পৃথকভাবে সঞ্চরণশীল থাকে, সেগুলোর প্রতিটিকে প্লেট বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীপৃষ্ঠের প্লেটগুলো সেগুলোর মতোই। লেখার শুরুতে কয়েকটা প্রাকৃতিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে। মহাদেশীয় প্লেটের সঞ্চরণশীলতার সঙ্গে সেই সব ঘটনার সম্পর্ক কী?

প্রথমেই দেখা যাক, ভূমিকম্প কেন হয়। দুটি টেকটনিক প্লেটের পারস্পরিক সংঘর্ষই ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। প্লেটের সংঘর্ষের যেটির ঘনত্ব কম, সেটা অন্য প্লেটটার নিচে তলিয়ে যায়। এর ফলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় এই ম্যান্টেল স্তরে। ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে উঠে আসে। অবশ্য এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতে ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু দুটি মহাদেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের সময় ঘটে অন্য ঘটনা। মহাদেশীয় প্লেটগুলোর ঘনত্ব কাছাকাছি। তাই এরা কেউ কারও নিচে তলিয়ে যায় না; বরং সংঘর্ষের ফলে সেখানকার ভূস্তর উঁচু হয়ে পর্বতমালার জন্ম দিতে পারে।

এসবই শুধু নয়, প্রকৃতপক্ষে ভূতত্ত্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা করা যায় টেকটনিক তত্ত্বের সাহায্যে। যেমন শিলার সৃষ্টি, শিলাচক্র ইত্যাদির পেছনে এই প্লেটসমূহের সঞ্চরণই মূল ভূমিকা পালন করে। এটি ভূতত্ত্ববিদ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত নীতি।

আরও বড় প্রশ্ন এই প্লেট টেকটনিকের সংঘর্ষের ফলে যে ভূমিকম্প হয়, তা বাংলাদেশে হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে বাংলাদেশ গুরুতর ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ অংশ ইন্ডিয়ান প্লেটে এবং কিছু অংশ পাশের বার্মিজ প্লেটে অবস্থিত। বাংলাদেশ ইউরাসিয়ান, ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সীমানায় অবস্থিত। এ ছাড়া ডাউকি ফল্ট বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। বলে রাখা ভালো, দুটি প্লেটের সঞ্চালনের কারণে প্লেটের সীমানায় শিলাস্তর পরস্পর থেকে বিচ্যুত হয়। এ বিষয়টিকেই ফল্ট বলে। ফল্ট বরাবর শিলাস্তরের নড়াচড়া ভূমিকম্পের প্রবল শক্তির জোগান দেয়। ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরাসিয়ান প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করছে। আর বার্মিজ প্লেট ইন্ডিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। এ ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্যতম। এখানকার ঘনবসতি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

লেখক: আন্তর্জাতিক আর্থ অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের সদস্য

সূত্র: আর্থ: প্রোট্রেইট অফ অ্যা প্ল্যানেট/ স্টিফেন মারশাক