মাইক্রোস্কোপ: বিজ্ঞান গবেষণার হাতিয়ার

স্বাভাবিক চোখে আমরা ২০০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট কোন কিছু দেখতে পাই না। আমাদের চোখের ক্ষমতা নেই এর চেয়ে ছোট কোন কিছু দেখার। কিন্তু রোগজীবাণুগুলি এর চেয়ে অনেক ছোট। সবচেয়ে বড় ব্যাকটেরিয়ার ব্যাস মাত্র দুই মাইক্রোমিটার - যা আমাদের দৃষ্টির সীমার চেয়েও ১০০ গুণ ছোট। সবচেয়ে বড় আকারের ভাইরাসের ব্যাস মাত্র আধা মাইক্রোমিটার - যা আমাদের দেখার ক্ষমতার চেয়ে চার শ গুণ ছোট। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোঅর্গানিজমগুলি আমাদের অনেক রোগের কারণ, রোগ সংক্রমণের কারণ ঘটায়। শরীরের বিভিন্ন কোষে এই অণুজীবগুলির উপস্থিতি দেখে রোগনির্ণয় করার জন্য প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবোরেটরিগুলিতে মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয়। রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সেখানে অণুজীবের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। তাছাড়া সার্জারিতেও

অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিবর্ধিত আকারে দেখার জন্য সার্জিক্যাল মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয়। ক্যান্সার রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ক্যান্সার টিউমার থেকে টিস্যু নিয়ে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সেই টিস্যুর প্রকৃতি দেখে বায়োপসি করা হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার শুরু হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। ষোড়শ শতাব্দীতে কাচের লেন্সের বিবর্ধন ক্ষমতা আবিষ্কৃত হবার পর ডাচ অপটিশিয়ানরা চোখের লেন্সের হ্রস্বদৃষ্টি ও দীর্ঘদৃষ্টির সমস্যা দূর করার জন্য বিভিন্ন ক্ষমতার লেন্স তৈরিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে। জাকারিয়াস জেনসেন ছিলেন ডাচ লেন্স প্রস্তুতকারী। তিনি ভাবলেন একটি উত্তল লেন্স যে পরিমাণ বিবর্ধন ঘটাতে পারে, দুইটি উত্তল লেন্স ব্যবহার করলে বিবর্ধন ক্ষমতা বেড়ে যাবে অনেকগুণ। তিনি ১৫৯০ সালে তিনি একটি লম্বা টিউবের দুই প্রান্তে দুটি উত্তল লেন্স স্থাপন করে প্রথম মাইক্রোস্কোপটি তৈরি করেছিলেন।

১৬৬৫ সালে ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট হুক আরো শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেন। হুক তাঁর মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে কোষের মাইক্রোস্কোপিক গঠন আবিষ্কার করেন। তিনি পিঁপড়া, মাছি ইত্যাদি অনেক ছোট ছোট কীটপতঙ্গের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বিবর্ধিত আকারে দেখে দেখে অনেক নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত তথ্য এবং বিবর্ধিত চিত্র তিনি তাঁর মাইক্রোগ্রাফিয়া বইতে প্রকাশ করেছিলেন।

মাইক্রোস্কোপের মূলনীতি

১৬৭৬ সালে আরেকজন ডাচ লেন্স প্রস্তুতকারী অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক অনেকগুণ বিবর্ধন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স তৈরি করে মাইক্রোস্কোপের গঠনের আরো উন্নতি ঘটান। তিনি তাঁর তৈরি মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সর্বপ্রথম পানির মধ্যে অসংখ্য অণুজীব দেখতে পান – যেগুলি খালি চোখে কখনোই দেখা সম্ভব নয়। তখন থেকেই শুরু হয়েছে মাইক্রোস্কোপের নতুন ব্যবহার। তারপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মাইক্রোস্কোপেরও অনেক উন্নতি ঘটেছে। মাইক্রোস্কোপের সাথে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটারসহ অন্যান্য প্রযুক্তি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। তবে মাইক্রোস্কোপের মূল যে পদার্থবৈজ্ঞানিক নীতি – তা সব মাইক্রোস্কোপের জন্যই এক।

চিত্র থেকে মাইক্রোস্কোপের মূলনীতি বোঝা যায়। যে বস্তুকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা হবে সেই বস্তু (h) থেকে আলো এসে পড়ে প্রথম লেন্স – অবজেক্টিভ লেন্সে। বিবর্ধিত প্রথম প্রতিবিম্ব (h1) তৈরি হয় আইপিসের সামনে। আইপিস হলো দ্বিতীয় লেন্স। প্রথম প্রতিবিম্ব দ্বিতীয় লেন্স আইপিসে বিবর্ধিত হয়ে অনেক গুণ বিবর্ধিত চূড়ান্ত প্রতিবিম্ব (h1’) তৈরি করে।

একটি আধুনিক মাইক্রোস্কোপ

খুব শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের বিবর্ধন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৫০০। অর্থাৎ মাইক্রোস্কোপ কোন বস্তুকে ১৫০০ গুণ বড় করে দেখাতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু রোগজীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসকে ১৫০০ গুণ বড় করলেও দেখা যায় না। যেমন সাম্প্রতিক কালের করোনা ভাইরাস। এরকম ভাইরাসের গড় দৈর্ঘ্য ১২০ থেকে ১৪০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। এক ন্যানোমিটার হলো এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। সাধারণ মাইক্রোস্কোপ হলো অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ, যাতে স্বাভাবিক আলো বস্তুর উপর পড়ে তা প্রতিফলিত হয়ে মাইক্রোস্কোপের লেন্সের ভেতর দিয়ে বস্তুর বিবর্ধিত প্রতিবিম্ব তৈরি করে। স্বাভাবিক আলোর যেটুকু আমরা দেখতে পাই – তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ ন্যানোমিটার থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। কোন বস্তুর আকার যদি ৪০০ ন্যানোমিটারের কম হয়, তাহলে তার উপর স্বাভাবিক আলো ফেলে অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তাকে দেখা সম্ভব নয়। তাহলে ভাইরাস দেখার উপায় কী?

ভাইরাস কীভাবে দেখা যায়

সারা পৃথিবীর মানুষ এখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে ভীত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সাড়ে চার কোটির বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছে। প্রায় বারো লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। এই সংখ্যা এখনো বাড়ছে। ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কত ধরনের চেষ্টা করতে হচ্ছে - মানুষের দৈনন্দিন স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করতে হচ্ছে, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করতে হচ্ছে, শহর গ্রাম জনপদ লকডাউন করতে হচ্ছে। অনেক মানুষ এখনো বুঝতে পারছে না ভাইরাস আসলে কীভাবে সংক্রমিত হতে পারে। খালি চোখে ভাইরাস দেখা গেলে এই সমস্যা হতো না। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে বলেই এত সমস্যা হচ্ছে।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ নতুন নয়। ১৮৮৯-৯০ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৫৬-৫৮ সালে চীনে আরেক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপ ঘটে। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই সময়। ১৯৬৮ সালে হংকং-এ উদ্ভুত হয় আরেক ধরনের ফ্লু ভাইরাস। সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ। ১৯৭৬ সালে প্রথম বারের মত এইচ-আই-ভি এইডস ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। পরবর্তী বছরগুলোতে এপর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা গেছে এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে। ১৯৬৫ সালের দিকে প্রথম বারের মত করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। বর্তমানের নভেল করোনা ভাইরাসসহ সাত ধরনের হিউম্যান করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে - যা মানুষের শরীরে বিস্তারলাভ করে। এদের মধ্যে আছে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স-করোনা ভাইরাস, সিভিয়ার একিউট রেসিপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্স-করোনা ভাইরাস, এবং বর্তমান সার্স-করোনা ভাইরাস-২ বা SARS-CoV-2। এই ভাইরাসগুলোর আকৃতি অনেকটা মুকুটের মতো। মুকুটের গ্রিক প্রতিশব্দ হচ্ছে করোনা। সেখান থেকেই এদের নাম হয়েছে করোনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ভাইরাসগুলো কীভাবে দেখা যায়?

বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের গঠন সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেছেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ভাইরাস দেখতে পাওয়া যায় - যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা। কিন্তু যেসব ভাইরাসের আকার আরো ছোট, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেগুলি দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য ব্যবহার করা হলো এক্স-রে। ১৮৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করার পর পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানেও অনেক নতুন পথ খুলে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং বোরের পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্স-রে'র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোন ক্রিস্টালের ভেতরের পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ কোন ক্রিস্টালে এক্স-রে প্রয়োগ করলে সেই এক্স-রে বিচ্ছুরিত হয়। শুরু হলো এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ম্যাক্স ফন লাউ। পরের বছর এক্স-রে ডিফ্রাকশান ব্যবহার করে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ । এই আবিষ্কারের জন্য ১৯১৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন এই পিতা-পুত্র। এক্স-রের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সেই পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞানের অনেককিছুর গাঠনিক বিশ্লেষণ ও আকার-আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৩৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বার্নেল এবং তাঁর ছাত্রী ডরোথি হজকিন মলিকিউলার বায়োলজিতে এক্স-রে ডিফ্রাকশান প্রয়োগ করে পেপসিনের গঠন বিশ্লেষণ করেন।

বার্নেল ও হজকিনের এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি স্ট্রাকচারাল বায়োলজি-র বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতিতে সরাসরি প্রোটিন বা অন্য কোন জৈব পদার্থের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা হয় না, কিন্তু জৈব পদার্থের আণবিক বিন্যাস থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে সিগনালগুলোকে একত্রিত করে পুরো বিন্যাসটি পুনর্গঠন করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ বিশ্লেষণ খুব সহজ হয়ে গেছে।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ
ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে নভেল করোনা ভাইরাস

১৯৩৩ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট রুশকা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ম্যাক্স নল (Max Knoll) ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে আলোর মাধ্যমে বিবর্ধন ঘটানো হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে আলোর কণা ফোটনের পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্রনও আলোর মত কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে হলো স্বাভাবিক মাইক্রোস্কোপে যত ছোট বস্তু দেখা সম্ভব, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট বস্তু দেখা সম্ভব। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবিত হবার পর থেকে জীববিজ্ঞানে অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির গঠন নির্ণয় করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপেরও অনেক উন্নতি হয়েছে।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায় - স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ও ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে পদার্থের উপর ইলেকট্রন প্রয়োগ করা হয়। ইলেকট্রন ও পদার্থের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় সেকেন্ডারি ইলেকট্রন নির্গত হয়। সেই সেকেন্ডারি ইলেকট্রন শনাক্ত করা হয় সংযুক্ত ডিটেক্টরে। সেই ইলেকট্রনগুলোর শক্তি বিশ্লেষণ করে পিক্সেল টু পিক্সেল ডাটা সংগ্রহ করা হয় এবং সেখান থেকে পদার্থের পুরো চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ইলেকট্রনগুলো পদার্থের ভেতর দিয়ে ট্রান্সমিট করে গিয়ে ডিটেক্টরে পৌঁছায়। ট্রান্সমিশানের সময় তার শক্তির যে পরিবর্তন হয় - সেই তথ্য থেকে পিক্সেল টু পিক্সেল ডাটা তৈরি হয়ে পুরো ছবি পাওয়া যায়।

ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের ক্ষমতা যতই ভালো হোক না কেন, সেখানে কিছুটা সমস্যা থেকে যায়। সমস্যা হলো ইলেকট্রনের শক্তি অনেক বেশি হওয়াতে পদার্থের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন যাওয়ার সময় রেডিয়েশানের কারণে পদার্থের সূক্ষ্ম গঠনের কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। এই পরিবর্তন রোধ করার জন্য ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থ দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন - যার নাম ক্রায়োজেনিক ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি। এই পদ্ধতিতে যে নমুনার ছবি তোলা হবে সেই নমুনাকে অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় (ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রা) ঠান্ডা করা হয়। ফলে এর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন যাবার সময় রেডিয়েশানের ক্ষতি হয় না। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন জার্মানির জীবপদার্থবিজ্ঞানী জ্যাকুস ডুবোশেট (Jacques Dubochet) ও ইয়োকিম ফ্রাঙ্ক (Joachim Frank) এবং স্কটিশ জীবপদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড হেনডারসন (Richard Henderson)। বর্তমান করোনা ভাইরাসের আকার ও আকৃতিও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ক্রায়োজেনিক ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির সাহায্যে।

ভাইরাসগুলোকে পূর্ণাঙ্গ জীব বলা যাবে না। অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াও নয় তারা। ভাইরাস নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য একটা পোষক শরীর লাগে তাদের। ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও অনেক ছোট আকারের হতে পারে ভাইরাস। সবচেয়ে ছোট অণুজীবের সাইজ কত? জীব হতে হলে প্রাণ থাকতে হবে এবং সেই প্রাণের প্রাথমিক উপাদান হলো ডিএনএ, আর-এন-এ, এম-আর-এন-এ, রাইবোজোম এবং অন্যান্য সব প্রাণরাসায়নিক উপাদান। এই সবগুলো উপাদান কার্যকরভাবে থাকতে হবে এই অণুজীবের শরীরে। তাহলে এগুলো সব থাকার জন্য কমপক্ষে কতটুকু জায়গার দরকার? পরীক্ষা করে দেখা গেছে সবচেয়ে ছোট ব্যাকটেরিয়ার সাইজ ০.২ মাইক্রোমিটার। অর্থাৎ এক মিটারের পঞ্চাশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। তার মানে ৫০ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া পাশাপাশি রাখলে এক মিটার লম্বা হবে। কিন্তু এক বর্গ মিটার জায়গায় থাকতে পারবে ২৫ হাজার কোটি ব্যাকটেরিয়া। আর ভাইরাসের সাইজ এর চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে এক বর্গ মিটার জায়গায় ২৫০০ কোটি কোটি ভাইরাস থাকতে পারবে। বোঝাই যাচ্ছে কী পরিমাণ অদৃশ্য শক্তির সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস বিভাগ, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া