ম্যাজিকের পেছনে আছে যৌক্তিক বিজ্ঞান

আমাদের চমকে দিয়ে হঠাৎ করেই মাথার টুপি থেকে খরগোশ বের করেন জাদুকর। কিংবা জীবিত মানুষকে কেটেকুটে জুড়ে দেন নিখুঁত শিল্পীর মতো। এমনই এক জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। দেশ-বিদেশে জাদুর প্রদর্শনী করে তিনি আজ বিশ্বের স্বনামধন্য জাদুকরদের একজন। ১৯৫০ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কলেজজীবনেই সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজের কাজে মন দেন জুয়েল আইচ। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একুশে পদকসহ আরও নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি ব্যস্ততার মাঝেই কিছু সময়ের জন্য তিনি হাজির হন বিজ্ঞানচিন্তার কার্যালয়ে। কথা বলছিলেন জাদুশিল্পে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে। তারই চুম্বক অংশ এখানে ছাপা হলো। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: একজন অভিজ্ঞ জাদুশিল্পী হিসেবে আপনি কি মনে করেন জাদু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছাড়া কার্যকর?

জুয়েল আইচ: আমি মনে করি না পৃথিবীর কোনো কাজই বিজ্ঞানের তত্ত্বের ব্যবহার ছাড়া করা সম্ভব। মানুষ যা কিছুই করুক না কেন তার অবশ্যই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। যিনি ম্যাজিক জানেন, তিনি বিষয়টিকে খুব সহজেই মেনে নেন এর পেছনে বিজ্ঞানই আসল। কিন্তু যিনি ম্যাজিক জানেন না, তাঁর কাছে বিস্ময়কর। প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। যিনি ছবি আঁকতে জানেন না, তাঁর কাছে ছবি আঁকা কিংবা যিনি কবিতা লিখতে জানেন না, তিনি কবিতাকে অবিশ্বাস্য মনে করেন। জাদুর ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। কিন্তু এসব কিছুর পেছনেই রয়েছে এক যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: শোনা যায়, সম্মোহিত করে সময় বদলে দিতে পারেন ম্যাজিশিয়ানরা। এ ঘটনার পেছনে কি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে?

জুয়েল আইচ: এই প্রশ্নের উত্তরে একাধিক প্রশ্ন উঠে আসে। এই যে ঘড়ির সময় বদলে যাওয়ার বিষয়টি আসলে মানুষ তৈরি করেছে। চিন্তাশক্তিই মানুষকে সৃষ্টিশীল করে। সে কোনো অবাস্তব কল্পনার বিষয়কেও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। ঘড়ির সময় বদলে যাওয়ার ঘটনাও তেমন। ম্যাজিশিয়ান পি সি সরকার এটা করেছিলেন। তাঁর আগেও অনেক বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ানই এটা করেছিলেন বলে শোনা যায়। কেউ কেউ হয়তো এটাকে সমর্থনও করেন। অনেকে আবার এর বিরোধিতা করে লেখালেখি করেন। বিশ্বখ্যাত ম্যাজিশিয়ান হ্যারি হুডিনের নামেও এমন গল্প শোনা যায়। অনেকে বিশ্বাস করতেন, তিনি আসলেই সময় বদলে দিতে পারেন, কিংবা তিনি নিজেকে পরিণত করতে পারেন পিঁপড়ায়। ভারতীয় উপমহাদেশে পি সি সরকারের আগেও এসেছেন জাদুশিল্পী থার্ডসটন। তিনি কিন্তু জোরালো কণ্ঠে এসব আজগুবি ম্যাজিকের কথা উড়িয়ে দিতেন। এগুলো যে অসম্ভব, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন থার্ডসটন। তিনি বলতেন, তাঁর ভক্তরা তাঁর সম্পর্কে এমন অদ্ভুত কথা ছড়ান, বিশ্বাসও করেন। সম্মোহন বিষয়টি শুধু স্থানবিশেষে কার্যকর। একজন ম্যাজিশিয়ান শুধু নির্ধারিত পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তিকে সম্মোহিত করতে সক্ষম। তাই সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে এর কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। আমরা কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও নিয়মিত সম্মোহিত হচ্ছি। আমাদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে সম্মোহিত করা হয়। যেমন অমুক সাবান ভালো, অমুক খাবার খেলে শক্তি হবে ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: তাহলে যে প্রচলিত অদ্ভুত সব ম্যাজিক দেখা যায়, সবই কি এ রকম ভিত্তিহীন?

জুয়েল আইচ: আসলে বিষয়টা আংশিকভাবে সত্যি। মানুষ ম্যাজিকের বিষয়টিকে অতিমাত্রায় রঞ্জন করতে পছন্দ করে। খুব সাধারণ একটা ম্যাজিক হচ্ছে মোটা দড়িকে সোজাভাবে দাঁড় করানো। এটা খুব সহজ কৌশল। এমনকি আমাদের দেশে যেসব জাদুকর রাস্তায় খেলা দেখান, তাঁরাও এই কৌশল জানেন। এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় খুব ভালো মানের দড়ি। এতে খুব হালকা-পলকা বাচ্চাকেও চড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষ মুখে মুখে এই ম্যাজিকের কাল্পনিক সব গল্প ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে সুতাটি আকাশের গভীরে চলে যায়; কেউ বলে সুতা বেয়ে অনেক ওপরে উঠে যান ম্যাজিশিয়ান। বলতে পারেন, যেসব জাদু অসম্ভব মনে হয়, তার পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানের ব্যবহার।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: বর্তমান সময়ে আধুনিক যে ম্যাজিক দেখানো হয়, সেগুলোর পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপরিসীম অবদান আছে। ম্যাজিকের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের যে মেলবন্ধন, সেটি নিয়ে কী বলবেন?

জুয়েল আইচ: এটা বরাবর ছিল। সেই শুরুর সময় থেকেই শুধু ম্যাজিক কেন, পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত সভ্য কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি। আগের দিনে চিত্রকরেরা অনেক সময় ধরে রং বানিয়ে, কাগজ সাজিয়ে ছবি আঁকতেন। এখন কিন্তু সেভাবে কাজ করতে হচ্ছে না। আধুনিক প্রযুক্তিতে একটু দক্ষ হলেই যে কেউ তাঁর মনের মতো করে ছবি আঁকতে পারেন। আমাদের ম্যাজিশিয়ানদের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি নানাভাবে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানের সাহায্যে নতুন নতুন ম্যাজিক উদ্ভাবন হচ্ছে। তবে বর্তমানে অনলাইনে ম্যাজিক নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তিকর গুজব। তাঁরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তাঁদের কল্পনার মতো করে ম্যাজিককে উপস্থাপন করছেন। কিন্তু প্রকৃত জাদুশিল্পের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে জাদুশিল্প নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। তাঁরা প্রকৃত জাদুশিল্প নিয়ে জানেন না বলেই তাঁরা ভাবছেন, এভাবে ভুলভালভাবে মানুষকে অবাক করাই ম্যাজিক। কিন্তু যাঁরা প্রকৃত ম্যাজিশিয়ান, তাঁরা কিন্তু কখনো আপনাকে ভুল ম্যাজিক দেখাবেন না। আমি সাধারণভাবেই আমাদের শিল্পকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরব।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি দীর্ঘ সময় ধরে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। আপনার নিজের ম্যাজিক নিয়ে মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

জুয়েল আইচ: আমি সব সময় চেষ্টা করি দর্শকদের নতুন কিছু উপহার দিতে। আমি আমার প্রদর্শনীতে এমন কোনো জাদু রাখি না, যেটা দেখে দর্শক অবাক হবেন না। তাই প্রতিবারই অনেক মানুষের অবাক চাহনি আমায় অপার আনন্দ দেয়। গত বছর আমি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গিয়েছিলাম জাদু দেখাতে। আমার মনে হলো, সেখানে বাংলাদেশকে তুলে ধরে আয়োজনটা করা যেতে পারে। আমি জাদু শুরুর আগে বাঁশি বাজাই। তবে সেবার আমি শুরু করেছিলাম ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিরা অনেক খুশি হয়েছিলেন এটাতে। এখন বুড়ো বয়সে এসে গান গাইতে বেশ ভালোই লাগে।

অনুলিখন আলিমুজ্জামান

* লেখাটি ২০১৭ সালের মার্চ সংখ্যায় বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত