যন্ত্রণামুক্তি দিয়েছিল যে অণু

নিলস লফগ্রেন (বাঁয়ে) ও তাঁর ছাত্র বেঙ্কট

মনে করুন, আপনার দাঁতে ব্যথা। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ডাক্তার দেখলেন, দাঁতটি তুলে ফেলাই শ্রেয়। কিন্তু সে দাঁত তুলতে গিয়ে আপনার পুরো শরীরকে অচেতন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই! ভাবুন, বিষয়টা কেমন ভয়াবহ! একসময় এই কাজটিই করতে হতো। শরীরের যেকোনো অংশে অস্ত্রোপচার করতে গেলে পুরো শরীর অচেতন করা হতো। সমস্যা হলো, সেই অচেতন অবস্থা থেকে রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সহজ ছিল না। বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিত। কখনো কখনো রোগী মারাও যেত। বিজ্ঞান বহুদিন ধরেই এমন চেতনানাশক খুঁজছিল, যেটি শুধু শরীরের নির্দিষ্ট অংশে প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। যেটাকে বলা হয় ‘লোকাল অ্যানেসথেটিক’ (Local Anesthetic)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপজুড়ে ছিল মৃত্যুযজ্ঞ। রণক্ষেত্রে যত মানুষ মরেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মরেছে আহত হয়ে। আহত মানুষের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে দিন-রাত। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে তখনো লোকাল অ্যানেসথেটিক সহজলভ্য ছিল না। মানুষের যন্ত্রণামুক্তির জন্য ও মানুষকে বাঁচানোর জন্য দরকার কার্যকরী ও সহজলভ্য লোকাল অ্যানেসথেটিক।

রসায়নবিদেরা উঠেপড়ে লাগলেন। নতুন ধরনের কার্যকরী যৌগ (Effective compound) উদ্ভাবন করতে হবে। উত্তর মেরুর দেশ সুইডেন সেই সময় যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত। সে দেশের এক কেমিস্ট খুঁজে পেলেন ‘ম্যাজিক বুলেট’। সেই বুলেটের নাম দেওয়া হলো ‘জাইলোকেইন (Xylocaine)’। সময়টা ১৯৪৩ সাল। স্টকহোম ইউনিভার্সিটির জৈব রসায়নের শিক্ষক নিলস লফগ্রেন সে কাজটি করলেন। লফগ্রেনের ল্যাবে কাজ করতেন এক মেধাবী তরুণ, বেঙ্কট লুন্ডভিস্ট। ২৩ বছর বয়স। সৃষ্টির নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলেন সেই যুবক। ড্রাগ তৈরি করে বেঙ্কট প্রথম নিজের ওপর প্রয়োগ করেছিলেন। বেঙ্কট জানতেন, সৃষ্টির আনন্দে মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করা যায়। নিজেকে অবশ করা তো এক তুচ্ছ কাজ! এমন পাগলদের জন্যই সভ্যতা টিকে থাকে।

জাইলোকেইন তৈরির পরপরই, পৃথিবীর বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি এস্ট্রাজেনেকা (বর্তমান নাম) সেটি কিনে নেয়। ড্রাগটির প্রাথমিক নাম দেওয়া হয়েছিল এলএল-৩০ (LL-30)। লফগ্রেন ও লুন্ডভিস্টের নাম থেকে। লফগ্রেন এবং তাঁর ছাত্র বেঙ্কট সে সময়ের হিরো। অর্থ ও যশ দুটিই জুটল ভাগ্যে, ঝোড়ো বেগে। লফগ্রেন ছিলেন লাইসেনসিয়েট ডিগ্রিধারী (সুইডিশ ডিগ্রি; অনেকটা এমফিলের মতো)। তিনি তাঁর কাজের ওপর থিসিস লিখলেন। মাত্র চার শব্দের অসাধারণ টাইটেল স্টাডিজ অন লোকাল অ্যানেসথেটিকস! ৩৫ বছরের লফগ্রেন, ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেন ১৯৪৮ সালে। পৃথিবীর খুব কম গবেষণা আছে, যেটি থিসিস আকারে প্রকাশের আগেই মানবকল্যাণে ব্যবহূত হয়েছে। লফগ্রেনের থিসিসের ৭০ বছর পুরোনো সেই কপি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

জাইলোকেইন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেল। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পৌঁছাল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর চিকিত্সাবিজ্ঞানে এক আশীর্বাদের মতো ছিল এই সৃষ্টি। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষের যন্ত্রণা লাঘব হলো। এমন সৌভাগ্যময় অধ্যায়ের অপর পিঠে ছিল এক আঁধার। সেই অন্ধকার আঘাত হানে বেঙ্কটের ওপর। ১৯৫৩ সালের একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে যান বেঙ্কট। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। নিভে যায় মাত্র ৩১ বছর বয়সের এক সম্ভাবনাময়ী প্রাণ! তাঁর উপার্জিত অর্থ ছিল প্রচুর। বেঙ্কটের পরিবার সে অর্থ উইল করল। সে টাকা ব্যয় করা হয় রসায়নের গবেষণার জন্য। সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিবছর বেঙ্কটের নামে পোস্টডক্টরাল গবেষণার জন্য বৃত্তি দেয়।

স্টকহোম ইউনিভার্সিটির জৈব রসায়ন বিভাগে ঢুকতে গেলে প্রথম যে তৈলচিত্রটি চোখে পড়ে, সেটি নিলস লফগ্রেনের। ছবির মানুষটি চশমা চোখে অবনত মস্তকে কী যেন দেখছেন। বেঙ্কটের কোনো একক ছবি খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধূমকেতুর মতো যারা আসে, তারা সৃষ্টির কাঠিতে নাড়া দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। রেখে যায় রেশ। রেখে যায় কাজ।

জাইলোকেইন যৌগ

লোকাল অ্যানেসথেটিক কী করে কাজ করে

স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন, মানুষ যখন ব্যথা পায় তখন সেটি নিউরন নামক স্নায়ুকোষের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। নিউরন কোষের মধ্যে পটাশিয়াম আয়ন থাকে। কোষের অন্তর্ভাগের পরিবেশ বহির্ভাগের তুলনায় হয় অনেকটা অ্যাসিডিক ও অধিক নেগেটিভ চার্জযুক্ত। কোষের বহির্ভাগে থাকে অধিক পরিমাণের সোডিয়াম আয়ন। কোষপর্দায় কতগুলো আয়ন চ্যানেল বা কূপ থাকে। সেগুলো দিয়ে কোষের ভেতর ও বাইরে আয়নগুলো চলাচল করে। যখন কোনো প্রকারের সংকেত (Signal) নিউরন দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন কোষের বাইরে থেকে আয়ন চ্যানেলের মাধ্যমে কোষের ভেতরে সোডিয়াম আয়ন প্রবাহিত হয়। অর্থাত্ কোষের অভ্যন্তরে ধনাত্মক চার্জের পরিমাণ বেড়ে যায়। যদি কোনোভাবে এই সোডিয়াম আয়ন চ্যানেল বন্ধ করা যায়, তাহলে কোষের ভেতর সোডিয়াম আয়ন ঢুকতে পারে না। ফলে সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে না। লোকাল অ্যানেসথেটিক এই সোডিয়াম চ্যানেলগুলো বন্ধ করার কাজটিই করে। লোকাল অ্যানেসথেটিক হলো মৃদু ক্ষারীয়। যেহেতু কোষের ভেতরের পরিবেশ মৃদু অ্যাসিডিক, সেহেতু লোকাল অ্যানেসথেটিক কোষের ভেতরে গিয়ে আয়নিত হয়। রসায়নে এর নাম অ্যাসিড-ক্ষার বিক্রিয়া। লোকাল অ্যানেসথেটিক আয়নিত হয়ে কোষের ভেতর থেকে সোডিয়াম আয়নের চ্যানেলগুলো ব্লক করে রাখে। ফলে ব্যথা পেলে সেই সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে না।

লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত