রাজকীয় মৌল হিলিয়াম

রসায়নের শিক্ষার্থীদের কাছে নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলা যেতে পারে এক পবিত্র নাম। বেশির ভাগ রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘুরপাক খায় এই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ধর্মকে কেন্দ্র করে। তা বটে, নিষ্ক্রিয় গ্যাস কিন্তু মাত্র সাতটা। এদের মধ্যে হিলিয়াম সবচেয়ে হালকা। এই তালিকার দ্বিতীয় মৌল। হিলিয়ামের শুরুর গল্প হাইড্রোজেনের মতোই। মহাবিস্ফোরণ দিয়ে মহাবিশ্ব শুরুর প্রায় চার লাখ বছর পরে, যখন তাপমাত্রা বেশ খানিকটা কমে এসেছে, তখন হাইড্রোজেনের সঙ্গে অল্প কিছু হিলিয়ামও তৈরি হয়। সঙ্গে অল্প পরিমাণে তৈরি হয়েছিল লিথিয়াম। সুতরাং মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো তিন পদার্থের একটা হলো হিলিয়াম।

যখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে কিছু হাইড্রোজেন মেঘ আস্তে আস্তে একত্র হতে শুরু করেছে, মহাকর্ষীয় টানে তা সংঘর্ষ করে সৃষ্টি করেছে নক্ষত্রের। আর নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে এসেছে শক্তি। এই শক্তির জ্বালানি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে হিলিয়ামে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন হিলিয়াম। হিলিয়াম থেকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরও ভারী মৌল তৈরি হতে পারে। ফিউশনের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হওয়া সবচেয়ে সহজ। এ জন্য মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনের পর সবচেয়ে বেশি রয়েছে হিলিয়াম। মহাবিশ্বের ৯০ শতাংশ পদার্থ হাইড্রোজেন, আর হিলিয়াম আছে ৭ শতাংশ। বাকি সব পদার্থ অন্য মৌলদের নিয়ে।

সাধারণ অবস্থায় হিলিয়াম গ্যাস। অন্য সব পদার্থের মতো এরও আছে স্ফুটনাঙ্ক ও গলনাঙ্ক। অর্থাত্ তাপমাত্রা কমিয়ে দিলে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তরল বা কঠিন হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, এর স্ফুটনাঙ্ক বা গলনাঙ্ক মহাবিশ্বে অন্য সব পদার্থের চেয়ে কম। তাই কোনো কিছুর তাপমাত্রা অনেক কমিয়ে ফেলতে নেওয়া হয় তরল হিলিয়ামের সাহায্য। দেখা গেছে, ২ কেলভিনের (-২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নিচে হিলিয়াম হয়ে যায় সুপার ফ্লুয়িড। অর্থাত্ তখন এর সান্দ্রতা থাকে না। কোনো কিছু কোনো জায়গায় গড়িয়ে দিলে বিপরীত দিকে ঘর্ষণবল কাজ করে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় হিলিয়ামের ক্ষেত্রে ঘর্ষণবল কাজ করে না। হিলিয়াম হয়ে যায় অতিপরিবাহী। অর্থাত্, এর মধ্য দিয়ে তাপ বা বিদ্যুত্ চলাচল করতে কোনো বাধা পায় না। এসব কারণে হিলিয়ামের ব্যবহার বহুবিধ।

হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৮ সালে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জুল জ্যানসেন ও নরম্যান লকইয়ার আলাদাভাবে সৌর বর্ণালিতে হলুদ রেখা খুঁজে পান, যা মূলত হিলিয়ামের জন্য তৈরি হয়। নরম্যান লকইয়ার ছিলেন বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এর প্রথম সম্পাদক। তিনি সূর্যের গ্রিক নাম হেলিওস (Helios) থেকে এর নাম দেন হিলিয়াম। আর প্রথম হিলিয়াম আলাদা করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম রামসে, ১৮৯৫ সালে। তিনি ইউরেনিয়ামের আকরিক ক্লেভাইটকে অম্লের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন দূর করেন। এরপর বর্ণালি নিয়ে দেখতে পান তিন যুগ আগে পাওয়া সেই হলুদ রেখা। সে বছরই সুইডিশ বিজ্ঞানী পার টিওডর ক্লিভ ও আব্রাহাম ল্যাংলেট স্বাধীনভাবে হিলিয়াম আলাদা করে পারমাণবিক ভরও বের করেন।

পারমাণবিক ভরের হিসেবে হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা, এরপরই হিলিয়াম। হাইড্রোজেনের তুলনায় হিলিয়াম চার গুণ ভারী। তবে আমাদের বাতাসে অবস্থা হাইড্রোজেনের মতোই। হালকা বলে অভিকর্ষ বলের প্রভাব এর ওপরও কম। বায়ুমণ্ডল একে ধরে রাখতে পারে না, আস্তে আস্তে উবে যায় মহাকাশে। বায়ুমণ্ডলের মাত্র ০.০০০৫ শতাংশ হিলিয়াম। ইউরেনাস গ্রহে আবার হিলিয়াম অনেক বেশি, আয়তন চিন্তা করলে ১৫ শতাংশ, আর ভরের হিসাবে ২৬ শতাংশ। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সব পদার্থ হিসাব করলেও শতকরা হিসাবটা ইউরেনাসের মতোই।

পৃথিবীতে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিতে বেশ হিলিয়াম আছে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে উত্পন্ন হয় আলফা কণা। আর আলফা কণা হলো হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস। কোনো কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিতে এমনকি ৭ শতাংশ পর্যন্ত হিলিয়াম গ্যাস থাকতে পারে, যা আংশিক পাতন করে আলাদা করা যায়। বাজারে যে হিলিয়াম, তা এই উৎস থেকেই পাওয়া।

ডুবুরিদের সিলিন্ডারে বাতাসের সাথে হিলিয়াম মেশানো হয়

ঝালাই করার সময় ঝালাইয়ের জায়গায় প্রয়োজন পড়ে নিষ্ক্রিয় পরিবেশ সৃষ্টি করার। কাজটা করা হয় হিলিয়াম দিয়ে। মহাকাশে রকেট যাবে, জ্বালানি ট্যাংকে চাই উচ্চ তাপ। কাজটা করে হিলিয়াম। যেহেতু তেজস্ক্রিয় বিকিরণে হিলিয়াম তৈরি হয়, তাই কোনো শিলাখণ্ডের বয়স ও অন্যান্য তথ্য জানায় হিলিয়াম বেশ কাজে আসে। হিলিয়াম, ইউরেনিয়াম আর থোরিয়ামের অনুপাতে বোঝা যায়, কত দিন আগেকার শিলাখণ্ড এটা। দৃশ্যমান লেজার তৈরি করতে হিলিয়াম-নিয়ন উেসর দরকার হয়।

হিলিয়ামের একটা ব্যবহারের কথা বলা দরকার। মানুষের আকাশে ওড়ার শখ যেমন বহু পুরোনো, পানির তলায় যাওয়ার শখও সেই আদিকালের। পানির তলায় যাওয়ায় মূল সমস্যা দাঁড়ায় নিশ্বাস নেওয়া। এ জন্য ডুবুরিরা সিলিন্ডারে করে বাতাস নিয়ে যান। বাতাসে ২১ শতাংশ অক্সিজেন, বাকি প্রায় পুরোটা নাইট্রোজেন। অক্সিজেনের পরিমাণ এর চেয়ে বেড়ে গেলে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সাগরতলে পানির চাপ থাকে অনেক বেশি। সে চাপে সিলিন্ডার থেকে বাতাস নিশ্বাসে নিলে দেখা যায় উচ্চ চাপে কিছু নাইট্রোজেন রক্তে মিশে যায়। ওপরে চলে আসার পর সে নাইট্রোজেনগুলো আর দ্রবীভূত থাকতে পারে না। ত্বক ভেদ করে নাইট্রোজেনগুলো বের হয়ে আসতে চায়। নাইট্রোজেন গ্যাসের অণু অপেক্ষাকৃত বড়। বের হওয়ার সময় ত্বকে ফোসকা পড়ে যায়। আবার সিলিন্ডারে শুধু অক্সিজেন নেওয়া তো সম্ভব নয়, শ্বসনপ্রক্রিয়া অনেক বেড়ে যাবে। নাইট্রোজেনের বদলে অন্য কোনো ছোট অণুর গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে, সেই অণু দেহের মধ্যে ঢুকে কোনো বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে না। নাইট্রোজেন অণু নিষ্ক্রিয় গ্যাস না হলেও এটি প্রায় নিষ্ক্রিয়, উচ্চ চাপ ও তাপ না হলে তেমন কোনো বিক্রিয়া করে না। এ সমস্যা সমাধানে তাই হিলিয়াম অবশ্যম্ভাবীই ছিল। ছোট আকৃতির পরমাণু, ত্বক থেকে বের হওয়ার সময় তেমন কষ্ট হবে না। আবার নিষ্ক্রিয়, শারীরিক কোনো প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।

গ্যাস বেলুন বানাতে লাগে হিলিয়াম। গ্যাস বেলুন বানাতে দরকার বাতাসের চেয়ে হালকা গ্যাস। সবচেয়ে হালকা হাইড্রোজেন। কিন্তু হাইড্রোজেন অত্যন্ত দাহ্য, বাতাসের সংস্পর্শে এলে খুব সহজেই আগুন ধরে যায়। তাই এখন গ্যাস বেলুনে হিলিয়াম ব্যবহার করা হয়।

হিলিয়াম সবচেয়ে বেশি নিষ্ক্রিয়। অন্য নিষ্ক্রিয় গ্যাস উচ্চ চাপ ও তাপমাত্রায় কিছু বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এ ক্ষেত্রে হিলিয়াম মহাশয় বড্ড রাজকীয়। ১৯৬০ সাল থেকে গবেষণা চলছে হিলিয়াম ফ্লোরাইড বানানোর। সফল হওয়া যায়নি।

বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি করা গেছে হিলিয়াম যৌগ। যেমন ফুলারিনের মধ্যে হিলিয়াম পরমাণু আটকে ফেলা যায়। ফুলারিন হলো কার্বনের একটা বিশেষ গঠন। যেখানে ৬০ থেকে ৭০ বা আরও বেশি কার্বন পরমাণু যুক্ত হয়ে ফুটবল আকৃতির খাঁচা তৈরি করে। ভেতরটা থাকে ফাঁপা। আর ওই ফাঁপা জায়গায় আটকে পড়ে হিলিয়াম পরমাণু। এভাবে যা তৈরি হয়, তাকে ঠিক পরিচিত যৌগ বলা যায় না।

তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি নেচার কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় সোডিয়াম আর হিলিয়ামের এক যৌগ বানানোর কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর কেন্দ্রের চাপের মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ চাপ (১১৩ গিগা প্যাসকেল, সৃষ্টি করলে এ যৌগ তৈরি হয়। এ যৌগ সুস্থিত।

হিলিয়ামের আরেক ধরনের যৌগ আছে যেগুলো সুস্থিত নয়। উচ্চ চাপে বা বিশেষ অবস্থায় তৈরি হয়, কিন্তু মুহূর্তেই আবার ভেঙে যায়। এগুলোকে বলে এক্সিমার। হিলিয়ামের বেশ কয়েকটি এক্সিমার আছে, আয়োডিন, টাংস্টেন বা সালফারের সঙ্গে। এদের বানাতে উচ্চ চাপ ছাড়াও প্রয়োজন পড়ে বৈদ্যুতিক স্টিমুলার। এগুলো মূলত ব্যবহূত হয় বিভিন্ন ধরনের লেজার বানাতে।

রসায়নের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর একটা ছিল রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাতবীক্ষণ পরীক্ষা। ১৯১১ সালে। ঠিক ১০০ বছর পরে, ২০১১ সালে এমনই আরেক পরীক্ষা করা হয়। আয়নিত স্বর্ণকণাকে প্রায় আলোর গতিতে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এ থেকে বেরিয়ে আসে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কণা। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ করা হয় অ্যান্টিহিলিয়াম, হিলিয়ামের প্রতিকণা। এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বে পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে বড় প্রতিকণা।

হিলিয়ামের এই যে নিষ্ক্রিয়তা, শীতল করার ক্ষমতা, মহাবিশ্বের বড় অংশ দখলে নেওয়া, এমনকি কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অবস্থান, সব মিলিয়ে সম্ভবত হিলিয়ামই সবচেয়ে রাজকীয় মৌল।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নেচার কেমিস্ট্রি, ফেব্রুয়ারি ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত ক্রিস্টিন হারমানের লেখা অবলম্বনে।

* লেখাটি ২০১৭ সালে এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত