শতায়ু মানুষের দীর্ঘ জীবন লাভের রহস্য কী

জাপানের কেইন তানাকা
ছবি: রয়টার্স

জাপানের কেইন তানাকা সপ্তাহ দুয়েক আগে, ১৮ এপ্রিল ২০২২, হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৯ বছর। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ঘোষণা অনুযায়ী তিনিই এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বছর বাঁচার রেকর্ড করেছেন।

তানাকা ১৯০৩ সালের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। ১৯ বছর বয়সের পরপরই বিয়ে করেন। তিনি চার সন্তানের জননী।

তানাকার পর বিশ্বে বর্তমানে বেঁচে আছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সের ব্যক্তি কে? গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এখনো কিছু জানায়নি। তবে কিছুদিন আগে ফরাসি নান (গির্জার সিস্টার) লুসাইল র‍্যানডনকে বিশ্বের পরবর্তী দীর্ঘায়ু লাভের রেকর্ডের অধিকারী বলে তারা জানিয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ১১৮ বছর পূর্ণ হয়। তাই তানাকার মৃত্যুর পর এখন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি লুসাইল র‍্যানডনই। তিনি সাধারণভাবে সিস্টার আঁদ্রে নামে পরিচিত। লক্ষণীয়, দীর্ঘায়ু দুজনই নারী। এ খবরগুলো স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে গত ২৫ এপ্রিল স্মার্ট নিউজ হিসেবে প্রকাশিত হয়।

তানাকার বয়স যখন ১০০ বছর পূর্ণ হয়, তখন বলেছিলেন, সবচেয়ে বেশি বয়স বাঁচার রেকর্ড তিনি করবেন। বাস্তবে সেটাই হলো। অবশ্য হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে অন্য কেউ এ রেকর্ড ভাঙবেন। কারণ, আজকাল বিশ্বব্যাপী দীর্ঘায়ু লাভকারী ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে।

দীর্ঘায়ু লাভের হিসাব কীভাবে রাখা হয়

কাজটা সহজ নয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জেরেন্টোলজি রিসার্চ গ্রুপ ১১০ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের তথ্য পর্যবেক্ষণে রাখে। ১১০ বছর বয়সটা বেছে নেওয়া হয়েছে। এ গ্রুপের ব্যক্তিদের বলা হয় ‘সুপারসেন্টেরিয়ানস’। রিসার্চ গ্রুপ শুধু তাঁদের তথ্য সংগ্রহই করে না, ওরা সুপারসেন্টেরিয়ানদের নিয়মিত সাক্ষাৎকার নেয়। তাঁদের স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন বা সমস্যা, জীবনযাপনের প্রণালিসহ সব ধরনের তথ্য লিপিবদ্ধ করে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তারা দীর্ঘায়ু লাভের রহস্য উন্মোচনের জন্য গবেষণা করছে। বেশি বয়সের কোন ধরনের ওষুধ জীবনকে আরও সাবলীল রাখতে পারে, সে বিষয়েও ওরা কাজ করছে।

সুপারসেন্টেরিয়ানদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়েরও বিশেষ পদ্ধতি তারা ব্যবহার করে। যেমন প্রত্যেকের অন্তত দুই কপি আইডি লাগবে। একটি তাঁর জন্মসনদ ও অপরটি ছবিসহ প্রত্যয়নপত্র। বিবাহিত কোনো নারী বিয়ের পর নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করলে তারও নির্ভরযোগ্য প্রত্যয়নপত্র লাগবে।

তবে এত কড়াকড়ির পরও মাঝেমধ্যে ভুলভ্রান্তি হয়। যেমন কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সের ব্যক্তির বয়স ১২২ বছর বলে সবাই জানতেন। তিনি ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু পরে দেখা যায় তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সালে ভুল ছিল। গুগল সার্চে দেখলাম, ফিলিপাইনে সবচেয়ে প্রবীণ ছিলেন লোলা সুসানো। সম্প্রতি ১২৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই নারীকে বিশ্বে প্রবীণতম ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। খবর ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর। অবশ্য স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের লেখায় এ তথ্য নেই।

বিশ্বে শতায়ু মানুষের সংখ্যা কত

বিশ্বে প্রায় ১৫০ জন অনুমোদিত সুপারসেন্টেরিয়ান আছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদক লিখেছেন, শৌখিন জিনোলজিস্টরা মনে করেন, অসমর্থিত দাবিদারদের হিসাবে নিলে সংখ্যাটা এক হাজারে দাঁড়াতে পারে। আবার ভোক্সের কেলসি পাইপার বলেন, ১০০ বছর বয়সে পৌঁছেছেন, এমন হাজারে অন্তত একজন ১১০ বছর বাঁচবেন। জাপান দাবি করে, তাদের দেশে ৭১ হাজারের বেশি শতায়ু ব্যক্তি আছেন।

এত বেশি বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা সম্ভব হয় কীভাবে

এ প্রশ্নের কোনো নিশ্চিত উত্তর নেই। বিশেষজ্ঞরা অনেক শতায়ু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কথায় বিশেষ কোনো মিল পাননি। জাপানের দীর্ঘায়ু ব্যক্তিরা বলেন, তাঁরা উদ্বেগমুক্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করেছেন। প্রচলিত স্বাস্থ্যসম্মত দেশীয় খাবারই তাঁদের পছন্দ। পরিশ্রম করেন; সেটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনাই হোক বা অন্য ধরনের স্বাধীন কাজ। অনেকেই সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন।

অনেকে অবসর সময়ে পড়াশোনা করেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দীর্ঘদিন বাঁচার পেছনে জেনেটিকসের একটি ভূমিকা থাকতে পারে।

স্বাভাবিক আয়ু কত হতে পারে

আমাদের দেশে এখন গড় আয়ু বেড়েছে; প্রায় ৭৩ বছর। নারীর গড় আয়ু প্রায় ৭৫ বছর। শতায়ু ব্যক্তির সংখ্যা অবশ্য কম। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেকোনো প্রাণীর স্বাভাবিক আয়ু তাদের শারীরিক গঠন বর্ধিত হওয়ার সময়ের (গ্রোথ পিরিয়ড) প্রায় ৬ গুণ। মানুষের গ্রোথ পিরিয়ড প্রায় ২৫ বছর। তাহলে আকস্মিক কোনো অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু না হলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে হয়তো ১৫০ বছর বাঁচতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব বায়োজেরেন্টোলজির অধ্যাপক রিচার্ড ফারাঘের ২০২১ সালের ৮ জুন এ বিষয়ে একটি লেখায় উল্লেখ করেন, সবকিছু ঠিক থাকলেও কোনো মানুষের শেষ পর্যন্ত ১৫০ বছরের বেশি বেঁচে থাকার কথা নয়। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত, মানুষের আয়ুর তাত্ত্বিক সীমা ১৫০ বছর।

হয়তো কোনো দিন আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিক গড় বয়স ১৫০ বছর অর্জন করতে পারব।

*আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক। [email protected]