পোকা যখন শিকারি

খাদ্যশৃঙ্খলের কথা শুনলেই আমরা ভাবি, বড় কোনো প্রাণী তার চেয়ে ছোট প্রাণীদের খাবে, মেরুদণ্ডীরা খাবে পোকামাকড়কে। কিন্তু প্রকৃতি এতটা সোজাসাপটাভাবে চলে না। কিছু আর্থ্রোপড আমাদের এই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারে।

ব্যাঙের কাছে ইপোমিস গুবরে পোকার লার্ভা যেন খুবই মজাদার আমিষে ভরপুর ছোট নাশতার প্যাকেট। কোনো ব্যাঙ আশপাশে থাকলে এই লার্ভাগুলো তাদের শুঙ্গ আর মুখ নাড়িয়ে ব্যাঙকে আকৃষ্ট করে তাদের খাওয়ার জন্য! যখনই ব্যাঙ এদের খেতে আসে, খেলার মোড় ঘুরে যায়। এই লার্ভা তখনই এই উভচরীর মাথায় লাফ দিয়ে চড়ে বসে। তারপর মরণকামড় বসিয়ে ব্যাঙের মাথার তরল পদার্থগুলো মজাদার জুসের মতো পান করতে থাকে।

হোসে ডক্টর ভালদেজ জার্মান সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটিভ বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চের একজন হবু পোস্ট ডক্টরাল গবেষক। এমন বিস্ময়কর ঘটনার শতাধিক উদাহরণ শনাক্ত করেছেন তিনি। গত জুলাইয়ে গ্লোবাল ইকোলজি অ্যান্ড বায়োজিওগ্রাফি জার্নালে এ নিয়ে বিস্তারিত রিভিউ লিখেছেন। তিনি এবং তাঁর সহগবেষকেরা মনে করেন, প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে আমাদের বুঝতে হবে, আসলে কে কাকে খাচ্ছে।

ভালদেজ পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করার সময় একটা ঘটনা দেখে এই বিপরীতমূখী শৃঙ্খলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি দেখেন, একদল জলজ বিটল এক বিরল প্রজাতির ব্যাঙাচিকে খেয়ে ফেলছে। এই পোকার লার্ভাগুলো শিকারি হিসেবে পরিচিত। অন্য পোকাদেরও খায়। আর পূর্ণবয়স্ক পোকাকে রীতিমতো মহাখাদক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ভালদেজের গবেষণায় দেখা যায়, এই পোকাগুলো মেরুদণ্ডী প্রাণীদেরও শিকার করে।

ভালদেজ পোকাদের শিকার করার ১ হাজার ৩০০ নমুনা খুঁজে একটি ডেটাবেস তৈরি করেন। ৮৯টির বেশি দেশ থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়। এতে বিখ্যাত মেরুদণ্ডী শিকারি মাকড়শা, বিচ্ছু থেকে শুরু করে অপরিচিত ফড়িং, শতপদীসহ অনেক প্রকারের শিকারি আর্থ্রোপড রয়েছে।

এ যেন অমেরুদণ্ডীর ওপর প্রতিশোধের এক ভয়ংকর তালিকা। নিজের জালে ফাঁদ পেতে গায়ক পাখিকে শিকার করে মাকড়শা, সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বশীভূত করে বিশালাকার পানিপোকা, বাচ্চা কুমিরকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে আগুনে পিঁপড়ার দল! ভালদেজ বলেন, তিনি যখনই এ ধরনের নতুন কিছু সম্পর্কে পড়তেন, শিহরিত হতেন।

এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বেসেলের জীববিজ্ঞানী মার্টিন নিফলার এমন কিছু ডেটাবেস তৈরি করেছেন। সেখানে দেখিয়েছেন, মাছ থেকে বাদুড়—এমন কিছুই নেই, যা মাকড়শা ভক্ষণ করে না। তাঁর এই কাজের উপর ভিত্তি করেই ভালদেজ গবেষণা করেছেন। এ ক্ষেত্রে শ্যারন ম্যাককরমিক ও গ্যারি পলিসের ১৯৮২ সালের একটি লিটারেচার রিভিউয়ের আরও বড় অবদান রয়েছে।

জলজ বিটেলের কাছে ব্যাঙাচিদের ধরাশায়ী হওয়া দেখে ভালদেজ এটিকে নোট হিসেবেই লিখে রাখেন। কিন্তু পরে তিনি ভাবেন, এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচনা করলে হয়তোবা বাস্তুসংস্থানবিদ্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজ্ঞাতই থেকে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেখা উচিত, খাদ্যজালে এর কেমন প্রভাব রয়েছে।’

কুইন্সল্যান্ডের জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালেয়র বন্য প্রাণী বাস্তুসংস্থানবিদ এরিক নর্ডবার্গ, বলেন, আর্থ্রোপডাদের খাদ্যজাল শনাক্ত করা করা কিছুটা জটিল। এগুলো কী খায়, জানতে হলে হয় এদের পাকস্থলী খুলে দেখতে হবে। তা না হলে সংরক্ষিত নমুনা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু অমেরুদণ্ডীদের পাকস্থলী নেই, তাই আমাদের সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে থাকতে হবে পর্যবেক্ষণের জন্য।

ইপোমিস গুবরে পোকার অনন্য আচরণের আবিষ্কারক পতঙ্গবিদ জিল উয়িজেন। তিনি বলেন, এমন সৌভাগ্যের মুহূর্ত দিনদিন বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের এই বিষয়ে আরও সচেতনতার বাড়ার পাশাপাশি স্মার্টফোনের প্রচলনকেও কৃতিত্ব দেন। খাদ্যশৃঙ্খলের ডেটাবেস থাকা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, বিজ্ঞানীদের এখনো অনেক কিছু জানা বাকি। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে আরও অনেক আর্থ্রোপড আছে, যারা মেরুদণ্ডীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। আসলে আমরা যা ভাবি, প্রকৃতি তার চেয়েও অনেক বেশি পরিবর্তনশীল।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস