শূন্য

সভ্যতার প্রধান এক প্রতীকচিহ্ন শূন্য। ছোট্ট এই চিহ্নটি আমাদের দিয়েছে বড় বড় গাণিতিক সংখ্যাকে অল্প কয়েকটি অঙ্কে প্রকাশ করার বা অতি জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে গণিতকর্ম চালানোর সক্ষমতা। ১ প্রতীকটিকে দশ, এক শ, এক হাজার কিংবা আরও অসংখ্য গাণিতিক সংখ্যায় রূপান্তরের ক্ষমতা আছে শুধু শূন্যেরই। আমাদের গণিতব্যবস্থায় সংখ্যার প্রতিটি প্রতীকেরই আছে নিজস্ব একটি মূল্য। পাশাপাশি তাদের অন্তর্গত অঙ্কগুলোর স্থানিক মূল্যও আছে। এ কারণে ১২৩৪ আর ৪৩২১ একই প্রতীক দিয়ে লেখা হলেও এরা আলাদা দুটো সংখ্যা। কিছু-না বা শূন্যের কোনো প্রতীক ছাড়া সংখ্যার এই কাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। ১১, ১০১, ১১০, ১১০০, ১০০১—এই সংখ্যাগুলো শূন্য প্রতীকটি না থাকলে আলাদা আলাদাভাবে বোঝানো অসাধ্য হতো। প্রায় বারো শ থেকে পনেরো শ বছর আগে ভারতবর্ষীয়রা শূন্যের ধারণাটি উদ্ভাবন করলেও আমাদের অনেকের ধারণা, গণিতের অন্য নয়টি সংখ্যার প্রতীক আর অঙ্কের স্থানিক মূল্যসহ শূন্যের আবিষ্কর্তা আরবরা। এর কারণ ভারত থেকে এটি ইউরোপে এসেছিল আরবদের মধ্যস্থতায়। ‘জিরো’ আর ‘সাইফার’ শব্দ দুটো মূলে অভিন্ন। শব্দ দুটোর মূলে আছে আরবি ‘সিফ্র্’ বা ‘জিরো’ শব্দটি। সেটি আবার এসেছে ‘সাফারা’ বা ‘শূন্যতা’ থেকে। ইংরেজিতে শব্দ দুটো এসেছে ইতালীয়, লাতিন ও ফরাসি ভাষার সূত্রে।

শূন্যের প্রতীক ও স্থানিক মূল্য ছাড়া বড় অঙ্কের সংখ্যা প্রকাশের আরও দুটো রীতির কথা আমরা জানি। গ্রিক আর রোমকরা এর জন্য একটির পর একটি প্রতীকচিহ্ন জড়ো করত। MV মানে হলো ১০০৫, আর শুধু এটুকুই মাত্র। এ পর্যন্ত ব্যাপারটা বেশ সরল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই একই রীতিতে ১৮৮৮ লিখতে গেলে ব্যাপারটা হয়ে পড়ে হযবরল। লিখতে হয় MDCCCLXXXVIII। অর্থাত্ ভিন্ন ভিন্ন সাত ধরনের মোট তেরোটি অঙ্ক। এই রীতিতে গুণ বা ভাগকে সরলভাবে প্রকাশ করা একেবারেই সম্ভব নয়। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটেছে রোমকরা কিছু-না বা শূন্যের কোনো প্রতীক উদ্ভাবনের প্রতিভা দেখাতে পারেনি বলে। আমরা ১ লিখে এর পেছনে পরপর তিনটি পর্যন্ত শূন্য বসিয়ে যা প্রকাশ করতে পারি, সেটি প্রকাশ করতে তারা ব্যবহার করত I, X, C, M ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন।

দ্বিতীয় আরেকটি রীতি প্রয়োগ করত চীনারা। আমাদের মতো ১ থেকে ৯ পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্ক ছাড়াও তারা বের করেছিল ‘দশ গুণ’, ‘শত গুণ’ ইত্যাদি বোঝানোর মতো কিছু প্রতীক। ব্যাপারটাকে এভাবে বোঝানো যায়, ধরা যাক, তারকাচিহ্ন বা * বোঝায় দশ, তলোয়ার বা † বোঝায় শত, আর অনুচ্ছেদচিহ্ন বা ¶ বোঝায় হাজার। এখন, কোনো ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ না রেখে, আমরা ১৮৮৮ বোঝাতে ১¶৮†৮*৮ এবং ১০০৫ কে ১¶৫ লিখতে পারি। কিন্তু এমন বহু সংখ্যা আছে, যা এই রীতিতে লিখতে গেলে আরও বেশি অঙ্কের দরকার হয়ে পড়ে। তাতে গণিতের কাজটি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ল।

ভারতীয়দের বাইরে গণিতের মূল প্রতীকগুলো স্থানিক মূল্যে সাজিয়ে কোনো একটি সংখ্যামূল্য প্রকাশের রীতি ও শূন্যের প্রতীক আলাদাভাবে উদ্ভাবন করেছিল গুয়াতেমালা আর ইয়ুকাতানের মায়ারা। মায়াদের এই উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষীয়দের সঙ্গে তুলনীয়। তাদের গণনারীতির যুক্তি যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয়, উদ্ভাবনার ধরন দুটি একই ধাঁচের। তবে স্বাভাবিকভাবেই রীতি দুটোর প্রকাশের ধরন গড়পড়তাভাবে এক রকম হওয়ার কারণ নেই। মায়াদের শূন্য প্রতীকটির সঙ্গে ভারতীয়দের বা বর্তমানে আমাদের সবার জানাটির কোনো মিলই নেই। আমাদের গণনারীতি দশকিয়া পদ্ধতির, কিন্তু মায়াদের পদ্ধতিটি ছিল কুড়িকিয়া। সে কারণে তাদের গণিতে মূল প্রতীক ছিল দশটার বদলে বিশটা। মানে তাদের রীতিতে যা ‘১০০’, আমাদের রীতিতে তা হয়ে দাঁড়ায় ‘৪০০’। তাদের রীতিতে যা ‘১০০০’, আমাদের রীতিতে তা ‘৮০০০’-এ এসে ঠেকে। এভাবে যখন নিজেদের রীতি ও অঙ্কে তারা লিখত ১২৩৪, তখন তার সংখ্যামূল্য আমাদের হিসেবে ১২৩৪ না হয়ে হতো ৮৮৬৪। কাজেই তাদের ও আমাদের রীতিও এক রকম হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের সঙ্গে আমাদের রীতির শুধু ধাঁচটিতে মিল আছে। ব্যস, এটুকুই। সত্যি বলতে কী, এই দুই গণনারীতি এসেছে, অন্য আর সব রীতির মতোই, ভিন্ন ভিন্নভাবে অঙ্ক গোনার আঞ্চলিক ঐতিহ্য থেকে। আমাদের দশকিয়ার ভিত্তি দুই হাতের আঙুলের সংখ্যা। মায়াদের কুড়িকিয়ার ভিত্তি ছিল হাত ও পায়ের মোট আঙুলের সংখ্যা।

মজার ব্যাপার হলো, উদ্ভাবনা দুটোর মধ্যে মায়াদেরটা বেশি প্রাচীন। তাদের গণিতের ‘দীর্ঘগণনা’ ও পঞ্জিকাব্যবস্থার যেখানে মায়াদের শূন্যকে প্রথম আকার নিতে দেখা যায়, পাণ্ডুলিপিতে সংরক্ষিত সেই সময়কাল (৮: ১৪: ৩: ১: ১২ ও ৮: ১৪: ১০: ১৩: ১৫) আমাদের হিসাবে দাঁড়ায় ৩২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। তবে ধারণা করা হয়, এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন তৃতীয় বা চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্ব শতক থেকে আরও পাঁচ শ-ছয় শ বছর বেশিও হতে পারে। ভারতীয়রা শূন্যের আদি প্রতীক আয়ত্তে এনেছিল সম্ভবত দ্বিতীয় শতকে। অবশ্য শূন্য প্রতীকটি তখনো তাদের হাতে আসেনি; এসেছে আরও পরে, ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি সময়ে। প্রথমে সেটি ছিল একটি বিন্দুর মতো চিহ্ন। পরে ধীরে ধীরে সেটি ছোট একটি বৃত্তের আকার পায়। গণিতজ্ঞরা এই প্রতীক আবিষ্কারের আগেই সম্ভবত ভারতে ‘অনস্তিত্ব’ ধারণাটি উদ্ভব ঘটেছিল, যাকে বলা হতো ‘শূন্য’।

বেশি দিন হয়নি, এটা স্পষ্ট হয়েছে যে স্থানিক মূল্য হিসেবে শূন্যের তৃতীয় আরেকটি ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল। সম্ভবত সেটিই প্রাচীনতম। এটি হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়, ভারতীয় ও মায়াদের কয়েক শতক আগে, মধ্যপ্রাচ্যের নব্য-ব্যাবিলনীয়দের মধ্যে। তারা গুনত ষষ্টিকিয়ায়: ১০ আর ২০-এর বদলে তাদের পরবর্তী উচ্চতর একক ছিল ৬০। মেসোপটেমীয়দের উদ্ভাবনী স্বাতন্ত্র্যের প্রমাণ হিসেবে এই অদ্ভুতুড়ে রীতিটি যথেষ্ট। ফলে ১ প্রতীক দিয়ে ১, ৬০, ৩৬০০ কিংবা ১/৬০, ১/৩৬০০ এবং ৩ প্রতীক দিয়ে ৩, ১৮০, ১০৮০০ কিংবা ১/২০-কে প্রকাশ করা যেত। ষষ্টিকিয়া পদ্ধতিটি কীভাবে বিকশিত হয়েছিল, তা এখনো সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। সম্ভবত এটি প্রচলিত কোনো পরিমাপ-ব্যবস্থার, বিশেষ করে মুদ্রা গণনার লিখিত রূপের গাণিতিক রূপান্তর। এভাবে ৬০ শেকেলকে প্রকাশ করার জন্য পাউন্ড বা মিনা বা মানেহ ইত্যাদি বড় বড় একক গড়ে উঠেছিল। ৬০-কে বেছে নেওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে সংখ্যাটিকে ২, ৩, ৪, ৫ ইত্যাদি দিয়ে যেমন ভাগ করা যায়, তেমনই ১০, ১২, ১৫, ২০ ইত্যাদি দিয়েও।

এই পরিমাপ ও গণনারীতি—পাশাপাশি একই সঙ্গে সেটি লেখার মতো ক্যুনিফর্ম পদ্ধতি—ছিল দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার প্রাক-ব্যাবিলনীয় সুমেরীয়দের অবদান। এর সূচনা বলা যায় ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগে থেকে। যা হোক, সুমেরীয় বা তাদের পরবর্তী ব্যাবিলনীয়রা তখনো অঙ্কের স্থানিক মূল্য নিয়ে কাজ করেনি, শূন্য প্রতীকের অভাব অনুভব করেনি। তারা লিখত ১। আর সেটি দেখে পাঠককে অনুমান করে নিতে হতো সেটা ১ বোঝাচ্ছে, না ৬০। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার পর ব্যাবিলন পারস্যের দখলে এলে (৫২৮-৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) নথিপত্রে ০ উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। ধরা যাক, দেখা গেল ১-০-৪, যার মানে ৩৬০৪। নব্য-ব্যাবিলনীয়দের শূন্য প্রতীকটি ছিল একটি লম্বরেখার বাঁ দিকে পরস্পরযুক্ত সমান আকারের দুটো ত্রিভুজের মতো। যা হোক, এমনকি উত্তর মেসোপটেমীয়রাও শুধু তখনই শূন্য লিখত, যখন সেটা পড়ত ‘মাঝখানে’, ১-০-৪ সংখ্যাটিতে যেমন আমরা দেখলাম। কিন্তু ৫০ বা ৭৭০ বা ০.৩ ইত্যাদি সংখ্যার মতো বাইরের দিকটায় শূন্য ব্যবহার করা হতো না। এভাবে, তাদের রীতি অনুযায়ী, ৩৮৪০ বোঝাতে যদিও তাদের লেখা উচিত ছিল ১-৪-০, কিন্তু শূন্য অনুমান করার ব্যাপারটিকে তারা পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়ে লিখত ১-৪। ফলে ৩৮৪০ এবং ৬৪ বা ১-১/১৫-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা অসাধ্য হয়ে পড়ত। এ কারণে নব্য-ব্যাবিলনীয়রা এভাবে সত্যি সত্যি শূন্য উদ্ভাবন করলেও শূন্য ধারণা আধাআধিও তারা ব্যবহার করতে পারেনি। তাই অন্য কোনো জাতির কাছে বা উত্তরকালে না পৌঁছেই যে এটি চাপা পড়ে গেল, তা আশ্চর্যের নয়। বেশি কিছু পাওয়ার আগেই এই উদ্ভাবনার ধারণাটি তারা অর্জন করে এবং সেটিকে অচল করে রাখে।

এই অর্ধসফলতা অনেকটা আজটেক ও মেক্সিকোর অন্যান্য জাতির কাছে মায়াদের শূন্য ধারণাটি যেতে না পারার ব্যর্থতার মতো। মেক্সিকানদের পঞ্জিকাব্যবস্থার উত্স অবশ্য মায়াদের সঙ্গে অভিন্ন এবং সম্ভবত এখান থেকেই পুরো ব্যাপারটা এসেছে। আবার এই পঞ্জিকাব্যবস্থার রীতি অনেকটা মেসোপটেমীয়দের মুদ্রা গণনার সংখ্যা বহুগুণ করার নিয়ম মেনে চলত, যা কিনা অঙ্কের স্থানিক মূল্যকে বোঝায়। এভাবে মেসোপটেমীয়দের ১৮০ দানায় হতো এক শেকেল, ৬০ শেকেলে এক মিনা, ৬০ মিনায় এক তালেন্ত। আবার মায়াদের হতো ২০ দিনে এক ‘মাস’, ১৮ মাসে এক ‘বছর’, ২০ বছরে এক কাতুন, ২০ কাতুনে এক চক্র। এই নিয়মিত ব্যবস্থা, বিশেষ করে যেখানে বিপুল গণনা বা হিসাব জড়িত, অবধারিতভাবে নামের বদলে স্থানমূল্য নির্ধারণের অভ্যাস জন্ম দেয়, যেমনটা দেখা যায় ইংরেজ বইবিক্রেতাদের মধ্যে, £ s. d. নিয়ে। যখন একজন নব্য-ব্যাবিলনীয় ২ তালেন্ত ৬ শেকেল, একজন মায়া দুই ‘বছর’ ছয় দিন, কিংবা একজন বিলেতবাসী ২ পাউন্ড ৬ পেন্স হিসাব করেন পরিস্থিতি সত্যিই তখন একই সমান্তরালে এসে দাঁড়ায়। আর এখান থেকে, আমাদের জানা রীতি অনুসারে, ২০৬ বিমূর্ত মূল্যটি লিখতে গেলে ঘটনাটি কী ঘটবে? একজন ব্যাবিলনীয় যখন লিখবেন ‘২০৬’, তার অর্থ দাঁড়াবে ৭২০৬। মায়ারা কীভাবে তাদের গণিতকর্ম চালাত, আমাদের ভালো জানা নেই। আমরা শুধু এটুকু ধারণা করতে পারি যে যখন তারা বিভিন্ন সময়কালকে যোগ করতে চাইত কিংবা অতিবাহিত সময়ের হিসাব বের করার জন্য একটি থেকে আরেকটি তারিখ বিয়োগ দিতে চাইত, তখন তারা একই কলামে দিন-মাস-বছর রেখে একটির নিচে আরেকটি সংখ্যা লিখত; ৭৭৩ থেকে ২০৬ বাদ দিতে গেলে, ধরা যাক, এখন আমরা যেভাবে লিখে থাকি। এখানেই পাওয়া যাবে, যাকে আমরা বলে থাকি, ‘স্থানিক হিসাবরীতি’। আর এভাবে চলতে থাকলে হিসাবের কোনো কোনো জায়গায় অঙ্কের শূন্যতাকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিতে বাধ্য—বিশেষ করে মধ্যবর্তী এককগুলোয়—মিনা বা মাস বা শিলিং বা ষাট বা দশ, যেকোনো ক্ষেত্রেই তা হোক না কেন।

ব্যাবিলনীয়দের মুদ্রাগণনার একক বা মায়াদের সময় গণনার এককের মতোই কোনো হিসাবের প্রেক্ষাপটে কয়েক শতক ধরে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ‘আরবদেশীয়’ অঙ্কগুলো ব্যবহার করতে করতে ভারতীয়রা একপর্যায়ে বিন্দু চিহ্ন প্রয়োগ করতে শুরু করে। এর অর্থ দাঁড়ায় নির্দিষ্ট এই স্থানটিতে কোনো অঙ্ক নেই।

মজার ব্যাপার এই যে প্রতিবারই শূন্যের উদ্ভব ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক প্রতিরোধের বিপরীতে। এটি এমন এক ‘প্রাকৃতিক’ বা স্বতঃস্ফূর্ত বস্তু, যা দিয়ে কিছু না থাকা বোঝায়। অঙ্কের শূন্যতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন সেটি নিজেই একটি অঙ্ক, আর তা করা হয় অস্তিত্বশীল একট প্রতীক দিয়ে। এভাবে এতে, একেবারে স্ববিরোধী উপায়ে হলেও, প্রকাশিত হয় উচ্চতর বুদ্ধিমত্তা। মিসরীয়, গ্রিক, রোমক, খ্রিষ্টীয় ইউরোপীয় কিংবা চীনাদের মতো উন্নত সংস্কৃতির জাতিরা এটি উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়ে এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করেছে যে শূন্য ‘অপ্রাকৃতিক’।

অন্যদিকে আবার, উদ্ভাবনাটিকে উচ্চমূল্য দেওয়াও শক্ত। এক ধরনের শূন্য না থাকলে অঙ্কের কোনো স্থানিক মূল্য থাকতে পারে না। আবার এটা ছাড়া অঙ্কের যেকোনো কার্যকলাপ অসম্ভব জটিল ও মন্থর হয়ে পড়ে। এটা তো কোনো নিরর্থ দুর্ঘটনা নয় যে গণিতে একেবারে পিছিয়ে থাকার পরও গ্রিকরা জ্যামিতি এবং এর বিভিন্ন শাখা, যেমন শঙ্কু জ্যামিতি (Conic Section), বিকশিত করে তুলেছিল। তাদের যেসব গাণিতিক সূত্রকে এমনকি আমরা বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পাঠ্য বলেই জানি। তাদের দুর্বল ও অবিকশিত গণনাপদ্ধতি গাণিতিক হিসাবকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছিল। গণিতে পারঙ্গম না হওয়ায় তাদের বীজগণিতও দেরিতে ও ভুল পথে বিকশিত হয়েছিল।

লক্ষ করা দরকার, তিনটি আবিষ্কারই নামহীন। শূন্য আবিষ্কারের খ্যাতি কাউকে দেওয়ার বিষয়টি ইতিহাস মূল্যবান মনে করেনি; সংরক্ষণ বা আবিষ্কার করেনি কোনো নাম, কোনো ঘটনা বা সময়। আমরা জানি কেবল উদ্ভাবক জনগোষ্ঠী, সময়কাল আর পরস্পর সহযোগিতার কথা। যা হোক, এ যাবত্ অধিত জ্ঞানের সূত্রে বলা যায়, কোনো যোগ ছাড়াই আলাদা-আলাদাভাবে মৌলিক তিনটি উদ্ভাবন ঘটেছিল বহুদূরের তিনটি ভূখণ্ডে, পাঁচ শতকের ব্যবধানে। তাদের উদ্দীপক ছিল আলাদা, প্রেক্ষাপটও ছিল বিচিত্র।

আলফ্রেড এল ক্রোয়েবার: জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন নৃবিজ্ঞানী। তাঁর অ্যানথ্রপলজি বই থেকে লেখাটি নেওয়া।

অনুবাদক: কবি ও সাংবাদিক।