সুপারম্যানীয় মস্তিষ্কের কথা

আচ্ছা আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা কত? গুগল মামাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় ১০০ বিলিয়ন! এই ১০০ বিলিয়ন নিউরনের প্রতিটি নিউরন আবার গড়ে ৭ হাজারটি সিন্যাপটিক সংযোগের মাধ্যমে অন্য নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত। তাহলে মানব মস্তিষ্কের মোট সিন্যাপসের সংখ্যা কত দাঁড়ায়? হিসাবটা আপনাদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিন্যাপসের সংখ্যাও নাকি কমতে থাকে! তারপরও একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মোট সিন্যাপসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০-৫০০ ট্রিলিয়নের মতো! দুঃখের ব্যাপারটা হলো, এত শত নিউরন আর এত সিন্যাপস থাকা সত্ত্বেও আমরা নাকি মস্তিষ্কের কেবল ১০ শতাংশ ব্যবহার করি! এটা একটা কথা হলো? যেখানে ডলফিনের মতো প্রাণীরা নাকি মস্তিষ্কের ২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকে! মস্তিষ্কের এত বেশি ব্যবহার করতে পারার কারণেই হয়তো তাদের নিজেদের মাঝে উচ্চ তরঙ্গ ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারার ক্ষমতা রয়েছে। আচ্ছা এমন যদি হতো, মানুষ তার মস্তিষ্কের ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারত? তাহলে কী হতো?

বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষ যদি মস্তিষ্কের ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে তাহলে মানুষ হয়তো অত্যন্ত শক্তিশালী হতো, টেলিপ্যাথি ও টেলিকাইনেসিসের মতো ক্ষমতা তৈরি হতো। হয়তো তখন সব রোগ, ব্যথা, সমস্ত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত মানুষ। সুপারসনিক তরঙ্গ অনুধাবন, যেকোনো ধরনের আলোক তরঙ্গ দেখতে পারার মতো দৃষ্টিশক্তি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তরঙ্গ অনুধাবন ও পরিবর্তন করতে পারত। চাই কি মানুষ হয়তো সময়ের গতিকে পরিবর্তন করতে পারত, ইচ্ছেমতো যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময়ে যেতে পারত। আচ্ছা যদি মানুষ সব ধরনের শক্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, তাহলে মানুষের হয়তো কোষীয় অস্তিত্বের দরকারই নেই। হয়তো তখন মানুষ বিশুদ্ধ শক্তির সর্বব্যাপী চেতনা হিসেবে বিরাজ করবে!

কী? পড়তে পড়তে কাল্পনিক জগতে হারিয়ে গেলেন? তাহলে একটু বাস্তবে টেনে আনি আপনাদের। সত্যি বলতে কী, মানুষ প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্কের পুরোটাই তথা ১০০ শতাংশই ব্যবহার করে! মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহারের কথাটি আসলে একটি কিংবদন্তি। কবে কীভাবে এই কিংবদন্তির উদ্ভব, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এই মিথ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল লোয়েন থমাস নামের এক মার্কিন লেখকের এক প্রবন্ধে। সেখানে তিনি উইলিয়াম জেমসের (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাইকোলজিস্ট) বলা একটি কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ভুলবশত সুনির্দিষ্ট ১০ শতাংশের উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে লিমিটলেস, ডিফেন্ডিং ইয়োর লাইফ, ফ্লাইট অব দ্য নেভিগেটর ও লুসির মতো বিখ্যাত হলিউড মুভি এবং ‘হিরোস’-এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিজের কল্যাণে এই কিংবদন্তি আরও প্রগাঢ় হয়।

তবে এই সব ধরনের শতাংশের কথাই যে আদতে সত্যি নয় তা বেরি বেয়েরস্টেন নামের একজন ব্রিটিশ নিউরোসায়েন্টিস্টের কিছু প্রমাণসমেত যুক্তিতে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। সবচেয়ে অকাট্য যুক্তি ছিল যদি মস্তিষ্কের শুধু ১০ শতাংশই কাজ করত, তাহলে ওই অংশটুকু বাদে বাকি অংশের কোথাও ক্ষতি হলে মানুষের দৈনন্দিন কাজের কোনোরূপ ব্যাঘাতই হতো না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মস্তিষ্কের সামান্যতম ক্ষতিও অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া নিউরোইমেজিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে মানুষ তার মস্তিষ্কের পুরোটাই ব্যবহার করে। তবে একই সময়ে ১০০ শতাংশই নয়; কারণ হয়তো এর জন্য যত শক্তি দরকার হয় তা আমাদের শরীর সরবরাহ করতে সক্ষম নয়।

তাই যাঁরা আমি হয়তো মস্তিষ্কের ৫ শতাংশও ব্যবহার করতে পারি না অজুহাত দিয়ে সব কাজ থেকে গুটিয়ে থাকার চেষ্টা করেন, তাঁরা এবার একটু নড়েচড়ে বসুন। কারণ আপনিও মস্তিষ্কের ১০০ শতাংশই ব্যবহার করেন!

লেখক: শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগ, ঢা.বি.

সূত্র: ডেইলি মেইল, সায়েন্টিস্ট আমেরিকা ও উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত