বিশ্বজুড়ে প্রাণীদের জানা-অজানা ৭

পৃথিবী প্রাণের এক অপূর্ব সমারোহ। বৈচিত্র্যই পৃথিবীর নানা ধরনের অজস্র প্রাণীকে এত রহস্যময় ও বিস্ময়কর করে তুলেছে। যেমন ধরুন, অক্টোপাস। এদের মস্তিষ্ক নয়টি! ভাবা যায়? কিংবা প্রজাপতির কথাই ধরুন। এরা স্বাদ গ্রহণ করে পায়ের মাধ্যমে! চলুন, প্রাণীদের নিয়ে এরকম বিস্ময়কর ও অজানা কিছু তথ্য জানা যাক।

১. বাঘের গর্জন শোনা যায় ২ মাইল দূর থেকেও

বাংলাদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের রাজা। শুধু নামেই রাজকীয় নয়, এর চলাফেরা ও ভাবভঙ্গিতেও রয়েছে রাজকীয় আভিজাত্য। সুন্দরবনের রাজা যখন গর্জন করে, তখন কেঁপে ওঠে সমস্ত বন। এর গর্জন শোনা যায় প্রায় ২ মাইল (৩.২ কিলোমিটার) দূর থেকেও। অন্য বাঘকে নিজের এলাকা জানান দিতে এভাবে জোরে গর্জন করে বাঘ। কিন্তু কীভাবে সুন্দরবনের এই রাজা এত জোরে গর্জন করে?

এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বাঘের ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রীতে। এরা নিজেদের গলার একটি পেশী ব্যবহার করে ভোকাল কর্ডগুলোকে বিশেষ উপায়ে প্রসারিত করতে পারে, যা এদের কন্ঠস্বরের আয়তন বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণ। ফলে এই গর্জনের শব্দতরঙ্গ বায়ুতে কম্পন তৈরি করে, ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঘের উপপ্রজাতি। এদের ওজন ৩০৬ কেজি বা ৬৭৫ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা টাইগ্রিস (Panthera tigris)। 

২. নেকড়েরা না খেয়ে এক সপ্তাহের বেশি বাঁচতে পারে 

নেকড়ের হাড় হিম করা ডাকের কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। এ ধরনের ডাক বহুদূর পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। নেকড়েরা মূলত পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এরকম করে। একটি নেকড়ে ডাকলে বাকিরাও সাড়া দেয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বিভিন্ন গুহার গর্তে বাস করে এরা। এই নেকড়েদের একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। এরা না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে এক সপ্তাহেরও বেশি।

নেকড়েদের বিপাক হার অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি। এর মানে, এরা খাবার থেকে দ্রুত শক্তি উৎপাদন করতে পারে, দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে না খেয়ে। নেকড়েরা নিজেদের দেহে ঘ্রেলিন (Ghrelin) নামের একটি হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ঘ্রেলিন একধরনের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন। এ ছাড়াও নেকড়েরা শরীরে প্রচুর পরিমাণে চর্বি জমা করে। কখনো খাবারের অভাব হলে এই চর্বি কাজ করে শরীরের শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে।

নেকড়েরা খুব সামাজিক প্রাণী। দল বেঁধে বাস করে। ইংরেজিতে নেকড়ের দলকে বলে প্যাক—উলফ প্যাক। একটি প্যাকে সাধারণত ৬ থেকে ১২টি নেকড়ে থাকে। নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানিস লুপাস (Canis lupus)।

৩. প্রজাপতি স্বাদ নেয় পা দিয়ে!

প্রজাপতি এই গ্রহের অন্যতম মনোমুগ্ধকর প্রাণী। তাদের রঙিন ডানা, নেচে বেড়ানো আর স্পর্শকাতর সৌন্দর্য আকৃষ্ট করে সবাইকে। ডিম থেকে শুঁয়োপোকা, তারপর পিউপা হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতিতে রূপান্তর—এই বিরাট পরিবর্তন মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে প্রজাপতির জীবনে। তবে প্রজাপতির এক মজার বৈশিষ্ট্য আছে। এরা যেকোনো কিছুর স্বাদ নিতে পারে পায়ের পাতার মাধ্যমে।

প্রজাপতির পায়ে কেমোরিসেপ্টর (Chemoreceptor) নামে একধরনের সংবেদনশীল রাসায়নিক কোষ থাকে। এই কোষ সরাসরি নিউরন বা স্নায়ুকোষের সঙ্গে যুক্ত। মানে, মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে পারে। কেমোরেসেপ্টর কোষের মাধ্যমে প্রজাপতি শনাক্তকৃত রাসায়নিক অণু অনুযায়ী মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। এই সংকেত বিশ্লেষণ করে খাবারটি খাওয়া যাবে কি না, তা নির্ধারণ করে এরা। এভাবে প্রজাপতি বুঝতে পারে, খাবারটি মিষ্টি, তিক্ত, টক, লবণাক্ত বা অন্য কোন স্বাদের; কিংবা খাবারটি পুষ্টিকর বা বিষাক্ত কি না। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, প্রজাপতির পায়ের কেমোরিসেপ্টর কোষগুলো কাজ করে অন্যান্য প্রাণীর জিহ্বার মতো।

৪. বিশ্বের বৃহত্তম স্থলজ প্রাণী আফ্রিকান হাতি

বিশ্বের বৃহত্তম স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী হাতি প্রোবোসিডিয়ান বর্গের সদস্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। সাধারণত দুই ধরনের হাতি দেখা যায়—এশিয়ান ও আফ্রিকান হাতি। বর্তমানে বেশির ভাগ হাতির অস্তিত্ব রয়েছে আফ্রিকা অঞ্চলে। আফ্রিকান বুশ হাতি ও বন হাতি আকার-আয়তনের দিক থেকে বিশাল। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আফ্রিকান হাতির উচ্চতা ৩.২ থেকে ৪.০ মিটার (১০.৫ থেকে ১৩ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত আফ্রিকান হাতির ওজন ৪ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ৪৮ কেজির মতো হয়।

আফ্রিকান হাতি দিনে ৩০০ পাউন্ড পর্যন্ত খাবার খেতে পারে। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ওজনের জন্য রেকর্ড করা আফ্রিকান হাতিটি ছিল একটি বুশ হাতি। এর ওজন ছিল ১০ হাজার কেজি, আর উচ্চতা ছিল ১৩.৮ ফুট।

মাথার দুপাশের দুটি বিশাল কান দিয়ে হাতি নিজের বিশাল দেহ ঠান্ডা করে। হাতির শুঁড়ে ৪০ হাজারেরও বেশি পেশী থাকে। এই পেশীগুলোর সাহায্যে হাতি শুঁড় দিয়ে কোনো ভারী বস্তু তোলা, খাবার মুখে পুরে খাওয়া, বাচ্চা শাবকের যত্ন নেওয়া, গন্ধ শুঁকতে পারা ছাড়াও আরও অনেক রকম কাজ করতে পারে।

আফ্রিকান হাতির গড় আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর। তবে কিছু কিছু হাতি ৮০ বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো হাতির মস্তিষ্ক। এরা সহজে কিছু ভোলে না।

৫. মেরু ভালুক সাদা নয়!  

বরফের রাজা খ্যাত মেরু ভাল্লুক বা পোলার বিয়ার। এরা আসলে বরফের মতোই সাদা—এই ধারণা গেঁথে আছে আমাদের মনে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? আর্কটিক অঞ্চলের প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, মেরু ভাল্লুক, কিংবা ভালুকরা আসলে সাদা চামড়ার নয়। তাদের চামড়ার রং মূলত কালো। নবজাতক মেরু ভালুক শাবকের ত্বক আবার গোলাপী হয়। পাঁচশ গ্রাম ওজনের এই শাবকগুলো হয় অন্ধ, দাঁতহীন। এদের পশম থাকে না। তিন থেকে চার মাস বয়সে শাবকের গোলাপী ত্বক কালো হয়ে যায়। তাদের ঘন পশমের নীচে কালো ত্বক স্পষ্ট দেখা যায়। স্বচ্ছ পাতলা লোম সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে, যা আমাদের চোখে মেরু ভালুককে সাদা দেখায়।

মেরু ভালুকের কালো চামড়া থাকার বেশ কিছু কারণ আছে। বেশির ভাগই সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের লোম স্বচ্ছ হলেও গাঢ় রং সূর্যের তাপ শোষণ করে, ঠান্ডা আর্কটিক পরিবেশে মেরু ভালুকদের উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও কালো ত্বক সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে মেরু ভালুকদের।

৬. ৫০ বছরে বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে ৬৯ শতাংশ

বন উজাড়, জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া ও মরুকরণের ফলে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শিকার করা বন্যপ্রাণী হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড ও জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৬৯ শতাংশ কমে গেছে। গবেষণাটি ‘লিভিং প্ল্যানেট ইনডেক্স ২০২২’ নামে পরিচিত। এটি প্রায় পাঁচ হাজার দুইশ প্রজাতির বত্রিশ হাজারেরও বেশি প্রাণীর তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এ গবেষণাপত্রে আরও উঠে এসেছে, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অনেক বন্যপ্রাণী প্রজাতি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন

৭. অক্টোপাসের হৃৎপিণ্ড তিনটি, মস্তিষ্ক নয়টি!

অক্টোপাস আমাদের পরিচিত প্রাণীদের তুলনায় বেশ ভিন্ন। এদের শারীরিক গঠন অত্যন্ত জটিল। অক্টোপাসের তিনটি হৃৎপিণ্ড। এদের দুটি পেরিফেরাল হৃৎপিণ্ড ফুলকা দিয়ে রক্ত পাম্প করে দেহে। বাকি একটি হৃৎপিণ্ড দেহের সবটাজুড়ে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে​​।

অক্টোপাসের মস্তিষ্ক নয়টি। কেন্দ্রীয় মস্তিষ্কের পাশাপাশি, প্রতিটি বাহুতে একটি করে মস্তিষ্ক থাকে। এগুলো অবশ্য ঠিক মস্তিষ্ক নয়, স্নায়ুতন্ত্র। তবে এগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে ও বাস্তবায়ন করতে পারে সংশ্লিষ্ট বাহু দিয়ে।

অক্টোপাসের রক্ত লাল নয়, নীল। এরা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। জটিল ধাঁধা সমাধান করতে পারে, এমনকি সরঞ্জামও ব্যবহার করতে পারে। আবার প্রয়োজনে ত্বকের রঙ পরিবর্তন করে ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে অক্টোপাস।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, সায়েন্স এবিসি, নিউ সায়েন্টিস্ট, উইকিপিডিয়া