হান্টিংটনস রোগের চিকিৎসায় আশার আলো
হান্টিংটনস রোগের চিকিৎসায় বড় সাফল্য এসেছে। প্রথমবারের মতো একটি পরীক্ষামূলক জিন থেরাপি এই রোগের গতি ধীর করতে সফল হয়েছে। এর ফলাফল এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এটি একটি বিরাট অগ্রগতি বলে মনে করা হচ্ছে। এই পদ্ধতি পার্কিনসনস ও আলঝেইমারের মতো অন্য মস্তিষ্কের রোগের চিকিৎসাতেও নতুন পথ দেখাতে পারে।
এই চিকিৎসা পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে
এই চিকিৎসার নাম এএমটি-১৩০। এটি মস্তিষ্কের একটি ক্ষতিকর প্রোটিনকে লক্ষ্য করে কাজ করে। হান্টিংটনস রোগীদের জিনে একটি ত্রুটি থাকে। এই ত্রুটির কারণে তাদের শরীরে হান্টিংটিন নামে একটি প্রোটিন তৈরি হয়। সুস্থ মানুষের শরীরে এই প্রোটিন ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত মানুষের শরীরে এটি বিষাক্ত পিণ্ড আকারে মস্তিষ্কের কোষের ভেতরে জমা হতে থাকে। একসময় এই পিণ্ড মস্তিষ্কের কোষগুলোকে মেরে ফেলে। ফলে রোগীর স্মৃতিশক্তি কমে যায়, হাঁটতে অসুবিধা হয় এবং কথা জড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে দেখা যায় আরও নানা উপসর্গ।
নেদারল্যান্ডসের বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ‘ইউনিকিউর’ এই পরীক্ষামূলক চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করেছে। এটি বিকৃত হান্টিংটিন প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। কীভাবে? এর জন্য একটি নিরীহ ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। নিরীহ ভাইরাসের ভেতরে জেনেটিক উপাদান ভরে সেটি পৌঁছে দেওয়া হয় মস্তিষ্কের কোষে। এই জেনেটিক উপাদান কোষকে মাইক্রোআরএনএ নামে একটি ক্ষুদ্র অণু তৈরির নির্দেশ দেয়। এই মাইক্রোআরএনএ বিষাক্ত প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। একে একটি ‘আণবিক স্টপ সিগন্যাল’ বলা যেতে পারে।
চিকিৎসাটি কীভাবে এবং কোথায় দেওয়া হয়
এই চিকিৎসা মস্তিষ্কের দুটি নির্দিষ্ট অংশে প্রয়োগ করা হয়। অংশ দুটির নাম কডেট নিউক্লিয়াস ও পিউটামেন। হান্টিংটনস রোগে এ দুটি অংশই প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মস্তিষ্কের অনেক গভীরে অবস্থিত। তাই চিকিৎসকেরা রিয়েল-টাইম ব্রেন স্ক্যান ব্যবহার করেন। তাঁরা স্ক্যান দেখে একটি সরু নল সেখানে প্রবেশ করান। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ১২-১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। মাত্র একটি ইনজেকশনেই এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। এটি মস্তিষ্কে বিকৃত হান্টিংটিন প্রোটিনের মাত্রা স্থায়ীভাবে কমিয়ে দেয়।
জিন থেরাপি কতটা কার্যকর
ইউনিকিউরের প্রাথমিক ফলাফল বলছে, এই জিন থেরাপি হান্টিংটনস রোগের অগ্রগতি প্রায় ৭৫ শতাংশ ধীর করে দিতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক সারাহ তাব্রিজি ও তাঁর সহকর্মীরা একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করেছেন। এতে হান্টিংটনস রোগে আক্রান্ত ১৭ জন রোগীকে উচ্চ মাত্রার চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিন বছর পর গবেষকেরা রোগীদের অবস্থার অবনতি পরিমাপ করেন। এরপর সেই ফলাফলের সঙ্গে চিকিৎসা না পাওয়া রোগীদের তুলনা করেন। অধ্যাপক তাব্রিজি জানান, ‘সাধারণ রোগীদের এক বছরে যতটা অবনতি হয়, চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ততটা অবনতি হতে গড়ে চার বছর সময় লেগেছে।’ এছাড়া, চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে ‘নিউরোফিলামেন্ট লাইট চেইন’ নামে প্রোটিনের মাত্রা কমে গেছে। এই প্রোটিনটি মস্তিষ্কের ক্ষতির সংকেত দেয়। এর মাত্রা কমে যাওয়া প্রমাণ করে, জিন থেরাপিটি রোগের গতি সত্যিই ধীর করে দিচ্ছে।
কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
ইউনিকিউর এখনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে তাদের মতে, এখন পর্যন্ত থেরাপিটি নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে। রোগীরা এটি ভালোভাবে সহ্য করতে পারছেন। সবচেয়ে সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথাব্যথা ও বিভ্রান্তির কথা জানা গেছে। এই সমস্যাগুলো আবার এমনিতেই সেরে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রদাহ কমানোর জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করতে হয়েছে।
চিকিৎসাটি কখন সবার জন্য পাওয়া যাবে
ইউনিকিউর জানিয়েছে, তারা আগামী বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (FDA) কাছে অনুমোদনের জন্য আবেদন করবে। অনুমোদন পেলে ২০২৭ সালের আগেই থেরাপিটি বাজারে আসতে পারে।
তবে যুক্তরাজ্যের অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোফিয়া মাইডজিব্রডজকা মনে করেন, এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তাঁর মতে, ‘আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। এই জিন থেরাপির দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।’
এই পদ্ধতি কি মস্তিষ্কের অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগবে?
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড রুবিনজটেইন বলেন, ‘এই পদ্ধতি সফল হলে তা অন্য রোগের চিকিৎসাতেও কাজে লাগবে। পার্কিনসনস বা অন্য ধরনের ডিমেনশিয়ার চিকিৎসাতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর জন্য গবেষকদের শুধু জেনেটিক উপাদানে সামান্য পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই সেটি নির্দিষ্ট রোগের বিষাক্ত প্রোটিনকে লক্ষ্য করে কাজ করতে পারবে।’