আমাদের মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলছে!

শিরোনাম পড়ে অবাক হয়েছেন হয়তো। কিংবা ভাবছেন, সায়েন্স ফিকশন মুভির কাহিনি। আসলে তা নয়। ঘটনা ১০০ ভাগ সত্যি। আমাদের মস্তিষ্ক নিয়মিতই নিজের কিছু অংশকে খেয়ে ফেলে। এবং এটা আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যে অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় এ ঘটনা ঘটে, তার বৈজ্ঞানিক নাম ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis)। ঠিক ধরেছেন, ঘটনার মতো নামটাও অদ্ভুত। কিন্তু জিনিসটা কী? কেনই-বা মস্তিষ্ক নিজেই নিজের কিছু অংশকে খেয়ে ফেলবে?

সহজ ভাষায় বললে, ফ্যাগোসাইটোসিস হলো শরীরের কোষদের ‘খেয়ে ফেলার’ প্রক্রিয়া। গ্রিক শব্দ ফ্যাগেইন (Phagein) অর্থ ‘টু ইট’ বা গিলে নেওয়া। আর কাইটোস (Kytos) অর্থ কোষ বা ফাঁকা পাত্র। ১৮৮৩ সালে ইলিয়া মেশিনকফ (Ilya Metchnikoff) এ ধরনের কোষ প্রথম আবিষ্কার করেন। তাঁর পরামর্শেই এ নাম রাখা হয়।

আরও পড়ুন

ইলিয়া দেখেন, শরীরের কিছু কোষ নিয়মিতই আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোর ওপর চড়াও হয়। পুরো অ্যাকশন মুভি যাকে বলে আরকি! বিষয়টাকে আরও সহজ করে বুঝতে একটা উদাহরণ ভাবুন।

আপনার এলাকায় কিছু পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন, যাঁদের কাজ এলাকার রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখা। সেই সঙ্গে এলাকা সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখার জন্য আছেন নিরাপত্তাকর্মী। খাঁটি বাংলায় বলা যায়—পুলিশ। এই দুটি কাজ দেহের জন্যও করতে হয়। কিছু কোষ আছে, এরা একই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং পুলিশের কাজ করে। এই কোষগুলোকেই বলা হয় ফ্যাগোসাইট (Phagocyte)।

এরা শরীরজুড়ে টহল দিয়ে বেড়ায়। যখনই কোনো জীবাণু বা মৃত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত কোষের দেখা পায়, সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে চিহ্নিত করে ফেলে। এরপর নিজের সেল মেমব্রেন বা কোষ পর্দাটি দিয়ে ওই শত্রুকে ঘিরে ফেলে। এভাবে ধীরে ধীরে ওই শত্রুকে গিলে ফেলে পুরো অক্টোপাসের মতো করে!

আরও পড়ুন

শত্রু এখন জালে বন্দী। এই জাল বা থলেকে বলা হয় ফ্যাগোজোম। মঞ্চ প্রস্তুত। এবারে কোষের আরেক প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসে আরেকটি থলে। এর নাম লাইসোজোম। এই থলেতে থাকে শক্তিশালী এনজাইম। লাইসোজোম থলেটা ফ্যাগোজোমের সঙ্গে মিলে গিয়ে নিজের ভেতরের ওই এনজাইম নিঃসরণ করে। এই এনজাইম শক্তিশালী অ্যাসিডের মতো কাজ করে, গলিয়ে ফেলে মৃত কোষটিকে। আর জীবাণু থাকলে সেটাকে মেরে সাফ করে দেয়। এরপর এই মৃত জীবাণু বা গলিত কোষকে স্রেফ বর্জ্য হিসেবে বের করে দিলেই হলো। আগেই যেমন বললাম, পুরো অ্যাকশন মুভি আরকি।

এই অ্যাকশন মুভির কাজ তো বুঝতেই পেরেছেন। রোগ-জীবাণুকে প্রতিহত করা। আমাদের দেহের শ্বেত রক্তকণিকা একধরনের ফ্যাগোসাইট। শরীরে কোনো ইনফেকশন হলে এরা রোগ-জীবাণুকে আক্রমণ করে। এ সময় যেসব শ্বেত কণিকা মারা যায়, সেগুলোকেই আমরা দেখি ‘পুঁজ’ হিসেবে। বিভিন্ন ইনফেকশনে এই পুঁজই বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

এবারে আসল প্রশ্ন। মস্তিষ্ক যে নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলছে, সেটা কেন? আসলে, মস্তিষ্কে ফ্যাগোসাইটোসিস ঘটে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। আমাদের মস্তিষ্কে কোটি কোটি কোষের মধ্যে সংযোগ বা কানেকশন থাকে। এগুলোর মাধ্যমে আমরা শিখি, চিন্তা করি বা মনে রাখি। এগুলোকে বলা হয় সিন্যাপস। সব সিন্যাপস বা সংযোগ সমান দরকারি নয়। এই বেদরকারি সংযোগগুলো সরিয়ে ফেলা দরকার না?

মস্তিষ্কের বিশেষ ফ্যাগোসাইট কোষ মাইক্রোগ্লিয়া ঠিক এই কাজই করে। অপ্রয়োজনীয় বা দুর্বল সংযোগগুলোকে শনাক্ত করে খেয়ে ফেলে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় সিন্যাপটিক প্রুনিং (Synaptic Pruning)। ব্যাপারটা অনেকটা টেবিল থেকে অপ্রয়োজনীয় বইপত্র সরিয়ে ফেলার মতো। এতে টেবিলে নতুন জিনিস রাখার জায়গা বাড়ে, নয়েজ কমে যায়। মস্তিষ্কও একইভাবে পুরনো বা কম দরকারি সংযোগ ছেঁটে ফেলে নতুন কিছু শেখা বা মনে রাখার জন্য জায়গা তৈরি করে। এর ফলে আমাদের স্মৃতিশক্তি আরও তীক্ষ্ম হয় এবং মস্তিষ্ক আরও দ্রুত কাজ করতে পারে।

ঠিক ধরেছেন, নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলা আসলে মস্তিষ্কের নিজেকে আরও উন্নত করার প্রক্রিয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র এবং উইকিপিডিয়া