বিলুপ্ত ডোডোকে ফিরিয়ে আনার পথে এক ধাপ এগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা

মানুষের কারণে বহু প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়া বিখ্যাত প্রাণীর মধ্যে আছে ম্যামথ, ডায়ার নেকড়ে এবং ডোডো। উড়তে না পারা বিখ্যাত পাখি ডোডো বিলুপ্ত হয়েছে বেশি দিন হয়নি। তিন শ বছরের কিছু বেশি আগেও পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াত এই পাখি। 

বিলুপ্ত প্রাণীগুলো মধ্যে ডায়ার নেকড়ে ফিরিয়ে এনেছেন বিজ্ঞনীরা। কলোসাল বায়োসায়েন্সেস নামে একটি বায়োটেক প্রতিষ্ঠান কাজটি করেছে। এই নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। বিশ্লেষকদের দাবি, ঠিক ডায়ার নেকড়ে না, জিন এডিটিং করে ডায়ার নেকড়ের কাছাকাছি কিছু একটা বানিয়েছে কলোসাল। 

একই প্রতিষ্ঠান ম্যামথ এবং ডোডো নিয়েও কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠান এবার ঘোষণা দিয়েছে, ৩০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ওয়া ডোডোকে ফিরিয়ে আনার পথে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা।

ম্যামথ
আরও পড়ুন

যেভাবে ফিরবে ডোডো

কলোসাল বায়োসায়েন্সেস জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো তারা কবুতরের প্রিমোরডিয়াল জার্ম সেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রিমোরডিয়াল জার্ম সেল হলো এমন এক ধরনের কোষ, যা থেকে জীবের জনন কোষ বা গ্যামেট (যেমন শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) তৈরি হয়। জনন কোষের প্রাথমিক বা আদি রূপ হলো প্রিমোরডিয়াল জার্ম সেল।

ডোডোর নিকটতম জীবন্ত আত্মীয় নিকোবর কবুতর

একটি নতুন জীবনের ভিত্তি তৈরির জন্য এই কোষ অপরিহার্য। ডোডোকে ফিরিয়ে আনার প্রকল্পে বিজ্ঞানীরা কবুতরের এই বিশেষ কোষগুলো নিয়ে কাজ করছেন। উদ্দেশ্য হলো এই কোষগুলোকে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে পরিবর্তন করে এমনভাবে তৈরি করা, যেন তা থেকে বিলুপ্ত ডোডো পাখির জনন কোষ তৈরি করা যায়। কলোসালের মতে, এটি ডোডোকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।

জেনেটিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ডোডো তৈরি করতে চায় কলোসাল, যেন ডোডো প্রকৃতিতে ফিরে যেতে পারে। ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য এটি জরুরি। তবে একটি-দুটি ডোডো তৈরি করতে চায় না তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস-ভিত্তিক এই কোম্পানি উলি ম্যামথ ও ডায়ার নেকড়ে ফিরিয়ে আনার কথা বলে এর আগে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছে। এখন তারা জিন সম্পাদনা করা মুরগি তৈরি করছে, যেটি ডোডোর সারোগেট বা গর্ভধারনের কাজ করবে। 

৫ মাস বয়সী ডায়ার নেকড়ে
ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

ডোডোর নিকটতম জীবন্ত আত্মীয় নিকোবর কবুতর। এই কবুতরের প্রিমোরডিয়াল জার্ম সেল মুরগির দেহে ইনজেক্ট করা হবে। এরপর জিন এডিটিং করে তৈরি করা হবে ডোডোর কাঙ্ক্ষিত শরীর ও মাথার আকৃতি। এই ডোডোকে জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ডিম দেবে মুরগিগুলো। এভাবে আমরা ফিরে পাব বিলুপ্ত প্রাণী ডোডো। 

আরও পড়ুন

কলোসালের প্রধান নির্বাহী বেন ল্যাম ডোডোকে ফিরিয়ে আনার সময়সীমা বলেছেন পাঁচ থেকে সাত বছর। এটি ফিরিয়ে আনতে ২০ বছর লাগবে না বলে দাবি করেছেন তিনি। ভারত মহাসাগরের মরিশাস দ্বীপে ইঁদুরমুক্ত নিরাপদ স্থান খুঁজছে কোলোসাল। ডোডোর নিরাপদ বিচরণের জন্য এটি জরুরি। ডোডো বিলুপ্তির আগে মারিশাস দ্বীপ ছিল ইঁদুরমুক্ত।  

জেনেটিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ডোডো তৈরি করতে চায় কলোসাল, যেন ডোডো প্রকৃতিতে ফিরে যেতে পারে। ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য এটি জরুরি। তবে একটি-দুটি ডোডো তৈরি করতে চায় না তারা। হাজার হাজার ডোডো তৈরি করবে এই বায়োটেক প্রতিষ্ঠান।

কেন বিলুপ্ত হয়েছিল

মরিশাস দ্বীপে একসময় ডোডোর কোনো প্রাকৃতিক শিকারি ছিল না। নিরাপদে এরা বসবাস করত। কিন্তু ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা যখন এই দ্বীপে এল, তখন থেকে শুরু হলো ডোডোর বিপর্যয়। নির্বিচারে ডোডো মারা শুরু হলো। এ ছাড়া আবাসস্থল ধ্বংস তো আছেই। ইউরোপিয়ানরা নিয়ে এল ফলভোজি ম্যাকাক (বানর), শূকর ও ইঁদুরের মতো প্রজাতি। এসব প্রাণী ডোডোর বাসা ও ডিমগুলো ধ্বংস করে ফেলে। এভাবে ফল-খেকো নিরীহ পাখিটি একদম বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী রিচ গ্রেনিয়ার এই প্রক্রিয়াকে একটি 'বিপজ্জনক' পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন

কলোসাল জানিয়েছে, ক্রিসপার জিন এডিটিং প্রযুক্তি দিয়ে ডোডোকে আবার আগের আবাসস্থলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে পাখি নিয়ে কাজ করা জটিল। প্রায় এক বছর ধরে জিন এডিটিং নিয়ে কাজ করার পর কলোসাল বিজ্ঞানীদের এই সাফল্য এসেছে। কবুতরের প্রিমোরডিয়াল জার্ম সেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। অবশ্য একদিন হঠাৎ করে হাজার হাজার ডোডোকে মরিশাসে দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হবে, এমন দাবি তারা করেনি। ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে, চিন্তাভাবনা করে এটি করা হবে। 

আরও পড়ুন
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী রিচ গ্রেনিয়ার এই প্রক্রিয়াকে একটি 'বিপজ্জনক' পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, জিন-সম্পাদিত প্রাণীগুলো হলো এক ধরনের 'সিমুলেশন'।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

ডায়ার নেকড়েকে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছিল কোলাসোল। নেকড়ের জিন সম্পাদনা করে এই প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ তখন এই জিন-সম্পাদিত প্রজাতিগুলোর সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এটি সেই আগের ডায়ার নেকড়ে নয়। জেনেটিকভাবে সম্পাদিত নতুন একটা কিছু, যেটা ডায়ার নেকড়ের মতো। এখন পরিবেশে মানুষের প্রভাব বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র। এসব জিন এডিটিং করা প্রাণীর ভূমিকা কী হবে? 

মরিশাস দ্বীপে একসময় ডোডোর কোনো প্রাকৃতিক শিকারি ছিল না
ছবি: ইউনিভার্সিটি অব সাউথাম্পটন

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী রিচ গ্রেনিয়ার এই প্রক্রিয়াকে একটি 'বিপজ্জনক' পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, জিন-সম্পাদিত প্রাণীগুলো হলো এক ধরনের 'সিমুলেশন'। অনেকটা মৃত স্বজনের এআই পোর্ট্রেটের মতো। তিনি বলেন, ‘যদি জিনগতভাবে তৈরি আধুনিক প্রজাতিকে বিলুপ্ত প্রজাতি হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়, তবে এটি একটি বড় ধরনের নৈতিক বিপদ তৈরি করবে। প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে যেসব কারণ, সেগুলোকে উৎসাহিত করা হবে। যেমন আবাসস্থল ধ্বংস, ব্যাপক হত্যা এবং মানুষের সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন।’ মানুষের ধারণা হতে পারে, ফিরিয়ে আনা তো যাবেই, ধ্বংস করলে কী ক্ষতি?

কলোসাল অবশ্য বলেছে, প্রাণীদের রক্ষার পাশাপাশি এই বিলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি চালমান রাখা উচিত। এটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন