পৃথিবীতে এত পাখি থাকতে আমরা শুধু মুরগি খাই কেন

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মানুষ এই লড়াকু পাখিদের দিয়ে বাজি ধরত

ফ্রাইড চিকেন, বাটার চিকেন, চিকেন নাগেট, বার্গার আমাদের অনেকের প্রিয় খাবার। কিন্তু এসব মুরগি ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ! আমরা প্রায় প্রতিনিয়ত মুরগি খাই। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাধারণ মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ৪৫ কেজি মুরগির মাংস খান। কিন্তু কখনো কি আয়েশ করে চিকেন ফ্রাই খেতে খেতে ভেবে দেখেছেন, পৃথিবীতে এত এত পাখি থাকতে আমরা শুধু মুরগিই খাই কেন? আমরা কি রাজহাঁস বা গাঙচিল খেতে পারতাম না?

আসলে মুরগিদের কপালটাই খারাপ! তবে এর পেছনে বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথমত, মুরগি উড়তে পারে না। বেশি মুরগি খাওয়ার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। এদের ছেড়ে দিলেও অন্তত উড়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। খামারে হাজার হাজার পাখি পালা মুরগির তুলনায় কঠিন। আবার মুরগি ধীর, শান্তশিষ্ট এবং একটু বোকা ধরনের প্রাণী। আর আমরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান হলেও বেশ অলস! তাই যে প্রাণীটা উড়ে পালায় না এবং সহজেই ধরা দেয়, সেটাই আমরা নিয়মিত খেতে চাই।

এখনো গভীর বনে দেখা মেলে বড় বন মোরগ। বন্য প্রাণীর শিকারিদের তৎপরতা এবং বন কমে যাওয়ায় এগুলো এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এই মুরগি এলো কোথা থেকে? মুরগি খাওয়ার গল্পটা অনেক পুরোনো। পোষা মুরগিরা নাকি এসেছে বনের লাল বনমোরগ থেকে। দেখতেও প্রায় এক, আর পোষও মানে। কিন্তু আধুনিক ডিএনএ বা জেনেটিকস পরীক্ষা বলছে, এটা ঠিক পুরোটা সত্যি নয়! আমরা এখন যে মুরগি খাই, তা হাইব্রিড বা সংকর প্রাণী।

হ্যাঁ, এরা লাল বনমোরগের বংশধর ঠিকই, কিন্তু এদের গায়ের যে হলদে চামড়া, এটা তারা পেয়েছে অন্য একটি ধূসর বনমোরগের প্রজাতি থেকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই দুই প্রজাতিকে মিলিয়েই আজকের এই পোষা মুরগি হয়েছে। এদের পালন করা অনেক সহজ।

আরও পড়ুন
রোমান সাম্রাজ্যের সময় মুরগির মাংস আর ডিম বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে মুরগির কপাল পুড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

তবে মজার ব্যাপার হলো, মুরগি কিন্তু খাওয়ার জন্য ছিল না, ছিল লড়াইয়ের জন্য! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষ প্রথম মুরগিকে পোষ মানিয়েছিল খাওয়ার জন্য নয়, বরং মোরগ লড়াইয়ের জন্য। শৈশবে স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় যে মোরগ লড়াই মানুষের মধ্যে হয়, তা কিন্তু নয়। সত্যি সত্যিই দুটি মোরগ লড়াই করত।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মানুষ এই লড়াকু পাখিদের দিয়ে বাজি ধরত, খেলা দেখত। এই মোরগ লড়াইয়ের কারণেই মুরগি প্রাণীটা সারা পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খাওয়ার অভ্যাসটা এসেছে এর অনেক পরে।

রোমান সাম্রাজ্যের সময় মুরগির মাংস আর ডিম বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে মুরগির কপাল পুড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন যুদ্ধ আর খরচের কারণে বাজারে গরু ও খাসির মতো লাল মাংস পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। ঠিক তখনই মানুষ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মুরগির দিকে ঝোঁকে। আর সেই যে শুরু হলো, তা আর থামেনি।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। মুরগি অনেক বেশি খাওয়া হলেও পাখি নয় কেন? কবুতর বা রাজহাঁসকে মানুষ মুরগির মতো খেল না কেন? মানুষ তো কবুতর ও রাজহাঁসও খায়। কবুতর তো হাজার হাজার বছর ধরেই মানুষ খাচ্ছে। কিন্তু মুরগির মতো এত জনপ্রিয় হলো না কেন?

আরও পড়ুন
কবুতর না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু রাজহাঁস? এটা তো দেখতেও সুন্দর, আকারেও বড়!

কারণ, কবুতর পালন করা মুরগির চেয়ে অনেক বেশি ঝামেলার। কবুতরের বাচ্চারা জন্মের প্রথম ১০ দিন তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিশেষ এক ধরনের দুধ খায়। একে বলে ক্রপ মিল্ক। খামারে কৃত্রিমভাবে এই দুধ তৈরি করা খুব কঠিন। মুরগি বা টার্কির মতো কৃত্রিম প্রজননও কবুতরের হয় না। তাই সব মিলিয়ে মুরগির চেয়ে কবুতর পালন করা একটু বেশি ঝামেলার।

আচ্ছা, কবুতর না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু রাজহাঁস? এটা তো দেখতেও সুন্দর, আকারেও বড়! আসলে রাজহাঁসেরও কিছু সমস্যা আছে। একসময় কিন্তু মানুষ প্রচুর রাজহাঁস খেত। পশ্চিম ইউরোপে, এমনকি ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি বা রানি প্রথম এলিজাবেথের রাজদরবারেও রাজহাঁস ছিল খুব প্রিয় এবং দামি খাবার। কিন্তু এই প্রচলনটা আর এগোয়নি। এর কারণ দুটি। এক, রাজহাঁসের মাংস রান্না করা ছিল খুব কঠিন। দুই, এর স্বাদে একটা বাজে আঁশটে গন্ধ ছিল, যা বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ হয়নি।

মোদ্দাকথা, আমরা মুরগিকে বেছে নিয়েছি কারণ এরা শান্তশিষ্ট, এদের পালন করা সহজ এবং এরা দ্রুত বড় হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, এদের মাংস খেতে অন্য পাখিদের চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু।

 

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স

আরও পড়ুন