ইতিহাসের প্রথম মানচিত্র কীভাবে বানানো হলো
আজকাল আমরা মোবাইলের ‘ম্যাপস’ অ্যাপ খুললেই মানচিত্র পেয়ে যাই। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে দূরত্ব নির্ণয় ও ছবি তোলার মাধ্যমে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। কিন্তু এককালে স্যাটেলাইট ছিল না। হাজার বছর আগে মানুষ তৈরি করেছিল প্রথম মানচিত্র। সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি…
সে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের কথা…
ঠিক এভাবে সাধারণত রূপকথার গল্প শুরু হয়। কিন্তু এটা রূপকথার গল্প নয়। তবে রূপকথার চেয়ে কমও নয়!
নতুন কোথাও যেতে হলে আমরা চট করে ‘ম্যাপস’-এর সাহায্য নিই। ম্যাপস মানে গুগল ম্যাপস। পকেটেই থাকে, স্মার্টফোনে। অচেনা রাস্তা? অচিন শহর? তাতে কী? স্মার্টফোন বের করে ম্যাপস অ্যাপটা চালু করলেই হলো। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাস্তাঘাট, অলিগলি। চাইলে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ‘প্রায় লাইভ’ ছবিও দেখা যায়। গুগল এখন রিয়েল টাইম বা তাৎক্ষণিক আপডেটও দেয়। কোথাও রাস্তা বন্ধ, জ্যাম বা কোনো সমস্যা—সব জানা যায় চট করে। বিদেশবিভুঁইয়ে বেড়াতে গেলে তাই এখন আর অতটা সমস্যায় পড়তে হয় না।
এককালে বিষয়টা এমন ছিল না। সেই সময়, যখন এসব ছিল না, তখন মানুষ কীভাবে পথ খুঁজে নিত? কীভাবে মানুষ প্রথম পৃথিবীর ছবি বা মানচিত্র আঁকার কথা ভাবল?
এ গল্প মানুষের কৌতূহলের এবং বিজ্ঞানের। সে গল্পই আজ বলব। চলুন, শুনে আসি পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র তৈরির গল্প।
২
সে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের কথা। মানুষ তখন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসবাস করত। তাদের পৃথিবীটাও ছিল খুব ছোট, নিজেদের গ্রাম বা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দূরের বিভিন্ন দেশ বা সাগর-নদীর কথা তারা কেবল লোকমুখে শুনত। এই লোকেরা কারা? তারা মূলত বণিক। ব্যবসার খাতিরে ঘুরে বেড়াত দেশ থেকে দেশান্তরে।
চলাফেরার জন্যই শুধু নয়, নিজেদের গ্রাম, শহর বা দেশের কোথায় কী আছে, সেসব জানার জন্যও কিছু একটা প্রয়োজন। এমন কিছু, যেটা একনজর দেখেই বোঝা যাবে, কোথায় কী আছে। এই তাড়নাটুকু মানুষ অনুভব করেছিল। এ তাড়না থেকেই জন্ম নেয় মানচিত্রের ধারণা।
কিন্তু ইতিহাসে প্রথম এককভাবে কেউ মানচিত্র তৈরি করেছেন—এমন বিশেষ কারও কথা জানা যায় না। বরং ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন শহর ও সভ্যতার মানুষেরা নিজেদের মতো করে মানচিত্র তৈরি করেছেন।
ইতিহাসের প্রাচীনতম যে মানচিত্রগুলোর কথা জানা যায়, তার মধ্যে ব্যাবিলনে পাওয়া একটি মানচিত্র উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এই মানচিত্র কিন্তু আজকের কাগজের মানচিত্রের মতো নয়। নরম মাটির চাকতিতে খোদাই করে তৈরি ওটা। গবেষকেরা বলেন, এই মানচিত্র একধরনের সিম্বলিক বা রূপক মানচিত্র; বাস্তব নয়। এমনটা বলার কারণ আছে। এ মানচিত্রে ব্যাবিলনকে দেখা যায় একদম কেন্দ্রে। এর কারণ, ব্যাবিলনের মানুষ নিজেদের শহরকে ভাবত পৃথিবীর কেন্দ্র। সে জন্যই তাদের মানচিত্রে ব্যাবিলন শহরটা মাঝখানে আর তাকে ঘিরে একটা নদী। সেই নদীর ওপারে কিছু কাল্পনিক দ্বীপের ছবিও আছে। অথচ ওতে পারস্য (আজকের ইরান) ও মিসরের চিহ্নও নেই। কিন্তু এই দুটি সভ্যতার কথা ব্যাবিলন যে শুধু জানত, তা–ই নয়, তাদের সঙ্গে লেনদেন এবং যুদ্ধ হয়েছে সভ্যতাটির। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এই মানচিত্রই আমাদের জানা প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড ম্যাপ’।
অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মানচিত্র গোল না হলেও সিলিন্ডার আকার পেয়েছে। কারণ, তিনি গোটা বিশ্বকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
ব্যাবিলনেই আরও প্রাচীন কিছু ‘স্থানীয়’ মানচিত্র পাওয়া গেছে। এ রকম একটি মানচিত্র পাওয়া যায় ১৯৩০ সালে, গা-সুরে। এই এলাকা বর্তমান উত্তর ইরাকের কার্কুক শহরের কাছে। এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে দুটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটা ‘রিভার ভ্যালি’—নদীসৃষ্ট নিচু ভূমি। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৫ হাজার অব্দের এ মানচিত্র প্রাচীনতম মানচিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ রকম চেক রিপাবলিক, অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু অঞ্চলের প্রায় একই সময়ের মানচিত্র পাওয়া গেছে। তবে এগুলো স্থানীয় মানচিত্র, বৈশ্বিক নয়।
ব্যাবিলনের পর বিশ্বকে ভালোভাবে মানচিত্রে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যানাক্সিম্যান্ডার। সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০ থেকে ৫৪৬ অব্দের কথা। তাঁর মানচিত্রে পৃথিবীকে দেখানো হয়েছে সিলিন্ডার আকারের। এ মানচিত্রের জন্য নাবিক ও বণিকদের কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করেন অ্যানাক্সিম্যান্ডার। কোথায় কোন নদী, কোথায় পাহাড়, এক শহর থেকে আরেক শহরের দূরত্ব কত—এসব তথ্য মিলিয়ে তিনি মানচিত্রটি তৈরি করেন। কালের খেরোখাতায় এটি হারিয়ে যায়। তবে ঐতিহাসিকদের লেখায় জানা যায় এর কথা।
এখানে ভূবিজ্ঞানের একটা মজার বিষয় বলা উচিত। অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মানচিত্র গোল না হলেও সিলিন্ডার আকার পেয়েছে। কারণ, তিনি গোটা বিশ্বকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দিগন্তের বেঁকে যাওয়া, বিভিন্ন জায়গার মধ্যকার দূরত্ব ইত্যাদি হিসাব কষে তিনি বুঝেছিলেন, পৃথিবীটা সমতল নয়। বক্র। তবে এটি যে গোলকাকার, তা তিনি বুঝতে পারেননি। ওদিকে স্থানীয় মানচিত্রগুলো ছিল একদম সমতল। কারণ, শুধু চোখের দেখায় আশপাশের অঞ্চলে বক্রতার বিষয়টি সহজে চোখে যেমন পড়ে না, তেমনি প্রয়োজনও হয় না এলাকা চেনার জন্য।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনার মাথায় প্রশ্নটা একবার হলেও উঁকি দিয়ে গেছে। প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা কীভাবে বড় বড় এলাকা, পাহাড় বা নদীর দূরত্ব মাপতেন? এখানেই বিজ্ঞানের আসল কেরামতি।
৩
প্রাচীন মানচিত্রকারেরা বড় বড় এলাকার দূরত্ব মাপার জন্য দুটি অসাধারণ কৌশল ব্যবহার করতেন।
এর মধ্যে দ্বিতীয়টি হলো কম্পাস। প্রথম কম্পাস আবিষ্কৃত হয় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে, চীনে। হ্যাঁ, কম্পাসও যথারীতি ‘মেড ইন চায়না’!
এই কম্পাস আবিষ্কারের ফলে দিক নির্ণয় অনেক সহজ হয়ে যায়। নাবিকদের আর সব সময় আকাশে চোখ রেখে হিসাব কষে বোঝার চেষ্টা করতে হতো না, জাহাজ কোন দিকে যাচ্ছে। মানুষ সহজে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চিনতে শুরু করল। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার অবস্থান বোঝা এবং তাকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলা অনেক সহজ হয়ে পড়ে।
কিন্তু কম্পাস তো প্রাচীনতম মানচিত্রের প্রায় ৪০০ বছর পরের কথা। এর আগে? কী করত মানুষ? এ বিষয় পড়ানো হয় গণিত বইয়ে আর অনেকেই খানিকটা ভয়, খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চায়। ঠিক ধরেছেন, এর নাম ত্রিকোণমিতি। তিন কোণের হিসাব-নিকাশ। পাঠ্যবইয়ে বহু দূরের কোনো গাছ ঝড়ের কারণে ভেঙে যাওয়াবিষয়ক যেসব গণিত দেখে অনেকে বিরক্ত হয়, সেই গণিতই আসলে প্রাচীন মানচিত্রের পেছনের ‘গোপন জাদু’। শুধু তা–ই নয়, এই ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে ইরাটেস্থোনিস নিজের এলাকায় বসে পুরো পৃথিবীর ব্যাস মেপে ফেলেছিলেন! ভাবা যায়!
ধীরে ধীরে মানচিত্র উন্নত হতে থাকে। মধ্যযুগে, প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে আঁকা এ রকম একটি বিখ্যাত মানচিত্রের নাম ‘ম্যাপা মুন্ডি’।
বাস্তবে ত্রিকোণমিতি কিন্তু খুব মজার। ধরুন, আপনি কোনো নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওপারে একটা বড় গাছ দেখা যাচ্ছে। ওই গাছের কাছে না গিয়েই খানিকটা ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে আপনি চাইলে বের করে ফেলতে পারবেন নদীটা কতখানি চওড়া। সে জন্য আপনাকে নদীর পাড় বরাবর দুটি বিন্দু ঠিক করতে হবে। এরপর প্রতিটি বিন্দু থেকে ওই গাছের কৌণিক অবস্থান মাপতে হবে। এরপর শুধু সূত্রে ফেলা, ব্যস! (সত্যি সত্যি সূত্রে বসিয়ে অঙ্ক কষব না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। বিষয়টা বুঝলেই চলবে।)
প্রাচীন সার্ভেয়ার, মানে ভূমি জরিপকারেরা ঠিক এ কাজই করতেন। তাঁরা পুরো এলাকাকে মনে মনে কতগুলো ত্রিভুজে ভাগ করে নিতেন। তারপর কয়েকটি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব মেপে এবং কোণ নির্ণয় করে বাকি বিশাল এলাকার মাপজোখ কাগজে-কলমে হিসাব করে বের করে ফেলতেন। কাজটা কঠিন, সময়সাপেক্ষও বটে; কিন্তু এর ফলেই প্রথমবারের মতো বড় আকারের এবং তুলনামূলকভাবে নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।
ধীরে ধীরে মানচিত্র উন্নত হতে থাকে। মধ্যযুগে, প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে আঁকা এ রকম একটি বিখ্যাত মানচিত্রের নাম ‘ম্যাপা মুন্ডি’ (Mappa Mundi)। লাতিন এই শব্দগুচ্ছের ইংরেজি অর্থ ‘ম্যাপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, মানে বিশ্বের মানচিত্র। এটার মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ধর্মীয় নানা দিক তুলে ধরা। কাজেই বিশ্বের মানচিত্রে দেখা মেলে স্বর্গ-নরকের। আর এর কেন্দ্রে? কেন্দ্রে ছিল জেরুজালেম। কারণটা বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
এরপর আরব ভূগোলবিদ ও বিজ্ঞানীরা আরও উন্নত ও নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও দূর সমুদ্রযাত্রায় তাঁদের এসব মানচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এভাবে হাজার বছর ধরে মানচিত্র উন্নত হতে হতে আমরা পেয়েছি আজকের গুগল ম্যাপস। অবিশ্বাস্য না?
কিন্তু আজ যখন আমরা গুগল ম্যাপস ব্যবহার করি, আমাদের মনে পড়ে না—মানুষের হাজার বছরের প্রচেষ্টা ও সফলতার এক আশ্চর্য স্বাক্ষর আমরা পকেটে করে বয়ে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন না হলেও মাঝেমধ্যে আমাদের এই কথাগুলো ভাবা উচিত, বিস্মিত হওয়া উচিত। এ অতীত স্মৃতি, শিকড়, বিস্ময় ও কৌতূহলই তো আমাদের পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার দিক-দিশা।
