পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কেন ডানহাতি

পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ মানুষই ডানহাতিছবি: ডিপজিটফটোস

পৃথিবীর প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ৯ জনই ডানহাতি। অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি। একটা ছোট্ট পরীক্ষা করেও দেখতে পারেন। আপনার আশপাশের দশ জন মানুষকে দেখুন তো, তাদের মধ্যে একজনের বেশি বাঁহাতি আছে কিনা। থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এভাবে যদি ২০ জন তার আশপাশের মানুষদের পরীক্ষা করে, তাহলে হয়তো সবাই মাত্র একজন করেই বাঁহাতি খুঁজে পাবেন না।

কারণ, পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ মানুষই ডানহাতি। এরমধ্যে আবার খুব কম মানুষ আছে, যারা দুই হাতেই সমান পারদর্শী। মজার ব্যাপার হলো, আপনি পৃথিবীর যে দেশেই যান না কেন, এই একই হিসাব পাবেন। এমন কোনো দেশ নেই যেখানে বাঁহাতিদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু কেন? কেন আমাদের বেশিরভাগই একটা ডান হাতকে বেশি গুরুত্ব দিই?

অনেকে ভাবেন, এটা হয়তো পরিবার থেকে এসেছে। কথাটা পুরোপুরি ভুল নয়। এশিয়া, আফ্রিকা বা আরবের অনেক দেশে বাঁ হাতকে অপরিষ্কার বা অশুভ মনে করা হয়। সেখানে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের জোর করে, এমনকি শাস্তি দিয়ে বাঁ হাত বেঁধে রেখে ডানহাতি বানানো হয়। এসব দেশে বাঁহাতির সংখ্যা তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম।

কিন্তু আসল কথা হলো, যেসব দেশে এমন কোনো সামাজিক চাপ নেই, সেখানেও বাঁহাতিরা সংখ্যালঘু! এই কারণেই বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। কী সেই রহস্য?

আরও পড়ুন
এশিয়া, আফ্রিকা বা আরবের অনেক দেশে বাঁ হাতকে অপরিষ্কার বা অশুভ মনে করা হয়। সেখানে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের জোর করে, এমনকি শাস্তি দিয়ে বাঁ হাত বেঁধে রেখে ডানহাতি বানানো হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই খেলাটা শুরু হয় আমাদের জন্মের অনেক আগে, মায়ের পেটে থাকতেই! এক গবেষণায় আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানে দেখা গেছে, মাত্র ১০ সপ্তাহের একটা ছোট্ট ভ্রূণও তার ডান হাতটা বাঁ হাতের চেয়ে বেশি নাড়াচাড়া করে। আর ১৫ সপ্তাহ বয়সেই বেশিরভাগ শিশু ডানদিকের বুড়ো আঙুল চুষতে শুরু করে!

বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের জিনের নকশাতেই ডানহাতি হওয়াটা যেন একটা ডিফল্ট সেটিং হিসেবে ঠিক করা আছে। প্রায় ৪০টির মতো জিন আছে, যারা আমাদের মস্তিষ্ককে এমনভাবে তৈরি করে যেন সে স্বাভাবিকভাবেই ডান হাতকে তার প্রধান শক্তি হিসেবে মানে।

কিন্তু তারপরেও তো কিছু মানুষ বাঁহাতি হয়। কেন? আসলে এর পেছনে নির্দিষ্ট একটা কারণ নেই। এটা মূলত একটা র‍্যান্ডম ব্যাপার। যখন মায়ের পেটে একটা শিশুর মস্তিষ্ক তৈরি হতে থাকে, তখন কিছু রাসায়নিক অণুর সামান্য তারতম্যের কারণেই হয়তো কেউ কেউ বাঁহাতি হয়ে যায়। এর পেছনে আলাদা কোনো জিন বা পরিবেশের প্রভাব নেই।

বিজ্ঞানীরা আরও ভেবেছিলেন, ডানহাতি হলে হয়তো বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই আমাদের পূর্বপুরুষেরা বেশিরভাগ ডানহাতি ছিলেন। তারা যখন প্রথম পাথর বা কাঠের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে শেখে, তখন থেকেই হয়তো ডান হাতের কদর বাড়ে। প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগের পুরানো যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করেও প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখেছেন, সেগুলো ডান হাতে ব্যবহারের জন্যই বেশি সুবিধাজনক ছিল।

আরও পড়ুন
এক গবেষণায় আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানে দেখা গেছে, মাত্র ১০ সপ্তাহের একটা ছোট্ট ভ্রূণও তার ডান হাতটা বাঁ হাতের চেয়ে বেশি নাড়াচাড়া করে।

মনোবিজ্ঞানী পল রডওয়ে আরও একটা মজার তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি বলছেন, এর পেছনে হয়তো যুদ্ধ-বিগ্রহের সম্পর্ক আছে। মধ্যযুগের কোনো তলোয়ার যুদ্ধের কথা ভাবুন। বেশিরভাগ মানুষের হৃৎপিণ্ড থাকে শরীরের বাঁ দিকে। একজন ডানহাতি যোদ্ধা যখন তলোয়ার চালাবে, সে সহজেই প্রতিপক্ষের বাঁ দিকে আঘাত করতে পারবে। মানে, যুদ্ধে একজন ডানহাতির হাতে একজন বাঁহাতির মারা পড়ার আশঙ্কা বেশি ছিল। ফলে যারা ডানহাতি, তারাই যুদ্ধ থেকে বেশি বেঁচে ফিরত। আর এই বাড়তি সুবিধার কারণেই হয়তো পৃথিবীতে ডানহাতিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

মধ্য ভারতে অবস্থিত ৫,০০০ বছরের পুরনো এই পাথরের চিত্রকর্মে প্রাচীন মানুষদের ডান হাতে তীর নিক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে
ছবি: ডিপজিটফটোস

ভাবতে পারেন, তাহলে বাঁহাতিরা টিকে থাকল কীভাবে? বাঁহাতিদেরও একটা বড় সুবিধা ছিল। তারা সংখ্যায় কম বলে তাদের চালচলন বোঝা খুব কঠিন ছিল! যুদ্ধে বা খেলায় একজন বাঁহাতি প্রতিপক্ষকে সামলানো খুবই কঠিন। কারণ, তাঁরা উল্টোদিক থেকে মারে। ক্রিকেটের কথাই ভাবুন। শুরুতে যে হিসেব দিয়েছিলাম, তাতে ১১ জন ক্রিকেটারের মধ্যে একজনের বেশি বাঁহাতি থাকার কথা নয়। কিন্তু খুঁজে দেখুন, প্রতিটি দলে একাধিক বাঁহাতি খেয়োলাড় আছে। কারণ, বাঁহাতিরাও কিছু বাড়তি সুবিধা করতে পারে। অনেক দল আবার ব্যাট করতে একজন বাঁহাতি ও একজন ডানহাতি ক্রিকেটার নামান। এতে প্রতিপক্ষের বোলাররা বিভ্রান্ত হন। 

অর্থাৎ, আমাদের সংস্কৃতি বা সমাজ হয়তো ঠিক করে দেয় যে, আমরা কোন হাত ব্যবহার করব। কথাটা ঠিক। কিন্তু আসল কাজটা হয়ে যায় আমাদের জন্মের আগেই। আমাদের জিনের কারণেই মস্তিষ্ক ডান হাতকে একটু বেশি পছন্দ করে। তবে বাঁহাতিরা সংখ্যায় কম হওয়ায় পায় বাড়তি সুবিধা!

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: পপুলার সায়েন্স

আরও পড়ুন