জিন থেরাপিতে জন্মগত বধির শিশুরা ফিরে পেল শ্রবণক্ষমতা!

জিন থেরাপির মাধ্যমে জন্মগত বধির শিশুরা ফিরি পেতে পারে শ্রবণক্ষমতাপ্রতীকী ছবি

সম্প্রতি বেশ কজন বধির শিশু শ্রবণক্ষমতা ফিরে পেয়েছে জিন থেরাপির ফলে। তাদের এই বধিরতা ছিল জন্মগত ও জিনগত। দুই ধরনের জিন থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, অর্থাৎ পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ভূমিকা রেখেছে এই শিশুদের শ্রবণক্ষমতা ফিরে পাওয়ায়।

দুটি পদ্ধতিতেই অটোফার্লিন নামে একধরনের প্রোটিনকে টার্গেট করা হয়। এই প্রোটিন থাকে অন্তঃকর্ণে। এটি শব্দ থেকে কম্পনটুকুকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে অনুবাদে স্নায়ুকে সহায়তা করে। ফলে মস্তিষ্ক এটা বুঝতে পারে ও শোনার অনুভূতি দেয়। এই প্রোটিনে মিউটেশন বা পরিবর্তনের ফলে ১-৮ শতাংশ শিশু বধির হয়ে জন্ম নেয়। এটি অবশ্য দুর্লভ একধরনের রোগ। গোটা পৃথিবীর আট বিলিয়নের মধ্যে দুই লাখের মতো মানুষ এতে আক্রান্ত।

এই ট্রায়ালে ছয় শিশু অংশ নেয়। চিনের শাংহাইতে অবস্থিত ফুডান বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এক হাসপাতালে তাদের এই চিকিৎসা দেওয়া হয় পরীক্ষামূলকভাবে

নতুন এই জিন থেরাপি চিকিৎসায় ক্ষতিকর নয়, এমন ভাইরাসের মাধ্যমে সক্রিয় ও কার্যকর অটোফার্লিন জিন সরাসরি অন্তঃকর্ণে প্রবেশ করানো হয়। প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই এসব চিকিৎসা কার্যকর। তবে এখনো এ নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা প্রয়োজন। চিকিৎসা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সংস্থার (এফডিএ) অনুমোদন পেতেও তাই অনেক দেরি।

এই গবেষণার ফলাফলকে অসামান্য বলে দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক ঝেং-ইয়ি চেন। একইসঙ্গে তিনি মাস আই অ্যান্ড ইয়ারের ইটন-পিবডি গবেষণাগারের সহযোগী বিজ্ঞানীও। একটি ট্রায়ালের সঙ্গে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘শিশুদের শ্রবণক্ষমতা প্রতি সপ্তাহে দ্রুত উন্নত হচ্ছিল। বিস্ময়কর ব্যাপার!’

চেন ও তাঁর সহযোগীদের সেই ট্রায়ালের ফলাফল গত ২৪ জানুয়ারি বিশ্বখ্যাত দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি এই ফলাফল অ্যাসোসিয়েশন ফর রিসার্স ইন অটোল্যারিঙ্গোলজির (এআরও) বার্ষিক সভায় উপস্থাপন করা হবে।

মাঝের শিশুটি ট্রায়ালে অংশ নেওয়া একজন, ডান পাশে তার বাবা
ছবি: চিলড্রেন'স হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়া

এই ট্রায়ালে ছয় শিশু অংশ নেয়। চিনের শাংহাইতে অবস্থিত ফুডান বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এক হাসপাতালে তাদের এই চিকিৎসা দেওয়া হয় পরীক্ষামূলকভাবে। চিকিৎসা দেওয়ার আগে তারা একদমই শুনতে পেত না। জন্মগতভাবে বধির এই শিশুদের বয়স ১-৬ পর্যন্ত।

ট্রায়ালে অ্যাডিনো-অ্যাসোশিয়েটেড ভাইরাসে করে তাদের এক কানে (পড়ুন, অন্তঃকর্ণে) কার্যকর অটোফার্লিন জিন প্রবেশ করানো হয়। জিন থেরাপির জন্য প্রায়ই এই ভাইরাস ব্যবহৃত হয়। এগুলোর নিজস্ব জিন অবশ্য বের করে নেওয়া হয়, তারপর ভাইরাসের ভেতরে প্রবেশ করানো হয় কার্যকর অটোফার্লিন জিন। বিজ্ঞানীরা অবশ্য একটি ভাইরাসে পুরো জিনটি প্রবেশ করাতে পারেননি। কারণ, এটি আকারে অনেক বড়। অর্ধেক করে দুটো ভাইরাসে প্রবেশ করানো হয় জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল। পরে ভাইরাস বাহক হিসেবে সেগুলো বয়ে নেয়।

অন্তঃকর্ণে এই ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়েছে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে। অন্তঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণকে যে পর্দা আলাদা করে রাখে, তার মধ্য দিয়েই এটি প্রবেশ করানো হয়। চিকিৎসার চার থেকে ছয় সপ্তাহ পরে শিশুদের শ্রবণক্ষমতা উন্নত হতে শুরু করে। ফুডান বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ট্রায়াল চালানো হয় ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে।

আরও পড়ুন

পরে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি ট্রায়াল চালানো হয়। আইসাম ড্যাম (Aissam Dam) নামের যে শিশুটির ওপর প্রথম এ চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, ইতিমধ্যেই সে শ্রবণক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। এক অনুবাদকের মাধ্যমে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে সে জানায়, ‘কোনো শব্দই আমার খারাপ লাগে না। শুনলেই ভালো লাগে।’

একইরকম চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে চীন এবং ইউরোপে। এই চিকিৎসা অনুমোদন পেলে নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে লাখো মানুষ। কিছুদিন আগে সিকল সেল অ্যানিমিয়া চিকিৎসায় জিন থেরাপি অনুমোদন পেয়েছে। সব মিলে জিন থেরাপির মাধ্যমে ভবিষ্যতে এতদিনের দুরারোগ্য অনেক রোগ থেকে মুক্তি মিলবে বলেই আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।