সিকল সেল অ্যানিমিয়া প্রতিকারে ক্রিসপার, এফডিএর অনুমোদন

সিকল সেল অ্যানিমিয়া প্রতিকারে ক্রিসপার প্রযুক্তিনির্ভর জিন থেরাপি হতে পারে সমাধানছবি: মার্ক গার্লিক/ সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সারিয়ে তুলতে সাধারণত ওষুধ সেবন, টিকাদান বা অস্ত্রোপচার করতে হয়৷ শত শত বছর ধরে শুধু এই কটি উপায় অবলম্বন করে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে৷ এরই ধারাবাহিকতায় চলমান গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে নতুন নতুন ওষুধ যেমন আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিও উন্নত হয়েছে দিনদিন৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এ প্রক্রিয়ার পরের ধাপ কী? বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের উত্তর, জিন সম্পাদনা বা জিন থেরাপি (Gene Therapy)।

ডিএনএর ভেতরের জিনকে বলা যায় জীবের কাজ ও গঠনের একক। জীবদেহ অসংখ্য কোষের সমম্বয়ে তৈরি (প্রচলিত অর্থে এটিকেই অবশ্য জীবদেহের একক বলা হয়)। এর মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন। এসব প্রোটিনই একটি কোষের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর ডিএনএর মধ্যকার জিনের কাজ হলো প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেওয়া। বিভিন্ন কারণে ডিএনএ বা জিনে পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রোটিন গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয় কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম। তখন ক্যান্সারের পাশাপাশি বেশ কিছু বংশগত রোগ হতে পারে (বেটা-থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি)৷ এ অবস্থায় দেহ থেকে মিউটেশন হওয়া জিনটি সরালে বা প্রতিস্থাপন করলে প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের৷ জিন সম্পাদনার এ পদ্ধতিকে বলে জিন থেরাপি। এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ের প্রযুক্তি। তা ছাড়া প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল৷ তবে গত ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন, এফডিএ (FDA) প্রথমবারের মতো সিকল সেল অ্যানিমিয়া প্রতিকারের জন্য জিন সম্পাদনার পদ্ধতির অনুমোদন দিয়েছে। এটি সত্যিকার অর্থেই একটি মাইল‌ফলক।

আরও পড়ুন
সিকল সেল অ্যানিমিয়া একটি বংশগত রোগ, বেটা-গ্লোবিন নামে একটি জিনে মিউটেশনের ফলে এ রোগ হয়

সিকল সেল অ্যানিমিয়া (Sickle Cell Anemia) একটি বংশগত রোগ। বেটা-গ্লোবিন (Beta-globin) নামে একটি জিনে মিউটেশনের ফলে এ রোগ হয়৷ বেটা-গ্লোবিন জিন মূলত রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়৷ এই জিনে মিউটেশন হলে হিমোগ্লোবিনের গঠন বদলে যায়। ফলে লোহিত রক্তকণিকা তার স্বাভাবিক আকার বদলে সিকল বা কাস্তের মতো হয়ে যায়। এ আকৃতি অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো। সিকল সেলের আকৃতি অস্বাভাবিক দেখে এটি রক্তনালিতে আটকে যায়। তখন রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় ও রক্তে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়৷

আরও পড়ুন

সিকল সেল অ্যানিমিয়া প্রতিকারের জন্য এফডিএ অনুমোদিত চিকিৎসা পদ্ধতিটির নাম ক্যাসজেভি (Casgevy)। যুগান্তকারী ক্রিসপার (CRISPR) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ক্যাসজেভি ব্যবহার করতে মূলত তিনটি জিনিস প্রয়োজন—ক্যাস৯ প্রোটিন, গাইড আরএনএ এবং সুস্থ জিন। গাইড আরএনএর কাজ হলো ক্যাস৯-কে গাইডের মতো পথ দেখিয়ে ডিএনএর যে জায়গায় পরিবর্তন আনতে চাই, সে জায়গায় পৌঁছে নিয়ে যাওয়া। আর ক্যাস৯ প্রোটিন আণবিক কাঁচির (Molecular Scissors) কাজ করে। অর্থাৎ আক্রান্ত ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশ ছেঁটে ফেলে৷ পরে ছেঁটে দেওয়া অংশটি সুস্থ জিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। সিকল সেল অ্যানিমিয়াও মোটামুটি একইভাবে নিরাময় করা সম্ভব৷ প্রথমে গাইড আরএনএ ব্যবহার করে রোগীর স্টেম কোষে ত্রুটিপূর্ণ বেটা-গ্লোবিন জিন শনাক্ত করে ক্যাস৯ প্রোটিনের আণবিক কাঁচি দিয়ে ছেঁটে ফেলা। পরে সে অংশটিতে বিজ্ঞানীদের সরবরাহকৃত সুস্থ জিন বসানো যায়। এই সুস্থ বেটা-গ্লোবিন জিন হিমোগ্লোবিন তৈরির যে নির্দেশনা দেয়, তার গঠন ঠিকঠাক থাকে৷ লোহিত রক্তকণিকাও তার স্বাভাবিক আকার বজায় রাখে।

আরও পড়ুন
ক্রিসপার-প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিন সম্পাদনা করলে রোগের মূল ফ্যাক্টর বা কারণটাই পুরোপুরি অপসারণ করা যায়

এর আগে সিকল সেল অ্যানিমিয়া সারাতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছিল একমাত্র প্রচলিত পদ্ধতি। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি প্রবল। এ ছাড়াও রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী দাতা (Donor) খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন। অন্যদিকে ক্রিসপার-প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিন সম্পাদনা করলে রোগের মূল ফ্যাক্টর বা কারণটাই পুরোপুরি অপসারণ করা যায়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের তুলনায় এ পদ্ধতি তাই বেশি নির্ভরযোগ্য। জিন থেরাপি প্রয়োগ করে রোগ নিরাময়ের উপায় বিজ্ঞানীরা এবারই প্রথম বের করেননি। এর আগে বেটা-থ্যালাসেমিয়াসহ বেশ কিছু রোগ সারাতে জিন থেরাপির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসবের কোনোটিতেই ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। অন্য সব প্রযুক্তির তুলনায় ক্রিসপার অনেক বেশি উন্নত, নিরাপদ ও কার্যকরী৷ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক কম।

ক্রিসপার একটি বিপুল সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। এর সাহায্যে জিনোম বা জিন বিন্যাস পরিবর্তন করে রোগ প্রতিকারের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল শস্যও উৎপাদন করা যায়৷ তবে অন্যসব প্রযুক্তির মতো এরও অপব্যবহার মানবজাতির অস্তিত্বকে নিয়ে যেতে পারে সংকটের মুখে৷ তাই এর ব্যবহার বিষয়ে সচেতন হওয়া আবশ্যক৷

লেখক: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ

সূত্র: ১. এফডিএ, বিজ্ঞানচিন্তা, নেচার