গাছ কি ঘুমায়
মানুষ কেন ঘুমায়? ঘুমায়, কারণ মানুষের দেহ একটা রাসায়নিক যন্ত্র। এই যন্ত্রেরও কাজ করার সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ করে মস্তিষ্কের। গোটা দেহের কোথায় কী ঘটবে, কোন ঘটনায় কেমন সাড়া দিতে হবে, সেসব কাজ পরিচালিত হয় মস্তিষ্কের নির্দেশনায়, বৈদুত্যিক সংকেতের সাহায্য। মস্তিষ্কের বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাছ সচল রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়ে শরীরকে অচেতন করার নামই হলো ঘুম।
মানুষের না হয় মস্তিষ্ক আছে, আছে অনুভূতি, চিন্তা করার ক্ষমতা, অবসাদ বা ক্লান্তিতে ভোগার ব্যাপার। তাই মগজের নির্দেশে শরীরকে খানিকটা অচল করে দিয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে মানবদেহ। গাছের তো মস্তিষ্ক নেই। তাই অবসাদ, ক্লান্তির অনুভূতিও তার থাকার দরকার হয় না। তবু কি গাছেদের ঘুমের দরকার হয়?
মানুষের শরীরে দেহঘড়ি বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা মানুষকে সময় সম্পর্কে সচেতন রাখে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর মানবদেহকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নেয়। এটাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম। সূর্যের আলো আর অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে এই রিদম কাজ করে।
সূর্যোদয়ের পর গাছেরা আড়মোড়া ভাঙে। শিথিল অবস্থা ভেঙে আবার পরিপূর্ণভাবে জেগে ওঠে। গাছের এই আচরণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন।
উদ্ভিদের দেহেও এমন রিদম কাজ করে। আলো আর অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ দেহেও এই চক্র সক্রিয় থাকে। এই চক্রই গাছকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করে। গাছ সেই বিশ্রাম নেয় রাতে। বিশ্রাম সেই ধরণ দেখে বিজ্ঞানীরা একে ‘গাছের ঘুম’ বলতেও রাজি।
গাছ দিনের বেলায় খাদ্য তৈরি করে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে। এ জন্য সূর্যের আলো থাকতে হবে অবশ্যই। রাতে সূর্যের আলো থাকে না, তাই বন্ধ থাকে স্বালোকসংশেষণ।গাছের কোষগুলোও সার্কাডিয়ান রিদম অনুযায়ী কাজ করে। দিনের বেলা এরা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাবার তৈরি করে। রাতে সেই খাবার সংরক্ষণ এবং কোষ পুনর্গঠনের কাজ করে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব প্ল্যান্ট সায়েন্সের গবেষক লুসি কোলের বলেন, ‘গাছ দিনের বেলা খাদ্য তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। খাদ্য থেকে আসা শক্তি পুনর্বণ্টন, কোষ পুনর্গঠন ও বৃদ্ধির কাজ রাতে করে।’
উদ্ভিদের দেহেও এমন রিদম কাজ করে। আলো আর অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ দেহেও এই চক্র সক্রিয় থাকে। এই চক্রই গাছকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করে। গাছ সেই বিশ্রাম নেয় রাতে।
ঠিক যেমনটা আমাদের মস্তিষ্ক করে। সারাদিন আমরা যে কাজ করি, সেগুলোর স্মৃতি মেমরি সেলে থেকে যায়। সেগুলো পুনর্গঠনের কাজ মস্তিষ্ক করে ঘুমের মধ্যে, দেহকে অনেকটা অসাড় রেখে।
লেজার স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০১৬ সালে গাছের পাতার অবস্থান এবং শাখার নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করেন ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার একদল গবেষক। তাঁরা খেয়াল করেন, রাতে গাছের পাতা কিছুটা নুয়ে পড়ে। কারণ, এ সময় গাছে পানি শোষণ এবং পরিবহন প্রক্রিয়া ধীর হয়ে আসে। গ্যাসের আদান-প্রদানও কিছুটা ধীর হয় রাতে। বেশিরভাগ গাছের পাতা কিছুটা শিথিল হয়। একেই গাছের বিশ্রাম বা ঘুম বলা যেতে পারে।
সূর্যোদয়ের পর গাছেরা আড়মোড়া ভাঙে। শিথিল অবস্থা ভেঙে আবার পরিপূর্ণভাবে জেগে ওঠে। গাছের এই আচরণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। তাঁরা এখন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এ বিষয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
এই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি গবেষক এনরি জিনো বলেন, ‘আমরা আধুনিক লেজার স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখেছি, গাছের পাতা রাতে নুয়ে পড়ে। এটা প্রাকৃতিক সার্কাডিয়ান রিদমের অংশ। এই আচরণ গাছের পানি সংরক্ষণ এবং কোষের কার্যক্রম ধীর করে দেয়।’
রাতে গাছের স্টোমাটা (পত্ররন্ধ্র) নামের রন্ধ্রগুলো আংশিক বন্ধ থাকে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণের হারও কমে যায়। সুতরাং, এই অবস্থাকে গাছের ঘুম বলা যেতে পারে।
মোদ্দাকথা হলো, গাছের ঘুমকে সরাসরি প্রাণীদের ঘুমের মতো বলা চলে না। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত, গাছের জৈবিক আচরণও রাত এবং দিনে ভিন্ন হয়। রাতের আচরণকে গাছের ‘বিশ্রাম’ বলা যায়। এটা গাছেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।