বনের পাখির খাদ্য ও পুষ্টি

আমরা পুষ্টিবিদের সহায়তা নিয়ে খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করি। এভাবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান অনেকে। কিন্তু বনের পাখিরা কীভাবে পুষ্টি পায়? কী খায় এরা? প্রকৃতির এই অজানা গল্প…

হরিয়াল পাখির প্রধান খাদ্য ফল। প্রিয় খাবার বটফল খাচ্ছে এক হরিয়াল। উনাইসার, কুমিল্লা, ২৮ জুনছবি: এম সাদেক

খাবারের পুষ্টিমান নিয়ে আমরা কতই-না ভাবি। কোন খাবার খেলে সঠিক পুষ্টি মিলবে, কোনটা শরীরের জন্য ভালো, কোন খাবারের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি—যতটা সম্ভব জানার ও বোঝার চেষ্টা করি। অনেকেই সে অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করি।

কিন্তু প্রকৃতিতে এত পাখি, এরা কীভাবে খাদ্য সংস্থান করে, কীভাবে পুষ্টি নিশ্চিত করে, কোন খাবারের মাধ্যমে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়, কখনো ভেবেছি আমরা?

আমরা অনেকেই বাসায় পাখি পুষি। তাদের জন্য খাবার কিনি। বাটিতে করে খাবার খাঁচার ভেতর দিলে পাখিরা খেয়ে নেয়। আবার পোষা পাখি অসুস্থ হলে আমরা তার শরীরে ওষুধ দিই। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই প্রাণিচিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করি। কিন্তু যে পাখি প্রকৃতিতে বাস করে, সে অসুস্থ হলে কে তার দেখভাল করে? কীভাবে নিরাময় হয় তার রোগ। বিষয়টি কি ভাবার নয়?

সে জন্য শুরুতে জানতে হবে, কোন পাখি কোন খাবার খায়? আমরা অনেকেই জানি, বেশির ভাগ পাখি পতঙ্গভুক। কীটপতঙ্গই এদের প্রধান খাদ্য। তবে অনেক পাখি আবার সর্বভুক, অর্থাৎ এরা সব খায়। কিছু পাখি মাছ খায়, কিছু প্রজাতির পাখি আবার শস্যদানা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ ও দেহের পুষ্টিসাধন করে।

পরিযায়ী বুনোহাঁসের মধ্যে পিয়াং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, পান্থামুখী, রাঙ্গামুড়ি, লালমুড়ি, বামুনিয়া, লালশির, নীলশির ও পাতারি হাঁসই প্রধান। কিছু হাঁস আবার শুধু মাছ খায়। যেমন সরুচঞ্চু হাঁস।

এই লেখা যখন লিখছি, শুনছি পাখির ডাক। ঢাকায় আমার বাসার ছাদে কিছু গাছ আছে। এর মধ্যে মেহেদি ও বরইগাছটি বেশ বড়। ভোর হলেই চড়ুই পাখিরা এই গাছ দুটিতে বসে। লক্ষ করে দেখলাম, সারাক্ষণই পাখিরা খাবার খুঁজতে ব্যস্ত। কখনো পাতায় ঠোকর দিচ্ছে, কখনো পোকামাকড়ের সন্ধানে এ–ডাল থেকে ও–ডাল করে বেড়াচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, পাখিরা প্রকৃতিতে টিকে থাকার চিরাচরিত নিয়মেই গড়ে ওঠা খাদ্যাভ্যাস থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। প্রকৃতির বেশির ভাগ পাখিই আমিষনির্ভর।

আরও পড়ুন

পাখিদের খাবার

আমাদের প্রকৃতিতে যে বুনো প্রজাতির হাঁস রয়েছে, সেগুলো মূলত জলজ আগাছা, শাকসবজি, কচি লতাপাতা, পোকামাকড়, ছোট মাছ ও শামুক খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে এদের বেশি পছন্দ শেওলা-শৈবাল। আবাসিক বুনোহাঁসের মধ্যে আছে সরালি, রাজসরালি, ঘরঘরি ও বালিহাঁস। আর পরিযায়ী বুনোহাঁসের মধ্যে পিয়াং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, পান্থামুখী, রাঙ্গামুড়ি, লালমুড়ি, বামুনিয়া, লালশির, নীলশির ও পাতারি হাঁসই প্রধান। কিছু হাঁস আবার শুধু মাছ খায়। যেমন সরুচঞ্চু হাঁস।

অন্যদিকে জলচর পাখির মধ্যে সৈকত পাখিরা উপকূলের সৈকত, নদী ও জলাশয়ের তীরে অথবা জোয়ার-ভাটার ডুবোচরে নরম কাদায় চঞ্চু ঢুকিয়ে খুদে শামুক, কাঁকড়া, পোকামাকড়, চিংড়িপোনা খুঁজে খুঁজে খায়। সৈকত পাখির মধ্যে আছে চাপাখি, মেটে জিরিয়া, চামচঠুঁটো চাপাখি, ডোরালেজ জৌরালি ইত্যাদি।

কৃষকের চাষ দেয়া জমিতে খাবার খুঁজে খাচ্ছে শামুকখোল পাখি
ছবি: সোয়েল রানা

এ ছাড়া দেশি যেসব জলচর পাখি আছে, এর মধ্যে পানকৌড়ি, বক—এরা খায় ছোট মাছ ও ব্যাঙ। বকের মাছ ধরে খাওয়ার ধরনটা আমাদের অনেকেরই জানা ও দেখা। জলচর পাখির মধ্যে শামুকখোল খায় বিশেষ প্রজাতির আপেল শামুক ও ছোট মাছ।

এবার আসা যাক বনের পাখির কথায়। ঘুঘু, ময়না, টিয়া, মুনিয়া—এরা খায় শস্যদানা। আবার কিছু পাখি আছে পোকাভুক, যেমন শালিক। ঘাসবনের পাখিরা, যেমন ফুটকি, চুটকি, টেসিয়া, ফিদ্দা অথবা চেরালেজ, এরাও পোকা ধরে খায়। কাঠঠোকরা সাধারণত গাছে পাওয়া পোকামাকড় খায়।

আমরা অনেকেই জানি, বেশির ভাগ পাখি পতঙ্গভুক। কীটপতঙ্গই এদের প্রধান খাদ্য। তবে অনেক পাখি আবার সর্বভুক, অর্থাৎ এরা সব খায়। কিছু পাখি মাছ খায়, কিছু প্রজাতির পাখি আবার শস্যদানা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ ও দেহের পুষ্টিসাধন করে।

প্যাঁচা, বাজপাখি, ইগল—সব কটিই শিকারি পাখি। প্যাঁচা ইঁদুর, মাছ, টিকটিকি ও ব্যাঙ শিকার করে। বাজপাখি শিকারের সন্ধানে বাতাসে উঁচুতে উড়ে বেড়ায় এবং ছোট প্রাণী, পাখি, টিকটিকি, সাপ ও পোকামাকড় শিকার করে। মাছমুরাল জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নখ দিয়ে মাছ ধরে খায়। বনমোরগ আর রাজকীয় চেহারার মথুরা পাখি কেঁচো, পোকা খুঁজে ফেরে ঝরা পাতার নিচে।

প্রকৃতিতে কিছু পাখি ফলমূল খেয়ে বাঁচে। যেমন নানা প্রজাতির কবুতর আর হরিয়াল। কোনো কোনো পাখি আমিষ ও শর্করা—দুটোই খায়। ফলনির্ভর ধনেশ আর বড় ঠোঁটের টুকান পাখি সুযোগ পেলে ছোট পাখি বা বাদুড় ধরে খায়।

আরও পড়ুন

পাখির পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব পাখি পুষ্টিসাধন করে শস্যের মাধ্যমে, সেসব প্রজাতির পাখি তাদের ছানাদের খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে কীটপতঙ্গ। কারণ, পাখির বাচ্চাদের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রচুর প্রোটিন বা আমিষের প্রয়োজন হয়। সেই আমিষ আসে পোকামাকড় ও এদের শূককীট থেকে। খাদ্যের জোগানের ওপরও পাখির খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে। কিছু প্রজাতির পাখি আছে, যারা একেক ঋতুতে একেক রকম পুষ্টি আহরণ করে।

বিশিষ্ট প্রাণী–গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বিজ্ঞানচিন্তাকে বলেন, কিছু প্রজাতির পাখি এমন কিছু খাদ্য গ্রহণ করে, যা তাদের সাধারণ খাদ্যতালিকায় থাকে না। ওই ধরনের বিশেষ খাদ্যগুলো খেয়ে তারা বিশেষ ধরনের পুষ্টি পায়, ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে সেলফ মেডিকেশন বলা হয়। পাখিসহ যেকোনো প্রাণী খাদ্য থেকে যেমন পুষ্টি সংগ্রহ করে, তেমনি ওষুধ হিসেবেও গ্রহণ করে। এটি পাখি প্রজাতির জীবনধারণের কৌশল।

নদীর তীরসংলগ্ন বাঁধে খাবারের খোঁজে হুদহুদ পাখি
ছবি: সোয়েল রানা

বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই পাখিরা নানা রকম প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ করে। এটিও প্রকৃতিতে টিকে থাকার প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট একধরনের ভারসাম্য।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসীর আকাশ বলেন, অনেক পাখিকেই পিঁপড়ার ঢিবির কাছে ধূলি-গোসল করতে দেখা যায়। পিঁপড়ার নিঃসৃত ফরমিক অ্যাসিড পাখির পালককে বহিঃপরজীবী বা উকুন থেকে দূরে রাখে। ২০২২ সালে জার্নাল অব অরনিথোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায়, জাপানে দামা, পেঙ্গা, চটকজাতীয় পাখিদের সাতটি ভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়াকে পালকে নেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।

হাঁস, রাজহাঁস ও অন্যান্য প্রজাতির বুনো জলচর পরিযায়ী পাখিরা অক্ষতিকারক ও স্বল্প প্রাণঘাতী রূপের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বহন করতে পারে। এই ভাইরাস বুনো পাখিকে অসুস্থ না করেই ছড়িয়ে পড়তে পারে এক পাখি থেকে অন্য পাখিতে

মুনতাসীর আকাশের মতে, কিছু রোগ আবার সেলফ লিমিটিং। যেমন পিজিয়ন-পক্স বাচ্চা কবুতর ও হরিয়ালের জন্য প্রাণঘাতী হলেও বড় পাখিদের জন্য তা নয়। কিছু পাখির অন্ত্র-নিঃসৃত জারক (এনজাইম) এত শক্তিশালী যে এনথ্রাক্সের জীবাণুকেও মেরে ফেলতে পারে। সব শকুনের এ সক্ষমতা আছে।

আরও পড়ুন

বুনো পাখিদের ঝুঁকি

তবে মানবসৃষ্ট কারণে ছড়ানো রোগজীবাণু নতুন নতুন হুমকি সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলা পাখিদের জন্য এগুলো নতুন এবং হঠাৎ সৃষ্ট। শকুন পচাগলা খেতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু স্টেরয়েড খাওয়ানো গবাদিপশুর মাংস খেলে কিডনি বিকল হয়ে শকুন দ্রুত মারা যায়।

বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করেন গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিচিকিৎসা অনুষদের সাবেক ডিন ও ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসক অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান। তিনি বিজ্ঞানচিন্তাকে বলেন, হাঁস, রাজহাঁস ও অন্যান্য প্রজাতির বুনো জলচর পরিযায়ী পাখিরা অক্ষতিকারক ও স্বল্প প্রাণঘাতী রূপের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বহন করতে পারে। এই ভাইরাস বুনো পাখিকে অসুস্থ না করেই ছড়িয়ে পড়তে পারে এক পাখি থেকে অন্য পাখিতে। ভাইরাসটি যদি এমন কোনো হাঁস-মুরগির খামারে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে অনেক হাঁস-মুরগি একসঙ্গে গাদাগাদি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে, তাহলে ভাইরাসটি ক্ষতিকারক ও উচ্চ প্রাণঘাতী রূপে পরিবর্তিত (মিউটেশন) হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সংক্রমিত পাখি আক্রান্তের কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। অবশেষে মিউটেটেড ক্ষতিকারক ভাইরাসটি বুনো জলচর পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এদেরও মেরে ফেলতে পারে। এমনকি আগে যেসব সামুদ্রিক পাখি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস-প্রতিরোধী ছিল (যেমন আলবাট্রস, পেঙ্গুইন), এরাও এখন বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। আছে মহামারির ঝুঁকিতে। বলা যেতে পারে, প্রাকৃতিক বালাই-প্রতিরোধী পাখিরা মানবসৃষ্ট রোগে অস্তিত্ব–সংকটেই পড়ে গেছে।

আরও পড়ুন
বুনো ফল খাচ্ছে হরিয়াল পাখি
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে শুনি যে পরিযায়ী পাখিরা বার্ড ফ্লু ছড়ায়। তাই মানুষ ভুল করে বিশ্বাস করে যে ‍বুনো পাখিরা হাঁস-মুরগির খামারে ভাইরাসের ক্ষতিকারক রূপ প্রবেশ করায়, যা পরে হাঁস-মুরগিকে মেরে ফেলতে ও মানুষকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। এ ভয় কখনো কখনো বুনো পাখিদের তাড়া করতে, এমনকি মেরে ফেলতে বাধ্য করে। বুনো পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে, যদি এরা ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে থাকে। কারণ, এরা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ভাইরাস ধ্বংস করার জন্য প্রাকৃতিক জলাভূমিতে জীবাণুনাশক স্প্রে করলে তা বাস্তুতন্ত্রের অনেক ক্ষতি করে। এটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অকার্যকর উপায়। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ অকেজো।

তাহলে উপায় কী? অধ্যাপক আমিনুর রহমানের মতে, বুনো পাখিদের এই রোগের হাত থেকে রক্ষা করার প্রধান উপায় হলো, হাঁস-মুরগির খামারে জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করা। জৈব নিরাপত্তা কী? এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্যান্য জীবাণু খামারে প্রবেশ এবং বের হওয়া রোধ করে হাঁস-মুরগি ও মানুষকে রক্ষা করা। জৈব নিরাপত্তা হাঁস-মুরগি, বুনো পাখি, বন্য প্রাণী ও মানুষের জন্য সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন