কনকনে শীত আর কুয়াশার চাদর। তার মধ্য দিয়ে সকাল সকাল একটি ভ্যান ছুটে চলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকা চড়ুইল বিলে। সেখানে পৌঁছে দেখি পাখিদের সৌন্দর্যের এক মোহনীয় প্রতিচ্ছবি, যা ছিল এক পাখপাখালির স্বর্গ। মৌলভী হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, পিয়াং হাঁস, সিথি হাঁসসহ অজস্র পরিযায়ী হাঁসের আনাগোনা। জিরিয়া, বাটান, চা-পাখি, জৌড়ালি, রাফ, লালপা, সবুজ পা ঈগল, বাজসহ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি। বগা-বগলা, ধূপনি বক, লালচে বকসহ দুটি কালা মানিকজোড় আর একঝাঁক কালোমাথা কাস্তেচরার দেখাও পেলাম। আছে রাঙা মানিকজোড় আর মদনটাকও। তবে এখানে এসে চোখ জুড়াবে যা দেখে, তা হলো কালাপাখ ঠেঙ্গি। ২০০-৪০০ পাখির ঝাঁক দেখে যে কেউই আকৃষ্ট হবেন।
মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তাদের নেই কোনো সীমানা। ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশগুলোর তো ভৌগোলিক সীমারেখা রয়েছে। আর দুই দেশ যেখানে মিলিত হয়, সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণা বলে, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যের ৫৭ শতাংশের খোঁজ মেলে এই এলাকাগুলোতে।
মানুষের চলাচল বা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কম থাকায় এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এই পরিবেশের গুণগত মান জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল হিসাবে খুব অনুকূল। তাই বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া এখানে রয়েছে স্থানীয় লতাগুল্ম, বৃক্ষে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। সব মিলে তৈরি হয়েছে সমৃদ্ধ এক প্রতিবেশ ব্যবস্থা। ফলে এই অঞ্চলগুলোতে খুব সহজেই বিপন্ন বা বিরল প্রজাতির প্রাণীদের দেখা মেলে। তাই সারা বিশ্বে এই আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকাগুলোকে জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।
আর দুই দেশ যেখানে মিলিত হয়, সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণা বলে, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যের ৫৭ শতাংশের খোঁজ মেলে এই এলাকাগুলোতে
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ। কিন্তু ছোট হলে কী হবে, দেশটি জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ওরিয়েন্টাল নামের প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চলে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ এই বাংলাদেশ। ইন্দোচায়না এবং ইন্দোবার্মার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের মিলন স্থলে অবস্থানের কারণে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার, যার মধ্যে রয়েছে ১৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭০০-এর অধিক প্রজাতির পাখি, ১৭০-এর অধিক সরীসৃপ এবং ৬৩ প্রজাতির উভচর। এই পাখিদের মধ্যে ৩৩৭ প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি, ২০৮ প্রজাতি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২ প্রজাতি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪ প্রজাতি পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯ প্রজাতি ভবঘুরে হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশের তিন দিকই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমানাবেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মায়ানমার, আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার, যার ৯৪ শতাংশ (৪ হাজার ৫৩ কিলোমিটার) ভারতের সঙ্গে এবং বাকি ৬ শতাংশ (১৯৩ কিলোমিটার) মিয়ানমারের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরায় রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমানাই পাহাড়ি বনে আচ্ছাদিত। ফলে বন্যপ্রাণীরা এই এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও বিচরণ করে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এর আয়তনের ৬০ ভাগ বাংলাদেশে, আর বাকি ৪০ ভাগ ভারতে। যদি বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এলাকা কোনটি? তাহলে একবাক্যে উঠে আসে সুন্দরবনের নাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, এখানে রয়েছে ৩২০ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে কিছু কিছু পাখি শুধু সুন্দরবনেই দেখা যায়। যেমন পুরো পৃথিবীতে মহাবিপন্ন কালোমুখ প্যারাপাখি, যার দেখা শুধু এই বনেই মেলে। এখানে বিচরণ করে চামচঠুঁটো বাটান, কুন, পালসি কুড়া ঈগল, বড় গুটি ঈগল, মদনটাকসহ অসংখ্য বিপন্ন প্রজাতির পাখি। রয়েছে অসংখ্য পরিযায়ী ও সৈকত পাখি। বিস্তৃত প্রাকৃতিক পরিবেশ, আন্তঃদেশীয় সীমানায় অবস্থান এবং দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে সুন্দরবন পেয়েছে এই প্রাণিবৈচিত্র্য।
বাংলাদেশের পদ্মা ও নিম্নপদ্মা অববাহিকার অঞ্চলগুলোর একটি বড় অংশ, বিশেষ করে জলাভূমি আন্তঃসীমানা এলাকায় অবস্থিত। এই আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোর বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে রয়েছে একাধিক বাঁওড়, বিল। এ ছাড়া বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরে রয়েছে অসংখ্য বিল। এই বিলগুলোকে কেন্দ্র করে টিকে আছে অসংখ্য পাখি। যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আইইউসিএনের লাল তালিকায় থাকা পাখিদের একটি বড় অংশ। সাদা গলা মানিকজোড়, মদনটাক, কালো গলা মানিকজোড়, রাঙা মানিকজোড়, ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস, বড় গুটি ঈগল, কালা মাথা কাস্তেচরা, বাংলা শকুন, দেশি গুটি ঈগল উল্লেখযোগ্য। প্রতি বছর এই বিল ও বাওড়গুলোতে আসে অজস্র পরিযায়ী পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, কাস্তেচরা, ডুবুরি, মানিকজোড়, সাপপাখি, পানকৌড়ি, লাল ঠেঙ্গি, বিভিন্ন প্রজাতির সৈকত পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য জলচর পাখি।
বাংলাদেশের আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোর নদীগুলো বন্যপ্রাণীর, বিশেষ করে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার একটি বদ্বীপ। এ দেশের শিরা-উপশিরার মতো প্রবহমান অসংখ্য নদনদী। পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মহানন্দাসহ আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য আন্তঃসীমানা নদী
বাংলাদেশের আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোর নদীগুলো বন্যপ্রাণীর, বিশেষ করে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার একটি বদ্বীপ। এ দেশের শিরা-উপশিরার মতো প্রবহমান অসংখ্য নদনদী। পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মহানন্দাসহ আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য আন্তঃসীমানা নদী। আর এই নদীগুলো এবং এর চরগুলো, বিশেষ করে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা পাখিদের এক অনন্য আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিদের এক বড় অংশের দেখা মেলে এই আন্তঃসীমানা এলাকার নদী ও চরগুলোতে। শীত মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীর আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোতে বসে অজস্র পাখির সমাহার। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় তিন শ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র এবং লালমনিরহাটের তিস্তা অববাহিকার মুখেও একই রকম অবস্থা দেখা যায়।
কালো মানিকজোড়, সাদা গলা মানিকজোড়, ইউরেশীয় চামচঠুঁটি, মদনটাক, কালো গলা মানিকজোড়, রাঙা মানিকজোড়, দেশি গাঙচোষা, ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস, বড় গুটি ঈগল, কালা মাথা কাস্তেচরা, বাংলা শকুন, শতদাগী ঘাসপাখি, দেশি গুটি ঈগল উল্লেখযোগ্য বিপন্ন প্রজাতির পাখি, যা দেশের বিপন্ন প্রজাতির পাখিদের একটি বড় অংশ। শীত মৌসুমে এই এলাকাগুলোতে আসে জলচর ও শিকারি পরিযায়ী পাখিদের একটা বড় অংশ। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁসে ভরে যায় চরগুলো। লেঞ্জা, পাতারি, বৈরাগী, বুনো রাজহাঁস, বামুনী, ভূতি, ফুলরি, সিথি, পিয়াং, মৌলভী, মার্গেন্সার, খুন্তে, গিরিয়া, চখাচখি উল্লেখযোগ্য বুনো হাঁস।
বিভিন্ন প্রজাতির ডুবুরি, বটেরা রাতচোরা, সারস, গগনবেড়, চামচঠুঁটো, কাস্তেচরা, মানিকজোড়, বিভিন্ন প্রজাতির সৈকত পাখি (খরমা, পাকরা উল্টোঠুঁটো, জিরিয়া, টিটি, বাটান, ডানলিন, চা পাখি, রাফ, চ্যেগা, জৌরালি, গুলিন্দা, কোয়েল বাবুবাটান, পানচিল, গাংচিল), ঘাসপাখি, প্রিনিয়া, ভরত, মুনিয়া, চটক এখানকার উল্লেখযোগ্য পাখি।
দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। ভারতের কোলঘেঁষা এই উপজেলার সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চা বাগান। সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতির বুকে বাসা বেঁধে আছে পাথরের স্তূপ। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ
দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। ভারতের কোলঘেঁষা এই উপজেলার সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চা বাগান। সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতির বুকে বাসা বেঁধে আছে পাথরের স্তূপ। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ। ডাহুক, করতোয়া ও মহানন্দা নদী বিধৌত বাংলাদেশের সর্বউত্তরের তেঁতুলিয়া উপজেলাকে উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম—এই তিন দিক থেকেই ঘিরে রেখেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব দিকে আছে পঞ্চগড় সদর উপজেলা। সৌন্দর্যের চাদরে মোড়ানো অঞ্চলটিতে প্রকৃতিপ্রেমীরা কান পাতলেই শুনতে পাবেন শত রকমের পাখির কলকাকলি। এখানে দেখা মেলে সব মিলে ১৭৪ প্রজাতির পাখি। তেঁতুলিয়ায় পাওয়া ১৭৪ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২২টি প্রজাতি স্থানীয়। বাকি ৫২টি প্রজাতি শীতকালীন অতিথি পাখি, যারা আমাদের দেশে উড়ে আসে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে। বনছাতারে, ঘুঘু, ফিঙে, কোকিল, মুনিয়া, খঞ্জন, ছাতিঘুরানি, শ্বেতাক্ষী, কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, পানকৌড়ি ইত্যাদি এখানকার উল্লেখযোগ্য দেশি প্রজাতির পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, সৈকত পাখি, ঘাস বনের পাখি, আঁশটে দামা, পরিযায়ী গায়ক পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য পরিযায়ী পাখি। এখানে আরও দেখা মেলে লাল ঘাড় কাস্তেচরার।
আইইউসিএন বাংলাদেশের লাল তালিকা অনুযায়ী, এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে বেশ কিছু ঝুঁকিগ্রস্ত প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে এখানে। এর মধ্যে দেশি গুটি ঈগল, চারটি সংকটাপন্ন(VU) প্রজাতির হলদে চোখ ছাতারে, বড় গুটি ঈগল, শেখ ফরিদ, মদনটাক, কালা মাথা কাস্তেচরা অন্যতম।
ভারতসংলগ্ন শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে জীববৈচিত্র্যে ঘেরা গারো পাহাড় অঞ্চল। গারো পাহাড় সংলগ্ন এই এলাকায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী পাখির বিচরণ।
টাঙ্গুয়ার হাওড় দেশের অন্যতম বৃহত্তর মিঠাপানির জলাশয়। বিশ্বব্যাপী এটি একটি রামসার সাইট হিসাবেও পরিচিত। শুধু টাঙ্গুয়ার হাওড় নয়; সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজারে রয়েছে এ রকম অসংখ্য সীমান্তবর্তী জলাশয়, যা জলচর পাখিদের, বিশেষ করে জলচর পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত। ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে এই হাওড়গুলো।
পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই সীমান্তবর্তী হাওড় এলাকাগুলো। বাংলাদেশে প্রাপ্ত ৩০ প্রজাতির বুনো হাঁসের মধ্যে ২৫ প্রজাতির দেখা মেলে এগুলোতে। এর মধ্যে বেয়ারের ভূতি হাঁস ও বৈকাল তিলি হাঁস, ফুলরি হাঁস অন্যতম। এ ছাড়াও লেঞ্জা, পাতারি, বৈরাগী, বুনো রাজহাঁস, বামুনী, ভূতি, সিথি, পিয়াং, মৌলভী, খুন্তে, গিরিয়া, চখাচখি উল্লেখযোগ্য বুনো হাঁস। কোঁড়া, কালেম, কুট, পাতি পান মুরগী, গুরগুরি, ডাহুক, ঝিল্লী, সারস, সৈকত পাখি (খরমা, কাদা খোঁচা, পাকরা উল্টোঠুঁটো, জিরিয়া, টিটি, লাল পা, সবুজ পা, বাটান, ডানলিন, চা পাখি, রাফ, চ্যাগা, জৌরালি, গুলিন্দা, পানচিল, গাংচিল), শিকারি পাখি, (পালসি কুড়া ঈগল, বড় গুটি ঈগল, দেশি গুটি ঈগল, মাছ মুরাল উল্লেখযোগ্য) ডুবুরি, গয়ার বা সাপ পাখি, পানকৌড়ি, বগা বগলা, কাস্তেচরা (খয়রা কাস্তেচরা, কালোমাথা কাস্তেচরা), চুটকি, ফুটকি, খঞ্জন, তুলিকা, ভরত, প্রিনিয়া, বাবুই, ঘাসপাখিসহ বিভিন্ন পাখির দেখা মেলে এই হাওড়গুলোতে। গবেষণার তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী পাখির প্রজাতির সংখ্যা ২২০-এর বেশি।
বাংলাদেশের পূর্বে সিলেট। চট্টগ্রামের বিশাল পার্বত্য অঞ্চল ঘেষে রয়েছে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মায়ানমারের বিস্তৃত পাহাড়ি বন। আর বাংলাদেশের এই আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। মিশ্র চিরসবুজ বন, পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঝিরি, ঝর্ণা মিলে এখানে অনন্য এক প্রতিবেশ ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে গড়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর জন্য এক অনন্য বাসস্থান। অধিকাংশ বনগুলো খণ্ডিত হলেও কাসালং সংরক্ষিত বন, সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রাজকান্দী সংরক্ষিত বন এখনও এক বৃহৎ পরিসরে বনভূমি ধারণ করছে। দেশের বিলুপ্তির ঝুঁকিগ্রস্থ মোট প্রাণীর সিংহভাগ এই বনগুলোকে কেন্দ্র করেই আছে। এমনকি বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্বের প্রমাণও এখানে পাওয়া গেছে। আর এর একটি প্রধান কারণ আন্তঃদেশীয় সীমানা এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
পাখিদের মধ্যে ধলাটুপি পায়রা, বাংলা শকুন, উদয়ী বামনরাঙা, খয়রাবুক ছাতারে, ধলামুখশ ছাতারে, কাঠমৌর, মথুরা, পাহাড়ি শিকরে ঈগল, রাজ ধনেশ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আরও বিরল প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এই আন্তঃসীমানা পাহাড়ি বনগুলোতো।
পুরো দেশের আন্তঃসীমানা এলাকার বন্যপ্রাণীর দিকে তাকালে বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের বন্যপ্রাণীর এক বড় অংশ এই আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোতে বসবাস করছে। বিশেষ করে বিপন্ন ও বিলুপ্ত প্রাণীরা। এমনকি দেশে প্রাপ্ত নতুন বন্যপ্রাণীদের বড় একটি অংশ এই আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। গত ১০ বছরে নতুন পাওয়া বন্যপ্রাণীর বড় অংশই এসব এলাকা থেকে পাওয়া। এদের বেশির ভাগই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে; যেমন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চর, পঞ্চগড়, নওগাঁ, নীলফামারী। এ ছাড়া আরও উল্লেখ্য আইইউসিএন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত সবুজ ময়ূর এবং ধূসর তিতিরের পুনরায় সন্ধান পাওয়া গেছে যথাক্রমে পঞ্চগড় এবং রাজশাহী থেকে।
কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের পদক্ষেপ না নিলে আমরা হারিয়ে ফেলব ওই এলাকাগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ, আর ধীরে ধীরে ওই পাখি তথা বন্যপ্রাণীগুলোকে। উক্ত এলাকাগুলোতে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের বিস্তৃতি এখন সময়ের দাবী। বুনো পরিবেশ সৃষ্টিতে বিচরণ বাড়বে পাখি আর সচেতনতায় মুক্তি মিলবে মানব-বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্ব। এ জন্য প্রয়োজন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ।
আন্তঃদেশীয় এলাকায় পাখি সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবী৷ বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সংরক্ষিত এলাকার বাইরের এলাকাগুলোতে। আর সবার সম্মিলিত উদ্যোগে সুরক্ষিত হবে দেশের বন্যপ্রাণী আর উপকৃত হবে মানুষ।