আমাদের শরীরেও বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু শক খাই না কেন

মায়েলিন আবরণটি একটি নিখুঁত ইনসুলেটর বা অন্তরক হিসেবে কাজ করে।ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

আমাদের মস্তিষ্কই পুরো শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, কথাটা মোটামুটি সবার জানা। কিন্তু মস্তিষ্ক এই কাজটি কীভাবে করে? বিদ্যুতের সাহায্যে। আমাদের স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভ সিস্টেম হলো শরীরের নিজস্ব বৈদ্যুতিক তার। এই তারের মধ্য দিয়েই মস্তিষ্ক থেকে সংকেত বা নির্দেশ আমাদের হাত, পা এবং অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছায়।

কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন আছে। ঘরের বৈদ্যুতিক তারে হাত দিলে আমরা ভয়ানক শক খাই। সেই বিদ্যুৎ মাটিতে চলে যেতে চায়। তাহলে আমাদের শরীরের ভেতরের এই বিদ্যুৎ কেন শরীর থেকে বেরিয়ে মাটিতে চলে যায় না? অথবা, আমরা কেন নিজেদের দেহের বিদ্যুতেই শক খাই না?

এর পেছনের মূল কারণ হলো, আমাদের শরীরের বিদ্যুৎ আর ঘরের লাইনের বিদ্যুৎ এক জিনিস নয়। ঘরের তারে যে বিদ্যুৎ আছে, তা হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। মানে এসি বা ডিসি কারেন্ট। কিন্তু আমাদের শরীরে যে বিদ্যুৎ চলে, তা একধরনের জৈব-বৈদ্যুতিক সংকেত। এটি মূলত সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো আয়ন বা চার্জযুক্ত কণার আদান-প্রদান।

আরও পড়ুন
ঘরের তারে যে বিদ্যুৎ আছে, তা হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। মানে এসি বা ডিসি কারেন্ট। কিন্তু আমাদের শরীরে যে বিদ্যুৎ চলে, তা একধরনের জৈব-বৈদ্যুতিক সংকেত।

তবে এই সংকেতগুলোও এক ধরনের বিদ্যুৎ। আর এই বিদ্যুৎকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য আমাদের স্নায়ুগুলোর ওপরে একটি চমৎকার আবরণ বা ইনসুলেশন রয়েছে। ঘরের বৈদ্যুতিক তারের ওপর যেমন প্লাস্টিক বা রাবারের আবরণ থাকে, আমাদের স্নায়ু বা নার্ভের ওপরেও ঠিক তেমনই একটি বিশেষ আবরণ থাকে। এই আবরণটি চর্বিযুক্ত টিস্যু দিয়ে তৈরি। এর নাম মায়েলিন শিথ।

এই মায়েলিন আবরণটিই হলো আসল নায়ক। এটি একটি নিখুঁত ইনসুলেটর বা অন্তরক হিসেবে কাজ করে। বৈদ্যুতিক সংকেতকে স্নায়ুর বাইরে ‘লিক’ হতে বা অন্য কোষে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয় এটি। মস্তিষ্কের পাঠানো জরুরি বার্তাটি যেন ঠিক পথেই তার গন্তব্যে পৌঁছায়, তা এই মায়োলিনই নিশ্চিত করে।

মায়েলিন আবরণের আরও একটি জাদুকরী ক্ষমতা আছে। এটি সংকেত চলাচলের গতিকে অবিশ্বাস্যরকম বাড়িয়ে দেয়। এই আবরণের কারণেই আমাদের স্নায়ু সংকেত ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে।

আরও পড়ুন
মায়েলিন আবরণটি একটি নিখুঁত ইনসুলেটর বা অন্তরক হিসেবে কাজ করে। বৈদ্যুতিক সংকেতকে স্নায়ুর বাইরে ‘লিক’ হতে বা অন্য কোষে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয় এটি।
মায়েলিন আবরণের কারণেই আমাদের স্নায়ু সংকেত ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে।
ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

এই আবরণটি না থাকলে বা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলে কী হতো? মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস নামে একটি ভয়াবহ রোগ আছে। এই রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে এই মায়েলিন আবরণকেই আক্রমণ করে। ফলে মস্তিষ্কের সংকেত ঠিকমতো শরীরে পৌঁছাতে পারে না। তখন রোগীর কথা বলা, হাঁটাচলা এবং এমনকি দেখতেও মারাত্মক সমস্যা হয়। সুতরাং, মায়োলিনের আবরণ না থাকলে শরীর যে ভারি বিপদ হতো, তা তো বুঝতেই পারছেন। এটিই আমাদের সংকেতগুলোকে নিরাপদে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আমাদের সচল রাখছে।

অর্থাৎ আমাদের শরীরেও যে বিদ্যুৎ আছে, তা একেবারে নিজের মতো করে কাজ করে। এই বিদ্যুৎ আমাদের দেহের ভেতরের এক বিশেষ ভাষা, যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলে দেয় কী করতে হবে, কখন নড়তে হবে, কখন থামতে হবে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ বাইরের বিদ্যুতের মতো নয়, তাই শকের ভয়ও নেই।

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস ম্যাগাজিন, ব্রিটানিকা এবং ন্যাশনাল এমএস সোসাইটি, ইউকে

আরও পড়ুন