বৃষ্টির দিনে আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর পরপরই শোনা যায় বিকট শব্দ। কখনো মৃদু, আবার কখনো চারপাশ কাঁপিয়ে। এই দৃশ্য আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি ও দেখেছি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন সবসময় বিদ্যুৎ চমকানোর পরে শব্দ শোনা যায়? কিংবা মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে তৈরি আলোর ঝলকানি থেকে কীভাবে জন্ম নেয় এমন প্রকাণ্ড গর্জন? চলুন, বিস্তারিত জেনে নিই।
বজ্রপাতের পেছনে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের একটি সহজ ব্যাখ্যা। আলো ও শব্দের গতির পার্থক্যের কারণে আগে বিদ্যুৎ চমকায়, পরে শব্দ শোনা যায়। কিন্তু বজ্রপাত হয় কীভাবে? আর কখন মেঘ থেকে বিদ্যুৎ মাটিতে নেমে আসে?
সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠের কাছের বাতাস গরম হয়ে ওঠে। আমরা জানি, তাপ পেলে যেকোনো জিনিসের অণুগুলো একটু দূরে সরে যায়। ফলে জিনিসটা প্রসারিত হয়। বাতাসের ক্ষেত্রেও তাই হয়। অণুগুলো দূরে সরে গেলে বাতাস হালকা হয়ে যায়। কারণ, একক ঘনত্বে কমে যায় বাতাসের অণুর পরিমাণ। এখানে একক হিসেবে যদি মিটার ধরে নিই, তাহলে ১ ঘনমিটার আয়তনে বাতাসের অণুর পরিমাণ কমে যায়। হালকা এই উষ্ণ বাতাস ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। আর ওপরের দিকের শীতল বায়ু নেমে আসে নিচের দিকে। ফলে বিপরীতমুখী বায়ুর সংঘর্ষ হয়। তখন সেগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে।
প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে এই প্রক্রিয়া থেকে তৈরি হয় বিশাল বজ্রমেঘ। এর নাম ‘কিউমুলাস নিমবাস’। এই মেঘ প্রায় ১০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই উচ্চতা পর্যন্ত তাপমাত্রা কমতে থাকলেও এর ওপরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে। ফলে মেঘের ওপরের অংশে থাকা ঠান্ডা বাতাস এক অদৃশ্য তাপীয় দেয়ালে ধাক্কা খায় এবং মেঘ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
একই সময়ে মেঘের ভেতরে চলতে থাকে ইলেকট্রনের খেলা। বাতাসের কারণে মেঘের ভেতরের অসংখ্য পানির কণা বরফের কণার সঙ্গে অনবরত ঘষা খায়।
মেঘের ভেতরে যত বেশি জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়, পানির ফোঁটাগুলো তত বড় হতে থাকে। আর মেঘের ওপরের ঠান্ডা অংশে বরফকণা তৈরি হয়। এই পানি ও বরফের কণাগুলো যখন যথেষ্ট ভারী হয়ে যায়, তখন বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি হিসেবে সেগুলো নিচে ঝরে পড়ে। ফলে ঠান্ডা বাতাসের একটি দ্রুত প্রবাহ নিচে নেমে আসে এবং মাটির কাছাকাছি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ করে এই ঠান্ডা বাতাস তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে তীব্র গরম থেকে স্বস্তি আসে।
একই সময়ে মেঘের ভেতরে চলতে থাকে ইলেকট্রনের খেলা। বাতাসের কারণে মেঘের ভেতরের অসংখ্য পানির কণা বরফের কণার সঙ্গে অনবরত ঘষা খায়। এতে পানি ও বরফের কণা থেকে ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে বরফের বড় বড় কণাগুলোতে চলে যায়। ফলে মেঘের ওপরের অংশে ভারী এবং ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন (-) জমা হয়, আর নিচের অংশে তৈরি হয় ধনাত্মক চার্জ (+)। অর্থাৎ, মেঘের ওপর ও নিচের অংশে উল্টো চার্জ জমা হয়। এতে তৈরি হয় বিভব পার্থক্য। এই পার্থক্য যথেষ্ট বেশি হলে হঠাৎ করে বেশি চার্জের জায়গা থেকে কম চার্জের জায়গায় প্রচণ্ড বিদ্যুৎ বয়ে যায়। বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকে তীব্র তাপ এবং কম্পন তৈরি হয়, যা আমরা শব্দ ও আলো হিসেবে দেখি। এটাই বজ্রপাতের কারণ। মেঘ থেকে ঘণ্টায় প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মাইল গতিতে প্রবাহিত হয় এই ইলেকট্রনের স্রোত। প্রচণ্ড এই বিদ্যুতের প্রবাহই হলো বজ্রপাত। আমরা এটাকে আঁকাবাঁকা আলোকরশ্মি হিসেবে দেখি।
এছাড়াও মেঘের ঋণাত্মক চার্জ মাটির ইলেকট্রনকেও প্রভাবিত করে। ফলে মাটিতে ধনাত্মক চার্জ তৈরি হয়। এখানেও মেঘ ও মাটির মধ্যে উল্টো চার্জের কারণে বিভব পার্থক্য তৈরি হয়। এই পার্থক্য যথেষ্ট হলে মেঘ থেকে মাটিতে তীব্র বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একে আমরা মেঘ থেকে মাটিতে নেমে আসা বজ্রপাত অর্থাৎ ক্লাউড-টু-গ্রাউন্ড বজ্রপাত হিসেবে চিনি।
আর বজ্রপাতের আওয়াজ ও বিদ্যুতের ঝলকানির মধ্যে সময়ের ব্যবধানের মূল কারণ হলো আলো ও শব্দের গতির বিশাল পার্থক্য। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে। ঘণ্টায় এই গতি প্রায় ১০৮ কোটি কিলোমিটার। সংখ্যাটা হয়তো এখনো আপনার কাছে বিশাল মনে হচ্ছে না। একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, পুরো পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসতে একটি বিমানের দুই দিনেরও বেশি সময় লাগে। অথচ আলো মাত্র ১ সেকেন্ডে পৃথিবীকে ৭ বারেরও বেশি ঘুরে আসতে পারে। বুঝতেই পারছেন আলোর গতি কতটা।
আপনি যখন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখার কিছুক্ষণ পর বজ্রের শব্দ শুনতে পান, তখন বুঝবেন বজ্রপাত আপনার থেকে বেশ দূরে হয়েছে।
এখন আসা যাক শব্দের দিকে। শব্দ প্রতি সেকেন্ডে মাত্র প্রায় ৩৪৩ মিটার বেগে চলে। অর্থাৎ আলোর গতির তুলনায় অনেক ধীর। যখন আকাশে বজ্রপাত হয়, তখন একই সময়ে বিদ্যুতের ঝলকানির আলো ও বজ্রের শব্দ—দুটোই তৈরি হয়। কিন্তু যেহেতু আলোর গতি অনেক বেশি, তাই বিদ্যুতের ঝলকানি আমাদের চোখে মুহূর্তেই ধরা পরে। শব্দ অনেক ধীরে চলার কারণে তা আমাদের কানে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নেয়। ফলে আমরা আগে আলো দেখি, তারপর শুনি শব্দ।
আরেকটা বিষয় রয়েছে এখানে। এই ঝলকানির সময় বিদ্যুৎ যে পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানকার বাতাস মুহূর্তেই প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাতাসের এই আকস্মিক ও তীব্র গরম হওয়ার কারণে এটি দ্রুতগতিতে প্রসারিত হয়। এই দ্রুত প্রসারণের ফলে বাতাসে একটি সনিক শক ওয়েভ তৈরি হয়। তখন জানালার কাঁচ কেপে ওঠে।
আপনি যখন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখার কিছুক্ষণ পর বজ্রের শব্দ শুনতে পান, তখন বুঝবেন বজ্রপাত আপনার থেকে বেশ দূরে হয়েছে। আর যদি আলোর ঝলকের সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশ কাঁপিয়ে বিকট শব্দ শোনেন, তাহলে বুঝতে হবে বজ্রপাত আপনার খুব কাছেই পড়েছে।
তবে বজ্রপাত আপনার থেকে কত দূরে হচ্ছে, তা হিসাব করার একটি সহজ উপায় আছে। বিদ্যুতের ঝলকানি দেখার পর থেকে বজ্রের শব্দ শুনতে পাওয়া পর্যন্ত সময়টা গুণতে হবে। প্রতি ৫ সেকেন্ডে শব্দ যদি আপনার কানে পৌঁছায়, তাহলে বজ্রপাত আপনার থেকে প্রায় ১ মাইল বা ১.৬ কিলোমিটার দূরে হচ্ছে। অর্থাৎ, যত বেশি সময় লাগবে শব্দ শুনতে, বজ্রপাত তত দূরে হচ্ছে।