পাখিরা বাসা বানায় কেন

তালগাছের ডালে পুরাতন বাসা মেরামত ও নতুন বাসা বোনার কাজ করছে বাবুই পাখিরাছবি: সুপ্রিয় চাকমা

বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে—সবাইকে নিয়ে মানুষের পরিবার। তবে পাখিদের এমন পরিবার নেই। কিছু পাখি দলবেঁধে বাস করে বটে, কিন্তু মানুষের মতো পাখিদের স্থায়ী ঘর-বাড়ি দরকার হয় না। তাহলে পাখিরা ঘুমায় কোথায়? গাছের ডালে, ঝোপে-ঝাড়ে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিতে পাখিরা কীভাবে বাঁচে? কোথায় আশ্রয় নেয়? গাছের বড় পাতার নিচে, ঘন ঝোপের আড়ালে কিংবা মানুষের ঘরবাড়ির কার্নিশের নিচে। অবশ্য বড় ঝড়ে পাখিদের খুব কষ্ট। তাই ঝড়ের পরে প্রায়ই পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় পথে-ঘাটে। বাসায় থাকলে আর মরতে হতো না।

পাখির বাসার যে আকার, তাতে কি ঝড় বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া যায়? আসলে, ঝড়ে খুব সহজেই পাখির বাসা উড়ে যেতে পারে। সে জন্য কি পাখিরা বাসা বানায় না? বানায়। তবে নিজেদের জন্য নয়। যখন ওদের ডিম পাড়ার দরকার হয়, তখন পাখিদের বাসা বানাতে হয়। গাছের ডালে কিংবা পাতায় তো আর ডিম পড়া যায় না। ডিম গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। তাই বাটির মতো কিছু একটা দরকার হয়। এ জন্য পাখিরা বাসা বানায়। তারপর ডিম ফুটে ছানা বেরোয়। কিন্তু সেই ছোট্ট ছানারা তো আর উড়তে পারে না। তাই ওদের আরাম-আয়েশের জন্য দরকার হয় বাসা। ছানাদের শীত-গরম আর ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতেও বাসার দরকার হয়।

পাখির আকার যেমন, বাসার আকারও তেমন হয়। যেমন টুনটুনি ছোট পাখি, এর বাসা তাই খুব ছোট। অন্যদিকে শামুকখোল, ঈগল কিংবা মদনটাক পাখি আকারে বিশাল হওয়ায় এদের বাসাও অনেক বড়।

আরও পড়ুন

পাখি কোথায় বাসা তৈরি করে

বাসা তৈরির জন্য যেকোনো পাখি সাধারণত দুটো জিনিস মাথায় রাখে। প্রথমেই বাসার নিরাপত্তা। অর্থাৎ শত্রুদের হাত থেকে নিরাপদ থাকে, এমন জায়গায় বাসা করে। সহজে শিয়াল উঠতে পারে না, বিড়াল বা বনবিড়ালের দৃষ্টির আড়ালে থাকে, এমন জায়গায় বাসা করে পাখিরা। ছোট পাখিরা গাছের চিকন ডাল বেছে নেয়। কারণ, বনবিড়াল আর সাপের দৃষ্টিগোচর হলেও যাতে অত চিকন ডালে যেতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। শকুন, ঈগল ও কাকের মতো পাখি অনেক বড় গাছের মগডালে বাসা বানায়। ওদের বাসায় অত সহজে শত্রু হামলা করতে পারে না ভয়ে।

কিছু কিছু পাখি আবার গাছের কোটরে বাসা করে। কিছু পাখির বাসা এমনভাবে পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকে, চোখের সামনে থাকলেও সহজে দেখা যায় না। কিছু পাখি আবার খাল বা নদীর খাড়া পাড়ে গর্ত করে বাসা বানায়। কিছু পাখির বাসা ঘরের ফাটলে, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে, বাড়ির জানালার কার্নিশ, এমনকি ঘরের কড়িকাঠের ভেতর দেখা যায়।

৬. ঝোপের আড়ালে বোনা বাসা থেকে মুখ বের করে আছে মৌটুসি পাখির ছানা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

কাঁচাঘরের চালের ভেতরও বাসা করতে দেখা যায় অনেক পাখিকে। কিছু পাখি মাটিতেও বাসা বানায়। আবার কিছু পাখি বাসা বাঁধে পানিতে, ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ভেতরে। তবে যেখানেই বাসা বাঁধুক, পাখিরা একটা বিষয় নিশ্চিত করে তবেই বাসা বানায়। সেটা হলো খাদ্যের পর্যাপ্ত জোগান থাকতে হবে আশপাশে। কারণ, বাসায় ডিম বা ছানা থাকলে পাখিরা বেশি দূর উড়ে গিয়ে বাসা বাঁধতে পারে না। তাই এমন জায়গায় বাসা বাঁধতে হয়, যেখানে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে।

হাঁস পাখিসহ বেশিরভাগ জলচর পাখিরা বাসা বানায় পানির ওপর। কচুরিপানা ও জলজ লতাপাতা দিয়ে তৈরি ভাসমান সেই বাসা।

আরও পড়ুন

পাখি কখন বাসা বাঁধে

সব পাখির প্রজনন কাল এক নয়। কোনো পাখি বসন্তে বাসা বানায়, কোনো পাখি বর্ষায়। আবার কোনো পাখি শরতে। বাংলাদেশের পাখিদের শীতকালে বাসা বাঁধতে তেমন দেখা যায় না। একেক পাখি একেক সময় বাসা তৈরি করে। কিন্তু কেন?

উদ্যানের গাছ কাটার ফলে পাখিগুলো আবাস হারাবে। চারুকলার শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে বানিয়েছেন পাখির বাসা

কারণটা খুব সহজ। সব পাখির খাদ্য তালিকা এক নয়। যে পাখির খাদ্য যখন বেশি পাওয়া যায়, সেই পাখি তখন বাসা বাঁধে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ পাখি বাসা বাঁধে বসন্ত ও গ্রীস্মকালে। শীতকালে বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে যায়। এ সময় পোকার আক্রমণও কম থাকে। পাখির ছানাদের অন্যতম খাদ্য হলো শুঁয়োপোকা। বাংলাদেশে যেসব শুঁয়োপোকা দেখা যায়, এগুলোর বেশির ভাগই প্রজাপতি নয়তো মথের লার্ভা। প্রজাপতি আর মথেরা সাধারণত শীতকালে ডিম পাড়ে না। তাই শীতে শুঁয়োপোকার অভাব দেখা যায়। এ ছাড়া ঘাস ফড়িং, উচ্চিংড়ে বা বিছাও বসন্তকালে বেড়ে যায়। সুতরাং পাখির ছানাদের খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাবার বসন্তকালে থাকে। তাই বেশির ভাগ পাখিই বসন্ত ও গ্রীষ্মে বাসা বাঁধে।

আর বেশির ভাগ জলজ পাখি বাসা বাঁধে বর্ষাকালে। এ সময় এদের খাদ্যের জোগান অনেক বেশি থাকে। অন্যদিকে লাল মুনিয়া, নীলটুনিরা বাসা বানায় শীতকালে। নানা ধরনের পাখির নানারকম বাসা নিয়ে পরের কোনো লেখায় আলোচনা করব।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও বিবিসি সায়েন্স ফোকাস

আরও পড়ুন