দেহঘড়ি
সুপারবাগের কবলে বিশ্ব, উপায় কী
ব্যাকটেরিয়া যখন অ্যান্টিবায়োটিকের মুখোমুখি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেও টিকে থাকার চেষ্টা করে। ফলে প্রকৃতির নিয়মে তাদের ডিএনএতেও ক্রমাগত মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটতে থাকে...
সালটা ১৯২৮, সেপ্টেম্বরের একদম শুরুর দিকে। সেন্ট মেরি মেডিকেল স্কুলের ব্যাকটেরিওলজির প্রফেসর সদ্য ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন। ল্যাবে ঢুকে পুরোনো কালচার প্লেটগুলোয় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলেন, একটা প্লেটে বড়সড় একটা ছত্রাক জন্মে আছে—কনটামিনেশন!
একটু বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছিলেন নিজের অসাবধানতার জন্য। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলেন, ছত্রাকটির চারপাশের একটা নির্দিষ্ট জায়গা ফাঁকা। কিন্তু তিনি তো এই প্লেটে ‘স্ট্যাফাইলোকক্কাস’ নামের এক ব্যাকটেরিয়া কালচার করছিলেন। তাহলে এই ছত্রাকের কি এমন কোনো হাতিয়ার আছে, যা দিয়ে সে এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে প্রতিহত করছে?
পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামের ছত্রাকটিকে নিয়ে এবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন তিনি। দেখা গেল, এই ছত্রাকের নির্যাস, যাকে বলা হয় ‘মোল্ড জুস’, সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এদের মেরে ফেলতে পারে, সারিয়ে তুলতে পারে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত মানুষদের। বহুদিন ধরে এমন কিছুর খোঁজেই ছিলেন আমাদের এই প্রফেসর। নাম তাঁর আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। এভাবেই তিনি আবিষ্কার করলেন হতচ্ছাড়া অণুজীবদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম কার্যকর অস্ত্র—পেনিসিলিন।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক ব্যাপারগুলোর একটি। যেকোনো অণুজীবই সুপারবাগ হয়ে উঠতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত এর হার সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে।
পেনিসিলিন দিয়ে শুরু, তারপর এই পথ ধরে আবিষ্কৃত হয়েছে আরও অসংখ্য অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গালসহ নানা ধরনের জীবাণুনাশক ওষুধ। ফলে জীবাণুদের ওপর একরকম আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। ভাবতে শুরু করেছিলাম, ওদের নিয়ে আর অত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তার চেয়ে বরং অসংক্রামক রোগগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক।
এদিকে অণুজীবেরা কিন্তু পাল্টা আক্রমণের ছক কষছিল। তার নীলনকশা আঁকা হচ্ছিল তাদের নিউক্লিক অ্যাসিড আর প্রোটিনের বুননে। পেনিসিলিনের আবিষ্কার যেমন বিস্ময় জাগিয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে আমরা দেখলাম, পেনিসিলিন আর কাজ করছে না অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে। শুধু পেনিসিলিনই নয়, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী জীবাণুর উদ্ভব ঘটে গেছে। তাদের দিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছি আর দেখছি আমাদের বিশাল অস্ত্রভান্ডারকে তাদের সামনে অকেজো হয়ে পড়তে। এই ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণুগুলোকেই বলা হয় সুপারবাগ।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক ব্যাপারগুলোর একটি। যেকোনো অণুজীবই সুপারবাগ হয়ে উঠতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত এর হার সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে। অঞ্চলভেদে এর হার ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হতে দেখা যাচ্ছে। ছত্রাকের মধ্যেও রেজিস্ট্যান্সের হার ক্রমে বেড়েই চলেছে। ফলে সাধারণ জ্বর-সর্দি বা ত্বকের রোগ সারানোও অসম্ভব হয়ে উঠছে আমাদের জন্য, ঠিক যেমনটা ছিল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-পূর্ববর্তী যুগে।
সুপারবাগের সুপারপাওয়ার
সুপারবাগের বর্ণনায় ব্যাকটেরিয়ার মডেলকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি ব্যাকটেরিয়া মূলত চারটি উপায়ে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। এক. এনজাইমের সাহায্যে অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে ফেলা। দুই. অ্যান্টিবায়োটিকের বাইন্ডিং সাইট তথা কাজের জায়গাগুলো বদলে ফেলা। তিন. ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশে বাধা দেওয়া এবং চার. অ্যান্টিবায়োটিককে ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাকটেরিয়া অর্জন করে জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত রূপান্তরের মাধ্যমে। এটি বাহিত হতে পারে নিউক্লিওয়েড (অবিন্যস্ত ক্রোমোজোম) বা প্লাজমিড—যেকোনোটির মাধ্যমে। এটি যেমন এক ব্যাকটেরিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চালন করতে পারে, তেমনি কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঞ্চারিত হতে পারে ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও।
সুপারবাগের উদ্ভব: শিকল পরা ছল
ঠিক কোন পরিস্থিতিতে একটি ব্যাকটেরিয়া সুপারবাগ হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, সুপারবাগের উদ্ভবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার।
জীবনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো যেকোনো মূল্যে টিকে থাকা, সেটি আদিম এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে হোমো স্যাপিয়েন্স (মানুষ)—সবার ক্ষেত্রেই সত্য। আর যোগ্যতমরাই যে কালের আবর্তে টিকে থাকে, তা বলা বাহুল্য।
ব্যাকটেরিয়া যখন অ্যান্টিবায়োটিকের মুখোমুখি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেও টিকে থাকার চেষ্টা করে। ফলে প্রকৃতির নিয়মে তাদের ডিএনএতেও ক্রমাগত মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটতে থাকে। কিছু মিউটেশন ব্যাকটেরিয়াকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দেয়। অ্যান্টিবায়োটিকটি যথাযথ ডোজ ও সময় মেনে গ্রহণ না করা হলে ব্যাকটেরিয়ার এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দলগুলো (আইসোলেট) টিকে যায়, আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে অন্যান্য নিরীহ ব্যাকটেরিয়ার ওপরে। একে বলা হয় সিলেকশন প্রেশার।
একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহারের কারণে মারা পড়ে আমাদের শরীরের নিরীহ নরমাল ফ্লোরা, অর্থাৎ সেই অণুজীবগুলো, যারা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো রকম রোগ সৃষ্টি না করেই আমাদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকে।
এটি আমাদের শরীরের ভেতরে প্রতিনিয়ত ঘটছে। যখনই আমরা অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার করি, সেটা হতে পারে ভুল ইনফেকশনের জন্য ভুল অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচন, যথাযথ ডোজ যথাসময়ে গ্রহণ না করা বা ফুল কোর্স সম্পন্ন না করা, তখনই আমাদের শরীরে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হওয়ার সুযোগ পায়। এ ব্যাকটেরিয়াগুলোই দখল করতে থাকে আমাদের চারপাশ। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহারের কারণে মারা পড়ে আমাদের শরীরের নিরীহ নরমাল ফ্লোরা, অর্থাৎ সেই অণুজীবগুলো, যারা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো রকম রোগ সৃষ্টি না করেই আমাদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকে। এই নরমাল ফ্লোরা স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের শরীরে ক্ষতিকর জীবাণুকে বাসা বাঁধতে বাধা দেয়। কাজেই এরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর আক্রমণের পথ আরও প্রশস্ত হওয়া।
বাঁচার উপায় কী
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহতা ইতিমধ্যে পুরো বিশ্ব টের পেতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি যেন আরও খারাপের দিকে না গড়ায়, সে জন্য কাজ করার এখনই সময়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের যথেচ্ছ ব্যবহারই এ সমস্যার মূল। কাজেই যেকোনো মূল্যে এটা বন্ধ করতে হবে। সারা বিশ্বের নীতিনির্ধারকেরা কাজ করছেন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ক্রয়-বিক্রয়, পোলট্রি-মৎস্যখামার-লাইভস্টকসহ সব ক্ষেত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহারকে সুনির্দিষ্ট নীতির আওতায় আনতে। আর ব্যক্তিপর্যায়েও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের সঠিক ব্যবহার। তা না হলে সুপারবাগের হাতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শোচনীয় পরাজয় দেখতে হবে আমাদের, অবশ্য সেটা দেখার জন্য যদি কেউ আদৌ বেঁচে থাকে!