ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কে কী ঘটে

ঘুমের ভেতরে মস্তিষ্ক কি চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকে? নাকি কোনো কাজ করে? করলে, এ সময় ঠিক কী করে মস্তিষ্ক? মানবমস্তিষ্ক, ঘুম এবং কিছু রহস্য …

আমাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল এবং শক্তিশালী। মস্তিষ্কে থাকে প্রায় ৮ হাজার ৬০০ কোটি নিউরন। প্রায় ২৫ বছর বয়স হতে হতে এসব নিউরন পুরোপুরি গঠিত হয়। এগুলো সেকেন্ডে ২০ থেকে ২৫ ওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে একটা বাতি জ্বালানো যায়। অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্ক এত শক্তিশালী ও কর্মক্ষম (এফিশিয়েন্ট) যে এই অল্প পরিমাণ এনার্জি বা শক্তি ব্যবহার করেই এটি সবধরনের কাজ করতে পারে।

মস্তিষ্কের সব রহস্য এখনো উন্মোচন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এর প্রচণ্ড জটিল গঠনই শুধু নয়, এর কর্মপদ্ধতিও এত অদ্ভুত যে সব জানার কথা চিন্তা করাও এখনো বহু দূরের ব্যাপার। তাই প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য খুঁজে বের করছেন বিজ্ঞানী। যেমন আমরা ঘুমিয়ে পড়লে কি মস্তিষ্কও সব কাজ গুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে? নাকি তখনো চলে গোপন কোনো কাজ? এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন, ঘুম কি আসলেই দরকারী?

এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড রেইজেন। তিনি বলেছেন, ‘এই গ্রহে আমরা যতগুলো প্রাণীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, তাদের সবার ঘুম খুব দরকারি। ফলের মাছি, গোলকৃমি, এমনকি জেলিফিশও ঘুমায়।’ 

একরাত ঠিকভাবে না ঘুমালে তার প্রভাব পড়ে চিন্তাভাবনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। মানে মস্তিষ্কই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘুমের অভাবে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের সুস্থতাই হলো ঘুম।

অর্থাৎ প্রাণিজগতের টিকে থাকার জন্য ঘুম জরুরি। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার বিপদও আছে। ঘুমানোর সময় প্রাণীরা শিকারির হাতে পড়তে পারে। তা সত্ত্বেও না ঘুমিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। গবেষণা বলছে, আমরা জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাই। কেউ যদি ৭৫ বছর বাঁচে, তাহলে সে প্রায় ২৫ বছর কাটায় ঘুমিয়ে!

নিয়মমতো ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

আর যদি ঠিকমতো ঘুম না হয়, তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ডেভিড রেইজেনের ভাষ্যে, ‘একরাত ঠিকভাবে না ঘুমালে তার প্রভাব পড়ে চিন্তাভাবনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। মানে মস্তিষ্কই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘুমের অভাবে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের সুস্থতাই হলো ঘুম। 

ঘুম যে খুব দরকারী, তা তো বোঝা গেল। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে মস্তিষ্ক ঠিক কী করে, তা বোঝার জন্য ঘুমের প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের ঘুম সাধারণত দুই ধরনের—রেম (REM) এবং নন-রেম (non-REM)। রেমের পূর্ণরূপ ‘র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট’। এই দুই ধরনের ঘুমে মস্তিষ্কে ভিন্ন ধরনের ব্রেনওয়েভ এবং নিউরনের আলাদা কার্যকলাপ দেখা যায়।

আরও পড়ুন

ঘুমাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আমরা ঘুমিয়ে পড়ি না, একটু সময় লাগে। তারপর মস্তিষ্কের তরঙ্গ ধীর হয়ে আসে, পেশি শিথিল হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসও ধীর হয়। ধীরে ধীরে ঘুমের গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি আমরা। এটা ঘুমের নন-রেম পর্যায়।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঘুম গভীর হতে থাকলে একপর্যায়ে মস্তিষ্ক যেন আবার জেগে ওঠে! এটাই ঘুমের রেম পর্যায়। অর্থাৎ আমরা যখন গভীর ঘুমে ডুবে যাই, তখন রেম পর্যায়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্ক। এ সময় মস্তিষ্ক আবার পুরোদমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মোট ঘুমের প্রায় ২০-২৫ শতাংশ সময় ধরে চলে এই রেম ঘুম। আর এই সময়েই আমরা সবচেয়ে বিচিত্র ও অদ্ভুত স্বপ্নগুলো দেখি। 

মস্তিষ্কের সব রহস্য এখনো উন্মোচন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এর প্রচণ্ড জটিল গঠনই শুধু নয়, এর কর্মপদ্ধতিও এত অদ্ভুত যে সব জানার কথা চিন্তা করাও এখনো বহু দূরের ব্যাপার। তাই প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য খুঁজে বের করছেন বিজ্ঞানী।

রেম ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কের থ্যালামাস অংশ থেকে ভেসে বেড়ায় নানা রকম ছবি, শব্দ ও অনুভূতি। এসব নিয়েই তৈরি হয় স্বপ্ন। আবার অ্যাসিটাইলকোলিন নামে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা জেগে থাকার সময় বেশি সক্রিয় থাকে। কিন্তু রেম ঘুমের সময়ও এই রাসায়নিককে সক্রিয় দেখা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের শেখা ও মনে রাখার কাজে অ্যাসিটাইলকোলিন সাহায্য করে। তাই পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন দিয়ে ঘুমালে অনেক সময় ভালো মনে থাকে।

তবে মস্তিষ্কের কিছু বিষয় এখনো বিজ্ঞানারী বুঝে উঠতে পারেননি। যেমন ঘুমের শুরুর দিকে মস্তিষ্কে একধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। একে বলে ‘স্লিপ স্পিন্ডল’।এর কাজ কী, তা এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, নতুন কিছু শেখা ও স্মৃতি তৈরিতে এদের বড় ভূমিকা রয়েছে। ফলে বাইরের শব্দ বা আলো থেকে আমরা ঘুমের মধ্যে নিরাপদ থাকি।

ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে পরিষ্কার করে! ২০১৯ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড এবং রক্ত মিলে একধরনের তরল তৈরি হয়। এই তরল দিয়েই পরিষ্কার হয় মস্তিষ্ক।

আরও পড়ুন

তবে ঘুম মানে যদি শুধু বিশ্রাম ভেবে থাকেন, তাহলে ভুল হবে। মস্তিষ্কের এমন কিছু কাজ আছে, যা শুধু ঘুমের সময়ই মস্তিষ্ক করতে পারে। যেমন ঘুমের মধ্যে মানুষের দেহে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ হয়। ফলে মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। দিনভর জমে থাকা বর্জ্য ঘুমের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায়। এ সময় মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ শক্তিশালী হয়। ২০১৭ সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলো পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। ফলে স্মৃতিতে থাকা জিনিস আর চোখে দেখা জিনিস চট করে মনে করতে সমস্যা হয়। এককথায়, ঘুম না হলে নিউরনের কাজ ব্যহত হয়।

মস্তিষ্কের শেখা ও মনে রাখার কাজে অ্যাসিটাইলকোলিন সাহায্য করে। তাই পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন দিয়ে ঘুমালে অনেক সময় ভালো মনে থাকে।

ঘুম ঠিকমতো না হলে অনেক রোগের সম্ভাবনাও বাড়ে। যেমন টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, বিষণ্ণতা। তবে এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে ঘুম খারাপ হলে এসব রোগ হয়, নাকি এসব রোগের কারণে ঘুম খারাপ হয়। তা ছাড়া সবার ঘুমের চক্রও একরকম নয়। কে, কখন, কীভাবে ঘুমাচ্ছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সেল রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেরিতে ঘুমালে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে মস্তিষ্কের। ওদিকে মার্কিন পাবলিশিং গ্রুপ নেচার-এর মলিকিউলার সাইক্রিয়াট্রি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, যথেষ্ট ঘুম না হলে মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না ঠিকভাবে। ফলে বর্জ্য পরিষ্কার করতে সমস্যা হয় মস্তিষ্কের। সেই ধারাবাহিকতায় স্মৃতিজনিত সমস্যা দেখা দেয়, বাড়ে আলঝেইমারের মতো স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি। সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চিন্তা করার ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এর ফলে।

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে ঘুম আমাদের সুস্থ থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে ঘুম ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রহস্যঘেরা।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন