পতঙ্গের ঘুম

বিকেলের খেলা শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা কোনো শিশুকে খেয়াল করলে হয়তো দেখা যাবে, মাধ্যাকর্ষণশক্তি তার চোখের পাতা মাটির দিকে টেনে ধরছে। তেমনি, কোনো নিদ্রাচ্ছন্ন মে মাছির (Mayfly) শুঙ্গ আর উদ্ধত থাকে না, অবনত হয়ে পড়ে।

পতঙ্গ বিশ্রামের এই মিষ্টি দৃশ্য উল্লেখ করার মতো কিছু নয় বলে মনে হবে। তবে পতঙ্গের তন্দ্রা নিয়ে গবেষণা হয়তো ঘুমের কয়েকটি গুরুতর রহস্যের সমাধান বয়ে নিয়ে আসতে পারে। এমনটাই মনে করেন জার্মানির উজবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পতঙ্গবিদ শার্লট হেল ফ্রিখ ফোরসটার। পতঙ্গের মস্তিষ্ক স্তন্যপায়ীদের চেয়ে সরল। তাই পতঙ্গের ঘুম নিয়ে গবেষণা করে ঘুমের স্নায়ু ফলের মাছি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হয়তো মস্তিষ্কের যেসব জায়গা ঘুম নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে কাজ করে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করা যাবে।

কোনো পতঙ্গবিদ যখন মে মাছির ঘুম নিয়ে গবেষণার কথা আলোচনা করেন, স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিস্ময়সূচক প্রশ্ন আসে—‘পতঙ্গেরা ঘুমায়!’ তারপর আরও প্রশ্ন আসে ধারাবাহিকভাবে—‘ঘুমানোর মানে আসলে কী? কীভাবে বুঝবেন যে পতঙ্গেরা ঘুমায়? পতঙ্গের ঘুম কি মানুষের ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কিত?’

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ব্যারেট ক্লেইন যেমন ভাবেন, পতঙ্গদের একধরনের ঘুম আছে। বিষয়টি ঘুমকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব, তার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ঘুম আসলে কী—এর সংজ্ঞা ঠিক করা অত্যন্ত জটিল (যেমন অসুস্থ ব্যক্তির অজ্ঞান অবস্থা বা শল্যচিকিৎসার জন্য সারা দেহ অচেতন করে দেওয়া কি গভীর ঘুমের একটি রূপ?)। পতঙ্গের জন্য ঘুমকে সংজ্ঞায়িত করা আরও কঠিন। কোনো পতঙ্গ ঘুমাচ্ছে কি না, তার ইঙ্গিত অনেক সূক্ষ্ম। মে মাছির ঝুলে পড়া শুঙ্গ, তেলাপোকার আনত দেহ, ফলের মাছির দীর্ঘ সময় ধরে স্থির থাকা—এসবই ঘুমের ইঙ্গিত। কিন্তু এসব ইঙ্গিত ঘুমের অব্যর্থ চিহ্ন নয়। একটি স্থির ফলের মাছি হয়তো ঘুমাচ্ছে, কিংবা শুধুই বিশ্রাম নিচ্ছে।

মে মাছির ঝুলে পড়া শুঙ্গ, তেলাপোকার আনত দেহ, ফলের মাছির দীর্ঘ সময় ধরে স্থির থাকা—এসবই ঘুমের ইঙ্গিত। কিন্তু এসব ইঙ্গিত ঘুমের অব্যর্থ চিহ্ন নয়।
আরও পড়ুন
পতঙ্গ ঘুমাচ্ছে কি না, তার ইঙ্গিত অনেক সূক্ষ্ম
ফলের মাছির (Fruit fly) মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ছন্দের কিছু প্রোটিন উৎপন্ন হয়। এসব প্রোটিনের ছন্দময় তৎপরতা সার্কাডিয়ান ঘড়ির ভিত্তি তৈরি করে।

মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা মাপলে হয়তো ঘুম শনাক্ত করা যাবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে। তবে এসব প্রক্রিয়াও যে অব্যর্থ, তা নয়। তা ছাড়া ক্ষুদ্র পতঙ্গের অতিক্ষুদ্র মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা মাপা বেশ জটিল প্রক্রিয়া। পরিবেশের কোনো উদ্দীপনার প্রতি পতঙ্গের প্রতিক্রিয়া মাপলেও ঘুমের একটি সূচক হতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় বিশ্রামরত পতঙ্গের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানুষের কাছাকাছি কিছু প্রক্রিয়া খুঁজে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ফলের মাছির (Fruit fly) মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ছন্দের কিছু প্রোটিন উৎপন্ন হয়। এসব প্রোটিনের ছন্দময় তৎপরতা সার্কাডিয়ান ঘড়ির ভিত্তি তৈরি করে। এসব প্রোটিনের অনেকই আবার মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ীতে পাওয়া যায়। ফলের মাছির মস্তিষ্কে নিউরো ট্রান্সমিটার (ডোপামিন, এসিটাইল কোলিন ইত্যাদি) রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। এসব রাসায়নিক ঘুমের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এসব রাসায়নিক নিউরো ট্রান্সমিটার এলোমেলো করে দিলে ফলের মাছির ব্যস্ততা ও বিশ্রামের চক্রও বদলে যায়।

এ ছাড়া মানুষের মতোই পতঙ্গের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার ক্ষতি তো হয়ই, পাশাপাশি আচরণও বদলে যায়। মে মাছিরা একে অপরকে বিস্তারিত নাচের মাধ্যমে জানায় কোথায় ফুল পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের টানা জাগিয়ে রাখলে (কৃত্রিমভাবে অনিদ্রা তৈরি করলে) মে মাছির নাচে ঢিল পড়ে এবং সেটা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়।

মানুষের মতোই পতঙ্গের ঘুম নিয়ে অজানা প্রশ্নের শেষ নেই। হয়তো আগামী দিনে পতঙ্গের ঘুম গবেষণা থেকে আমরা মানুষের ঘুম নিয়ে জটিল প্রশ্নের উত্তর পাব।

সূত্র: নটিলাস—লরা স্যান্ডার্সের প্রবন্ধের ভিত্তিতে লেখা।

 * লেখাটি ২০১৮ সালে নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন