হাতের নখের জীবাণুরা

এআইয়ের চোখে মাইক্রোস্কোপের নিচে অণুজ

সমাবেশ বসেছে। প্রায়ই এরকম সমাবেশে বসতে হয় তাকে। বয়স বেশি নয়। তাদের হিসেবে বাচ্চাই বলা চলে। কিন্তু জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই সমাবেশে বসতে হয়। বয়স্ক নেতাগোছের কেউ একজন একনাগাড়ে বোঝাতে থাকে, বংশবৃদ্ধি করতে হলে কী করতে হবে। কীভাবে যাত্রার প্রথম স্টেশনে পৌঁছাতে হবে। প্রথম স্টেশনে তাদের কিছু করার নেই তেমন। শুধু অপেক্ষায় থাকতে হবে উপযুক্ত পরিবেশের। সেই উপযুক্ত পরিবেশ কখনো আসে, কখনো আসে না। তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাদের জীবনটাই এমন। অপেক্ষা করতে হয় কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের জন্য। নিজেদের খুব একটা করার কিছু থাকে না।

তাদের মূল কাজ, অর্থাৎ বংশবৃদ্ধি শুরু হবে সেই পরিবেশে পৌঁছানোর পর। হাল ছাড়া যাবে না। লক্ষ্য অর্জনে অটুট থেকে চেষ্টা করে যেতে হবে। এসব মোটিভেশনাল কথাবার্তা প্রতিদিনই শুনতে হয় তার। এতদিনে সব মুখস্থ হয়ে গেছে। তারপরও একই কথা শুনতে খারাপ লাগে না। কে না জীবনে সফলতার স্বাদ পেতে চায়? কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে যাওয়ার পর তার বিশ্বাস, সে অনেক ভালো বংশবৃদ্ধি করতে পারবে। তাকে নিয়ে নতুন গল্প তৈরি হবে। যে গল্প অনুপ্রেরণা দেবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

আদিবের মতো আমাদের সঙ্গেও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ক্ষতিকর নানা জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করে খাবারের মাধ্যমে। এরপর নানারকম অসুখে আক্রান্ত হই আমরা। যেহেতু হাত দিয়ে খাবার খাই, তাই জীবাণু প্রবেশের অন্যতম প্রধান বাহন হলো আমাদের হাত

সমাবেশে সবাই বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। বয়ষ্ক নেতা হঠাৎ ঘোষণা করলেন—প্রস্তুত হও। প্রথম স্টেশনে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি আবারও। যে যে পারো, দানবীয় বাহনটায় উঠে পড়ো। সেও নড়েচড়ে বসল। জন্মের পর এমন ঘোষণা অবশ্য এই প্রথম নয়। আগেও হয়েছে। কিন্তু বাহনটা অনেক দূরে থাকায় সে উঠতে পারেনি। এবারে কী হবে, কে জানে। মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ইতিমধ্যেই আলো নিভে গেছে চারপাশের। ধীরে ধীরে বড় বাহনটা তাদের পুরো কলোনি ঢেকে ফেলল! কী আশ্চর্য বিষয়, বাহনের সবচেয়ে সুরক্ষিত অংশটা পড়েছে ঠিক তার মাথার ওপরেই। বলা যায় একদম প্রান্তভাগ এটা বাহনের। প্রায় একইরকম দেখতে এমন পাঁচটা অতিকায় দন্ড আছে সেখানে। এই দন্ডের মাথাতেই আছে সবচেয়ে সুরক্ষিত অংশ। বিশাল অঞ্চল ঢাকা থাকে শক্ত আবরণে, কখনো এগুলো ছোট থাকে, কখনো বড়। যত বড় আবরণ, তত বেশি জন থাকতে পারে। এখানে যারা জায়গা নিতে পারে, তারা খুব ভাগ্যবান। কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা তাদের খুবই বেশি। 

তারা যেখানে বসে আছে, সেখানটায় স্পর্শ করল দানবীয় বাহনটা। মুহূর্তের মধ্যেই জীবাণুদের পুরো কলোনি চড়ে বসল বাহনের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গাটায়। সেখানে অবশ্য আগে থেকেই আরও অনেক জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া অণুজীব বসে ছিল। সবার এমন উপস্থিতিতে সেখানে তখনই ছোট একটা অনুষ্ঠানও হয়ে গেল। একটা অংশে কিছুটা ভেজা, উষ্ণ আবহাওয়া। কেউ কেউ সেখানে ইতিমধ্যেই বংশবিস্তার শুরু করে দিয়েছে। সে এবার বসে রইল কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে যাওয়ার সেই একমাত্র সুযোগের আশায়।

আদিব অবশ্য এসবের কিছু টের পেল না। স্বাভাবিক ভাবেই দরজার নবটা ঘুরিয়ে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। আদিবের বয়স মাত্র দশ। দুরন্ত হিসেবে তার ইতিমধ্যেই কিছুটা সুনাম তৈরি হয়েছে। ওর দুরন্তপনায় মাও কিছুটা ক্লান্ত। তবে আদিবের ভালো দিক হলো, খাবার নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। যা-ই দেওয়া হোক, চেটেপুটে খাওয়ার চেষ্টা করে। ঘরে ঢুকেই দেখল, মা পুলি পিঠা বানাচ্ছে। রসালো পিঠা দেখামাত্রই সে নিয়ে খাওয়া শুরু করল। হাত ধুয়ে এসে খাও—এই কথা মা বলতে বলতেই পিঠার অর্ধেকটা পেটে চালান হয়ে গেছে ওর। নারকেল আর চিনির মিষ্টি রস লেগে গেছে হাতের আঙুলে। বাকি অর্ধেকটা পেটে দিয়ে আঙুল চাটতে চাটতে এগোল পানির কলের দিকে। টেরও পেল না, একটু আগে ওর আঙুলের নখের নিচে বাসা বাঁধা জীবাণুদের ও নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছে পেটে।

কয়েকদিন পরের ঘটনা। পেটের মধ্যে খুব ব্যথা করছে মাঝেমধ্যে ওর। দুরন্ত ছেলেটা কেমন যেন চিমসে গেছে। হবে নাই-বা কেন। দিনে চার-পাঁচবার পাতলা পায়খানা হলে সুস্থ-সবল মানুষও বিছানায় পড়ে যায়। ওর অবস্থা তো আরও কাহিল। হাতের নখ বড় দেখে সেদিন ডাক্তার আঙ্কেল অনেকক্ষণ ধরে ওকে বুঝিয়েছেন, কীভাবে জীবাণুরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে হাতের নখে বাসা বাঁধে, কীভাবে হাত ভালো করে না ধুয়ে খেলে জীবাণুরা পেটে যায়। পেটে গিয়ে কীভাবে নানান অসুখ তৈরি করে—সব।

আদিবের মতো আমাদের সঙ্গেও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ক্ষতিকর নানা জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করে খাবারের মাধ্যমে। এরপর নানারকম অসুখে আক্রান্ত হই আমরা। যেহেতু হাত দিয়ে খাবার খাই, তাই জীবাণু প্রবেশের অন্যতম প্রধান বাহন হলো আমাদের হাত। বিশেষ করে আঙুলের নখ।

আমাদের হাতের আঙুলের মাথায় শক্ত আবরণ থাকে। এই আবরণ প্রতিনিয়ত বাড়ে। আঙুলের সঙ্গে যুক্ত টিস্যুর চেয়ে বড় হয়ে গেলে শক্ত আবরণের কোষগুলো মরে যায়। এই মরে যাওয়া কোষগুলোই তৈরি করে নখ। হাতের নখ যেমন হাতের সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনি আঙুলকে আঘাত থেকে রক্ষা করে। এটি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ। কিন্তু যদি ঠিকমতো যত্ন না নেওয়া হয়, তাহলে নখের নিচে আশ্রয় নিতে পারে বিভিন্ন প্রকার জীবাণু ও পরজীবী।

নখের নিচে জমে থাকা ময়লা মূলত মৃত ত্বকের কোষ, তেল ও বাইরের ধুলাবালির মিশ্রণ। এর মধ্যে থাকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং কখনো কখনো ফাঙ্গাস ও পরজীবী ডিম
প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

নখের নিচে জমে থাকা ময়লা মূলত মৃত ত্বকের কোষ, তেল ও বাইরের ধুলাবালির মিশ্রণ। এর মধ্যে থাকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং কখনো কখনো ফাঙ্গাস ও পরজীবী ডিম। নখের নিচে থাকা সাধারণ ব্যাকটেরিয়া হলো Escherichia coli (ই.কোলাই) এবং Staphylococcus aureus (স্টেফাইলোকক্কাস অরেয়াস)। ২০১৯ সালে জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাবে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো সহজেই নখের নিচে জমতে পারে। আর এ ধরনের ব্যাকটেরিয়া খাদ্যনালীতে প্রবেশ করলে ডায়রিয়া, বমিসহ খাদ্যে বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিংয়ের মতো অসুখ হতে পারে।

এ তো গেল ব্যাকটেরিয়ার কথা। ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও পরজীবী ঠাঁই নিতে পারে নখের নিচে থাকা সুরক্ষিত অঞ্চলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘পিনওয়ার্ম’। এর ডিম খুব ক্ষুদ্র, সহজেই নখের নিচে জমা হয়। পিনওয়ার্ম আমাদের অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটিয়ে পেটে ব্যথা, অস্বস্তি এবং অনিদ্রার মতো অসুখ তৈরি করতে পারে।

আমাদের নখের গঠন এমন যে এর নিচের অংশ সরাসরি ধোয়া বা পরিষ্কার করা কঠিন। মানুষের হাতের সংস্পর্শে আসা যেকোনো বস্তু, যেমন দরজার হাতল, কম্পিউটারের কিবোর্ড, মোবাইল ফোনের পর্দা—এসবে প্রচুর জীবাণু বাসা বেঁধে থাকে। আমরা যখন এগুলো ধরি, তখন জীবাণুগুলো চলে আসে আমাদের হাতে। বিশেষ করে নখের নিচের সুরক্ষিত স্থানে এরা দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। যাঁরা নখ বড় রাখেন, তাঁদের নখের নিচে জীবাণু জমার প্রবণতা বেশি। কারণ, বড় নখ পরিষ্কার করা তুলনামূলক কঠিন। তা ছাড়া নখ কামড়ানোর অভ্যাস যাঁদের আছে, তাঁদের এসব জীবাণুতে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কারণ এতে সরাসরি হাত থেকে মুখের মাধ্যমে পেটে চলে যায় জীবাণু।

ক্ষতিকর নানা জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করে খাবারের মাধ্যমে। এরপর নানারকম অসুখে আক্রান্ত হই আমরা
আরও পড়ুন

শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। শিশুরা প্রায়ই মাটিতে বা মেঝেতে খেলাধুলা করে। এরপর হাত না ধুয়েই অনেক সময় মুখে দেয়। ফলে নখের নিচে জমে থাকা জীবাণু খুব সহজেই শরীরে প্রবেশ করে। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় দ্রুতই রোগাক্রান্ত হয় শিশুরা। প্রশ্ন হলো, এ সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় কী?

আসলে হাতের নখে লুকিয়ে থাকা রোগজীবাণু থেকে রক্ষা পেতে বেশি কিছু করার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় গুরুত্ব দিলেই এসব থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। বিশেষ করে নখ ছোট রাখার অভ্যাস করা, নখ পরিষ্কার রাখা, খাবার খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধোয়া, ময়লা বা রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করার আগে গ্লাভস ব্যবহার করার অভ্যাস করলে নখের নিচে জমে থাকা জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া নখ কামড়ানোর অভ্যেস থাকলে তা বাদ দিতে বলেন বিশেষজ্ঞরা। শিশুরা যেহেতু বেশি ঝুঁকিতে থাকে, তাদের বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে বড়দের। নিয়মিত হাত পরিষ্কার ও নখ কাটার অভ্যেস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এরপরও যদি কোনো সংক্রামণ দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: মায়ো ক্লিনিক, ডাব্লিউ এইচও, জার্নাল অব ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজি, উইকিপিডিয়া