এক শ বছরের বেশি খুব কম মানুষই বাঁচে। তাই, মানুষ যদি আর কোনো সন্তান জন্ম না দেয়, তাহলে সম্ভবত একশ বছরের মধ্যেই পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ থাকবে না। শুরুতে পৃথিবীর জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। কারণ, এ সময় বয়স্করা ধীরে ধীরে মারা যাবে।
হঠাৎ নতুন শিশুর জন্ম বন্ধ হয়ে গেলে একসময় দরকারি কাজের জন্য যথেষ্ট তরুণ থাকবে না। এতে পৃথিবীর সব সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সেবার ওপর। সেসবের ওপরই আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। তখন মানুষের সংখ্যা কম থাকলেও দরকারি খাদ্য পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক মাইকেল এ. লিটল তাঁর এক লেখায় বলেন, ‘আমি একজন নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে মানুষ ও সংস্কৃতি নিয়ে পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়েছি। আমি অকপটে স্বীকার করি, এমন কিছু ঘটলে তা খুবই ভয়াবহ হবে। শুধু তাই নয়, একসময় সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। সম্ভবত খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও অন্যান্য দরকারি মৌলিক জিনিসের ঘাটতির কারণে ১০০ বছরের আগেই মানুষ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’
তবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বড় কোনো বৈশ্বিক বিপর্যয় না ঘটলে পৃথিবীতে শিশু জন্ম বন্ধ হওয়া অস্বাভাবিক। লেখক কার্ট ভনেগাট তাঁর গ্যালাপাগোস উপন্যাসে এমন এক কাল্পনিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। যেখানে দেখা যায়, একটি ছোঁয়াচে রোগ সব প্রজননক্ষম মানুষকে বন্ধ্যা করে দেয়। আর কেউ সন্তান জন্ম দিতে পারে না। আরেকটি সম্ভাবনা হলো পারমাণবিক যুদ্ধ। এমন যুদ্ধে কেউই বেঁচে থাকবে না। এ ধরনের ভয়াবহ দৃশ্য অনেক বই ও সিনেমায় দেখা গেছে।
এসব গল্প ও সিনেমা কল্পবিজ্ঞানের ব্যাপার। সেখানে মহাকাশ ভ্রমণসহ নানা বিষয় থাকে। কিছু গল্পে বাস্তবের কাছাকাছি ভবিষ্যতকে কাল্পনিক রূপ দেওয়া হয়। এসব গল্পে দেখা যায়, মানুষ সহজে আর সন্তান নিতে পারে না। এতে সমাজে হতাশা ও অবসাদ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যারা সন্তান নিতে পারে, নানাভাবে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বেড়ে যায়। কানাডিয়ান লেখক মার্গারেট অ্যাটউডের দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল এবং ব্রিটিশ লেখক পি. ডি. জেমসের দ্য চিলড্রেন অব মেন এমন দুটি বই।
এসব বইয়ে এমন এক ভবিষ্যতের কথা বলা হয়েছে, যেখানে মানুষের দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খলা খুব বেশি। এই দুটি কাহিনি নিয়ে পরে টেলিভিশন সিরিজ ও মুভি নির্মিত হয়েছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে অনেকে মনে করতেন, একসময় পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাবে এবং তা বিভিন্ন বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ বিষয় নিয়েও অনেক গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে, তৈরি হয়েছে মুভি।
বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার আগের চেয়ে কমেছে। জনসংখ্যা পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন যারা, তাঁরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৮০ সালের দিকে জনসংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার কোটিতে পৌঁছাবে। ১৯৭৪ সালের ৪০০ কোটি থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জনসংখ্যা ৩৪ কোটি ২০ লাখ। ১৯৩০-এর দশকের চেয়ে সংখ্যাটা প্রায় ২০ কোটি বেশি। তবে মৃত্যুহার বেশি হলে এই সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে পারে সারা বিশ্বে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৬ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। এই সংখ্যা ২০০৪ সালের চেয়ে কম, তখন ছিল ৪১ লাখ। অন্যদিকে, ২০২২ সালে দেশটিতে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা গেছে। ২০ বছর আগে যা ছিল ২৪ লাখ।
তাই পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তরুণ ও প্রবীণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। কারণ, তরুণরাই সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। তারা নতুন নতুন পরিকল্পনা ও ধারণা বাস্তবায়ন করে। আমরা প্রতিদিন যেসব ব্যবহার করি, তা তরুণরাই উৎপাদন করে। একইসঙ্গে প্রবীণদের অনেক কাজে তরুণদের সাহায্যের প্রয়োজন। রান্না করা, কাপড় পরিষ্কারসহ এমন অনেক কাজ রয়েছে। এছাড়া অনেক কাজ আছে, যেগুলো ৬৫ বছরের নিচের মানুষদের জন্য বেশি উপযোগী। আর এই বয়সের পর সাধারণত মানুষ অবসর নেয়।
অনেক দেশের নারীরা এখন আগের তুলনায় অনেক কম সন্তান নিচ্ছেন। ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কিছু দেশে বিষয়টা বেশি দেখা যায়। বর্তমানে জন্মহার কমার মূল কারণ মানুষের সন্তান না নেওয়ার মনোভাবে বা কম সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এ ধরনের জনসংখ্যা কমে যাওয়া যদি অভিবাসনের মাধ্যমে পূরণ করা না যায়, তবে তা বড় সংকটে পরিণত হতে পারে। কিন্তু অভিবাসনের বড় বাধা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ। সেই সঙ্গে অনেক পুরুষ এখন বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছেন। যদি এই সমস্যা আরও বাড়তে থাকে, তাহলে জনসংখ্যা দ্রুত কমতে পারে।
আমাদের মানবপ্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্স পৃথিবীতে অন্তত দুই লাখ বছর ধরে টিকে রয়েছে। এটা অনেক দীর্ঘ সময়। কিন্তু পৃথিবীর সব প্রাণীর মতোই আমাদের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন মাইকেল এ. লিটল।
আমাদের কাছের প্রজাতি নিয়ান্ডারথালরা অন্তত চার লাখ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল। আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথালরা কিছু সময় একসঙ্গে বাস করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে যায় প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে।
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, আধুনিক মানুষ খাদ্য উৎপাদনে ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে বেশি সফল ছিল। তাই হোমো স্যাপিয়েন্স এখনো টিকে আছে। মানুষ যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীতে অন্য প্রাণীরা নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে। অবশ্য এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখজনক হবে। কারণ, মানুষের শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের মতো অসংখ্য শ্রেষ্ঠ অর্জন হারিয়ে যাবে।
তাই মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে হলে কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধ এড়ানো এবং জীববৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য পৃথিবীকে সব প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য করে তুলেছে।