ডিম ডিমা ডিম ডিম

শহরের তাপানুকূল সুপারশপগুলো থেকে শুরু করে আদিগন্ত খোলা নীল আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের আবেগ। কেন? কী অদ্ভুত ভালো লাগা মিশে থাকে, যখন আকাশে সুমধুর কণ্ঠে উড়ে বেড়ায় কোনো এক পাখি! একদিন এ পাখিটি থেকেই জন্ম নেবে আরও অনেক পাখি! আর সুপারশপে থরে থরে সাজানো মুরগির ডিমও দৃষ্টি কেড়ে নেয় অন্য কোনো এক আকর্ষণে! পাখির ডিমের এই বাহ্যিক অস্তিত্বের চেয়েও হয়তো আরও বেশি চমৎকার এর ‘ডিম’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি। বিজ্ঞানের আনন্দ তো সেই নেপথ্যেই রচিত থাকে।

নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, বসন্তকালে যখন দিনের ব্যাপ্তি বেশি, তখন পাখিদের প্রজননের উৎকৃষ্ট সময়। কেননা এ সময় ঝরনার মতো হরমোন প্রবাহিত হয় পাখির শরীরে। পুরুষ পাখির শরীরে প্রজননের জন্য তৈরি হওয়ার এ ঘটনাটি এককভাবেই ঘটতে পারে, কিন্তু নারী পাখির ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্ন। পুরুষ পাখির সাহায্য ছাড়া তাদের ডিম্বাশয় এবং ডিম্বনালি কার্যক্ষম হতে পারে না! শীতকালে মা পাখির শরীরে ডিম্বাশয় এবং ডিম্বনালি বলতে গেলে প্রায় অনুপস্থিত থাকে। এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতো তাদের জোড়ায় জোড়ায় ডিম্বাশয়-ডিম্বনালি থাকে না, একটি করে তৈরি হয় প্রজননের সময়। কারণ পাখিদের তো আকাশে উড়তে হয়! আকাশে অত অত ভারী শরীর নিয়ে কি আর উড়ে বেড়ানো যায়? ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই প্রকৃতির সঙ্গে এটি তাদের এক খাপ খাওয়ানোর বিজ্ঞান-মন্ত্র!

নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, বসন্তকালে যখন দিনের ব্যাপ্তি বেশি, তখন পাখিদের প্রজননের উৎকৃষ্ট সময়। কেননা এ সময় ঝরনার মতো হরমোন প্রবাহিত হয় পাখির শরীরে।
আরও পড়ুন
ছবি ট্রিনিটি কলেজ জুলজিক্যাল মিউজিয়াম, ডাবলিন

ডিম্বনালি, ডিম্বাশয়, ডিম্বাণু—বৈজ্ঞানিক এই শব্দগুলো খুব গোলকধাঁধার মতো, না? ডিমই বা তাহলে কোনটা! ডিম্বাশয়ে একগুচ্ছ হলুদ ডিম্বাণু তৈরি হয়, সহজ ভাষায় একে আমরা ডিমের কুসুম বলি। আর ডিম্বনালি দিয়ে আসতে আসতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খোসাসমেত আস্ত ডিমটি বেরিয়ে আসে। মানুষের ডিম্বাণু কিন্তু খুব ছোট, এই কাগজের পাতায় একটি বিন্দুর মতো কিন্তু পাখির আকার খুব ছোট হলেও এর ডিম্বাণু কিন্তু অনেক বড়! কারণ, ভ্রূণের বেড়ে ওঠার জন্য সব খাদ্যের আধার যে এই ডিমের কুসুমটিই, অর্থাৎ ডিম্বাণু!

ডিমের কুসুমের গায়ে একটা ছোট্ট সাদা বিন্দুর মতো দেখা যায়, এটি হলো জার্মিনাল ডিস্ক বা মা পাখির ডিএনএ। ডিম্বনালির ওপরে শুক্রাণুগুলো অপেক্ষা করে। যখন ডিম্বাশয় থেকে ডিম হওয়ার প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণুটি ডিম্বনালিতে প্রবেশ করে, তখন ডিম্বনালিতে অপেক্ষারত অসংখ্য শুক্রাণু জার্মিনাল ডিস্কের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তো জানি, মানুষ কিংবা যেকোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে একটি শুক্রাণুই এই প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হবে, কিন্তু পাখির ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতায় একাধিক শুক্রাণু ডিম্বাণুতে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়।

৫ ঘণ্টা পর এটি পৌঁছে যায় ডিম্বনালির ইস্থমাস নামের এক জায়গায়। ইস্থমাসে পৌঁছানোর পর ডিম্বাণুর ভেতর জার্মিনাল ডিস্ক বিভাজিত হয়ে ভ্রূণের অস্তিত্ব বিকশিত হতে থাকে।
নীল পাঅলা বুবি পাখি

ঠিক কী কারণে এমন ভিন্নধর্মী ঘটনাটি ঘটছে পাখির দেহে? সেটি সম্প্রতি খুঁজে বের করেছেন ‘ইউনিভার্সিটি অব শেফফিল্ড’–এর প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক টিম বার্কহেড ও তাঁর সহকর্মী নিকোলাস হেমিংস। গবেষণা বলছে, নিষেকের জন্য একটি শুক্রাণুই যথেষ্ট। তবে ডিম্বাণুর ভেতর অনেকগুলো শুক্রাণু ঢুকে পড়ার কারণ আছে। ভ্রূণের পরিপূর্ণভাবে বেড়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ক্যালসিয়াম সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে বাড়তি শুক্রাণুটি।

ডিম্বাণুতে শুক্রাণুদের প্রবেশের পর তা তো নিষিক্ত হয়ে যায়। এরপর এই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে ডিম্বনালিতে ব্যয় করতে হয় প্রায় ২৪ ঘণ্টা। তারপরই সত্যিকারের ডিমের আদল তৈরি হয়। নিষেকের পর ডিম্বনালি থেকে নিঃসৃত জেলিজাতীয় অ্যালবুমিন দিয়ে একটি আস্তরণ তৈরি হয় কুসুমের চারপাশে। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর এটি পৌঁছে যায় ডিম্বনালির ইস্থমাস নামের এক জায়গায়। ইস্থমাসে পৌঁছানোর পর ডিম্বাণুর ভেতর জার্মিনাল ডিস্ক বিভাজিত হয়ে ভ্রূণের অস্তিত্ব বিকশিত হতে থাকে। অ্যালবুমিনের গায়ে অত্যন্ত পাতলা একটা আবরণের মতো তৈরি হয়। মুরগি বা হাঁসের ডিম সেদ্ধ করলে শক্ত খোসার অভ্যন্তরে খুব পাতলা একটা আবরণ চোখে পড়ে, এটি সেটিই। বাইরের খোসা বা শক্ত আবরণের জন্য ভিত্তি হিসেবেই এই পাতলা আবরণ কাজ করে। ডিমের আকার-আকৃতি কেমন হবে, সেটিও নির্ধারিত হয়ে যায় এই নরম আবরণের মাধ্যমে।

আরও পড়ুন
মা পাখিরা যখন শেষ মুহূর্তে খাবার পায় না কিংবা শরীরে সঞ্চিত ক্যালসিয়ামও থাকে না, তখন কী হতে পারে আন্দাজ করতে পারছেন? এ রকম একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল নেদারল্যান্ডসে, ১৯৭০ সালে।
সুযোগ পেলে বুবি পাখির ডিম চুরি করে মেরু শিয়াল

পাতলা আবরণ পাওয়ার পর ডিম্বনালির কোষ থেকে খুব ঘন ক্যালসিয়াম দ্রবণ নিঃসরিত হয়। সব ডিমের গায়ে এই দ্রবণের আবরণ তৈরি হয়। এরপর আবার নতুন কতকগুলো কোষ থেকে অন্য আদলে ক্যালসিয়াম নিঃসরিত হয়। সেই ক্যালসিয়ামই চূড়ান্তভাবে ডিমের গায়ে শক্ত আবরণ তৈরি করে। এই আবরণ তৈরির জন্য একটা মুরগির ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বনেটের দরকার হয়!

এখন প্রশ্ন হলো, ডিমের আবরণ বা খোসা শক্ত করার জন্য মা পাখিরা এত ক্যালসিয়াম কোথায় পায়? ইগল বা মৎস্যভুক যেকোনো পাখির জন্য এটি খুব সহজ। কারণ তারা মাছের কাঁটা, হাড়-গোড় ইত্যাদি থেকে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে নেয়। কিন্তু অন্য পাখিরা, ধরে নিন টুনটুনি কিংবা চড়ুই? এরা হন্যে হয়ে ক্যালসিয়ামের খোঁজ করে বেড়ায়। এখানে–সেখানে খুঁজে বেড়ায় শামুকের খোল কিংবা বালুকণা, নুড়ি পাথর, ছোট ছোট ক্যালসিয়াম কাঁকর। এটি সব সময় খুব আনন্দের হয় না। মা পাখিরা যখন শেষ মুহূর্তে খাবার পায় না কিংবা শরীরে সঞ্চিত ক্যালসিয়ামও থাকে না, তখন কী হতে পারে আন্দাজ করতে পারছেন? এ রকম একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল নেদারল্যান্ডসে, ১৯৭০ সালে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য প্রচুর শামুক প্রাণ হারায়, ঘাটতি পড়ে ক্যালসিয়ামের। মা পাখিরা তাদের সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষিত আবরণ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রচুর ডিম নষ্ট হয়। মা পাখিরা নিরুপায় হয়ে পাতলা আবরণসহ ডিম পাড়তে থাকে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই পাতলা আবরণও তৈরি হতে পারেনি, অর্থাৎ শুধু নিষিক্ত ডিম্বাণুটি সরাসরিই বেরিয়ে আসে।

ডিমের রঙের পেছনে কাজ করে দুটো পিগমেন্ট। লালচে-বাদামি প্রটোপরফাইরিন আর সবুজাভ বিলিভারডিন। দুটো পিগমেন্টই আসে রক্তে উৎপন্ন পদার্থের ভাঙন থেকে। শুধু এই দুটো পিগমেন্টের ঘনমাত্রা আর পরিমাণের তারতম্যের কারণে ডিমের রঙের তারতম্য হয়। সরীসৃপ প্রাণীর ডিমগুলো একেবারেই সাদা রঙের হয়, আর শক্ত খোলসও হয় না, শুধু পাতলা আবরণ থাকে। ডিম পাড়ার পর মা আর তাতে তা দেয় না, সবার অগোচরে প্রাকৃতিক তাপেই এটি পরিপূর্ণতা পায়। তাই এদের ডিমের রং হয় না। অন্যদিকে পাখির ক্ষেত্রে ডিম পাড়ার পর মা নিজেই ডিমে তা দেয়, মায়ের শরীর থেকে তাপ গ্রহণ করে ডিমটি। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য ছদ্মবেশী রঙের প্রয়োজনও পড়ে কখনো কখনো।

 সূত্র : বিবিসি ওয়াইল্ড লাইফ

আরও পড়ুন