শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি আমরা স্কুলেই পড়ি। বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়েই এটা পড়ানো হয়। বিষয়টা পদার্থবিজ্ঞানের। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই নীতির প্রথম সত্যিকার প্রমাণ দেখিয়েছিলেন একজন ডাক্তার?
পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে জীববিজ্ঞানের কি কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? স্কুল-কলেজে আমরা যখন বিজ্ঞান শিখি, তখন আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা গড়ে ওঠে। আমরা অনেকেই মনে করি, দুটোর আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ এখন হালকা গলায় বা মনে মনে হয়তো বলছেন, না, সম্পর্ক যে আছে, তা আমরা জানি। যেমন থার্মোমিটার, স্টেথিস্কোপ বা এমআরআই মেশিন—এ ধরনের যন্ত্রগুলো তো পদার্থবিজ্ঞান আর প্রকৌশল মিলেঝিলেই বানানো হয়েছে। কিন্তু আমরা ফলিত বিজ্ঞান বা প্রকৌশল নিয়ে কথা বলছি না। একদম তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানের শাখাগুলোর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছি। আর বাস্তবতা হলো, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাই পরস্পর সংশ্লিষ্ট।
আমাদের দেহের কথাই ধরুন। আমাদের দেহের ভেতরের সব প্রক্রিয়ায় আসলে রাসায়নিক। যেহেতু জীবের ভেতরে ঘটে, তাই এসব প্রক্রিয়াকে বলা হয় জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া। তবে মোটা দাগে বিষয়টি জীববিজ্ঞানেরই আলোচনার বিষয়। আবার আপনি যে হাত নাড়ছেন, হাত সংকোচিত-প্রসারিত হচ্ছে, পা চালাচ্ছেন, চোখে আলো পড়লে ছবি তৈরি হচ্ছে মস্তিষ্কে—এসব কীভাবে ঘটছে, তার ব্যাখ্যার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের দারস্থ না হয়ে উপায় নেই।
শক্তির সংরক্ষণশীলতা মানে আসলে তা-ই। এটি তাপগতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। কথাটাকে বর্ণনা করতে বলা হয়, মহাবিশ্বে শক্তির ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই। শক্তি শুধু রূপান্তরিত হয়।
তবে এসব আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। খালি চোখে একদম পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় বলেই মনে হয়, এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা। শিরোনাম ও প্রথম অনুচ্ছেদেই নিশ্চয় বুঝে গেছেন, আলোচ্য বিষয় শক্তির সংরক্ষণশীলতা।
এই সংরক্ষণশীলতা বিষয়টি আসলে কী? বিজ্ঞানীরা আসলে সাধারণ শব্দকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন। বাংলায় এই বিষয়টি—সাধারণ শব্দকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করাকে বলা হয় ‘পরিভাষা’। সংরক্ষণশীলতা তেমনি একটি পরিভাষা। এর অর্থ, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। আপনি যত যা-ই করেন, পরিমাণটি অপরিবর্তিত থাকবে। মানে, একই থাকবে।
শক্তির সংরক্ষণশীলতা মানে আসলে তা-ই। এটি তাপগতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। কথাটাকে বর্ণনা করতে বলা হয়, মহাবিশ্বে শক্তির ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই। শক্তি শুধু রূপান্তরিত হয়।
কথাটার মানে হলো, শক্তির অনেকগুলো রূপ আছে। তাপশক্তি, আলোকশক্তি, গতিশক্তি, বিভবশক্তি, যান্ত্রিক শক্তি ইত্যাদি। তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে যন্ত্র চালানো হয়, গাড়ি চালানো হয়। এরকম এক শক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু মহাবিশ্বে শক্তির মোট পরিমাণ সবসময় একই থাকে।
বিষয়টি যে পদার্থবিজ্ঞানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে জীববিজ্ঞান কীভাবে এল? এল, যখন আমরা এই নীতিটিকে জীবদেহে প্রয়োগ করলাম। একজন চিকিৎসক তাই করেছিলেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন, শক্তির সংরক্ষণশীলতা জীবদেহের জন্যও সত্যি। আর এর মাধ্যমেই প্রথম এ নীতির সত্যিকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কীভাবে, চলুন, সেই কাহিনি শুনে আসি।
২
ভদ্রলোকের নাম জুলিয়াস রবার্ট ভন মায়ার। জার্মান শারীরতত্ত্ববিদ, রাসায়নিক এবং পদার্থবিদ। শেষের তকমাটি যাঁর আলোচ্য পরীক্ষাটির জন্যই জুটেছে। তাপগতিবিদ্যার জনকদের একজন হিসাবে গণ্য করা হয় তাঁকে।
১৮১৪ সালে জার্মানির নেকার নদীর তীরের হিলব্রন শহরে তাঁর জন্ম। পড়াশোনা করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে। ১৮৪০ সালে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরি নিয়েছেন এক জাহাজে চিকিৎসক হিসেবে। তখন তাঁর বয়স ২৫।
এই জাহাজ যখন ডাচ অধিকৃত ইস্ট ইন্ডিজে (এশিয়া) পৌঁছায়, তখন কিছু নাবিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের চিকিৎসা করতে গিয়ে জীবদেহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন মায়ার। ততদিনে ফরাসি রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়েসিয়ে (সঠিক উচ্চারণ, অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে) নিজের একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন বিশ্বের সামনে। দাবি করেছেন, মানুষের দেহে তাপ উৎপাদনের পেছনে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে খাবার পোড়ানো। মানুষ যা খায়, দেহ নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে তা পুড়িয়ে শরীর উষ্ণ রাখার মতো তাপ উৎপাদন করে।
মায়ার এই অসুস্থ নাবিকদের চিকিৎসা করতে গিয়ে টের পেলেন, তাঁদের শিরার রক্ত ধমনীর রক্তের মতোই লাল। বিষয়টা তাঁকে ভাবায়। কারণ, মানুষের ধমনীর রক্ত হলো বিশুদ্ধ অক্সিজেনবাহী রক্ত। ফুসফুস থেকে এই রক্ত শরীরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আর শিরার রক্ত হলো কার্বন ডাই-অক্সাইডবাহী দূষিত রক্ত। শরীরের নানা প্রান্ত থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে পৌঁছায়, তারপর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। মায়ার জার্মানিতে চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছেন, শিরার রক্ত খানিকটা কালচে হয়। এখানে তাহলে একই জিনিস ঘটছে না কেন? তিনি ভেবে ভেবে একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু।
জার্মানির জলবায়ু তুলনামূলক শীতল। শরীরের তাই বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড পোড়াতে হয়। সেই কার্বন ডাই-অক্সাইডের অবশেষ শিরার রক্তে মিশে যায় বলেই রক্ত কালচে হয়ে যায় কিছুটা। ইস্ট ইন্ডিজের আবহাওয়া তুলনামূলক উষ্ণ। এটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অংশ। তাই অল্প কার্বন ডাই-অক্সাইড পুড়িয়েই শরীর প্রয়োজনীয় উষ্ণতা তৈরি করতে পারে। সে জন্যই এখানে নাবিকদের শিরার রক্ত কালচে হয়নি অতটা, বরং ধমনীর রক্তের মতো লালই রয়ে গেছে।
এ থেকে মায়ার একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে এলেন। দেহে শক্তি উৎপাদনের মূল প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই জারণ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় অক্সিডেশন। মানে, অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া। আর এই বিক্রিয়াকে একদম সহজ ভাষায় বলা যায়, পোড়ানো। অর্থাৎ দেহ খাদ্য পুড়িয়েই প্রয়োজনীয় সব ধরনের শক্তি উৎপাদন করে। তাপও একধরনের শক্তি। তাই প্রয়োজনীয় তাপও এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়।
মায়ার একদম খাঁটি বিজ্ঞানী। তিনি শুধু ভেবে সন্তুষ্ট নন, পরীক্ষা করতে চান। কীভাবে পরীক্ষা করা যায়? ভেবে ভেবে মায়ার সবচেয়ে সহজ সমাধানটাই বেছে নেন। পরীক্ষাটা করতে হবে কিছু ইঁদুরকে নিয়ে। তাদেরকে খাওয়াতে হবে। তারপর দেখতে হবে, তাদের দেহে কী পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সেটা যে এই খাদ্য পোড়ানোর ফলেই উৎপাদিত হচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করার উপায় কী? উপায়টা খুব সহজ। এই পরিমাণ খাদ্যকে পোড়াতে হবে সরাসরি। তারপর দেখতে হবে, এ সময় কী পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়। আগেই বলেছি, এটা শক্তির একটা রূপ। কাজেই, খাদ্য পুড়িয়ে উৎপাদিত তাপ এবং খাবার খাওয়ার ফলে দেহে উৎপন্ন শক্তির মান যদি সমান হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দেহে কোনো শক্তি হুট করে চলে আসছে না বা সৃষ্টি হচ্ছে না। শুধু রূপান্তরিত হচ্ছে।
মায়ার এই পরীক্ষা করলেন হাতে-কলমে। দেখলেন, তাঁর অনুমান সঠিক। বিষয়টাকে একদম লিখিতভাবে প্রকাশ করলেন তিনি। সেই আপ্ত বাক্যটি—শক্তির কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। শক্তি শুধু রূপান্তরিত হয়, এটাকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না।
এখান থেকেই আমরা জানতে পারি, মহাবিশ্বে শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট। সংরক্ষিত।
মায়ারের কাজটি শুধু পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নয়, গোটা বিজ্ঞান জগতের জন্যই ছিল এক দারুণ গবেষণা। কারণ, তাঁর গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, মহাবিশ্বের নিয়মের কাছে জীবদেহ আসলে বিশেষ কিছু নয়।
৩
জুলিয়াস রবার্ট ভন মায়ার যখন এই গবেষণা প্রকাশ করেন, তখন বিজ্ঞানমহল তাঁর কথায় খুব একটা গা করেনি। একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী নিজ আগ্রহে পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করছেন, তাঁকে পাত্তা দেওয়ার কী আছে! এর কিছুকাল পরে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস প্রেসকট জুল যখন একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান এবং প্রকাশ করেন, তখন সবাই বিষয়টা মেনে নেয়। তবে এর কৃতিত্ব দেওয়া হয় জুলকে। এই জুলের নামেই শক্তি পরিমাপের একটি এককের নাম রাখা হয়েছে ‘জুল’।
এ কথা শুনে মায়ার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সফল হননি। জীবনের শেষকালের দীর্ঘসময় তিনি কাটিয়েছেন মানসিক চিকিৎসালয়ে। তবে ইতিহাসের খাতায় লেখা থাকে সবই। জুলিয়াস মায়ারও তাঁর কৃতিত্ব পেয়েছেন। তাঁকে তাপগতিবিদ্যার জনকদের একজন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মায়ারের কাজটি শুধু পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নয়, গোটা বিজ্ঞান জগতের জন্যই ছিল এক দারুণ গবেষণা। কারণ, তাঁর গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, মহাবিশ্বের নিয়মের কাছে জীবদেহ আসলে বিশেষ কিছু নয়। পদার্থবিজ্ঞানের ভৌত সূত্রগুলো জড়দের জন্য যেভাবে কাজ করে, জীবের জন্যও একইভাবে কাজ করে। তাই শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি জড় পদার্থের জন্য যতটা সত্যি, জীবদেহের জন্যও একইরকম সত্যি। এটা বুঝিয়ে দেয়, অন্য ভৌত নীতিগুলোও—তা হোক কাজের সূত্র, হোক মহাকর্ষ বা গতিবিদ্যা—জড় পদার্থের জন্য তা যতটা সত্যি, জীবদেহের জন্যও ততটুকুই সত্যি।
পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান যথার্থই বলেছেন, বিজ্ঞানের শাখাগুলোকে আমরা ভাগ করে নিয়েছি নিজেদের শেখার সুবিধার্থে। কিন্তু পৃথিবী বা মহাবিশ্ব এতে কোনো ভাগ-যোগ করেনি, কোনো বৈষম্য সে করে না এ ক্ষেত্রে।