তেলাপোকার কথা শুনলে অনেকের গাঁ গুলিয়ে ওঠে, খারাপ লাগে। তবে এ জন্য কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের প্রাণীগুলোর মধ্যে একটি। তেলাপোকা পছন্দ করে এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তেলাপোকার অনেক দোষ। নোংরা জায়গায় থাকে, রাতে শব্দে চলে, আবার কখনো ওড়ে। নোংরা জায়গায় থাকা একটা পোকাকে অপছন্দ হতেই পারে। তবে আজ বিপরীত কিছু কথা জানাব। তেলাপোকার কিছু ভালো দিক নিয়েই আজকের আলোচনা।
পৃথিবীর কী উপকারে লাগে তেলাপোকা? সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তেলাপোকা উদ্ভিদ পরাগায়ণে সাহায্য করে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানি, পরাগায়ণে মৌমাছির মতো পোকামাকড়ের বেশ সুনাম। তবে এখন তেলাপোকাও এই সুনামের ভাগিদার হচ্ছে। এতদিন এরা পরাগায়ণের জগতে ছিল অবহেলিত। গবেষণা বলছে, যে বনাঞ্চল অন্ধকার থাকে, সেখানে মৌমাছি ও প্রজাপতির মতো প্রচলিত পরাগবাহীরা সাধারণত যায় না। সেখানে যায় তেলাপোকা।
জাপানের কোবে ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক কেনজি সুয়েতসুগু বিবিসিকে বলেছেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে পরাগায়ণে নাম ছিল মৌমাছি, মাছি, পোকা ও প্রজাপতির। তবে নতুন গবেষণাগুলো দেখাচ্ছে, তেলাপোকার মতো অপ্রত্যাশিত অতিথিরাও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিকল্প পরাগবাহকেরা (তেলাপোকা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এমন পরিবেশে, যেখানে প্রচলিত পরাগবাহীদের তেমন দেখা যায় না। যেমন ঘন ছায়াযুক্ত বনভূমি, যেখানে আলো কম ঢোকে। এখানে সাধারণ পরাগবাহকদেরও কম দেখা যায়।’
ক্রিটেশিয়াস যুগের শুরুর দিকে (প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ থেকে ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে) যখন প্রথম ফুলের কলি থেকে ফুল ফুটছিল, তখন পরাগবাহীদের আগমন ঘটে পৃথিবীতে। তবে সেই প্রথম দিককার ফুলে পরাগায়ণ কিন্তু মৌমাছি বা প্রজাপতি করেনি, করেছে তেলাপোকা।
গবেষণা বলছেন, তেলাপোকা বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে পরাগবাহক হিসেবে কাজ করে। এটি এতদিন গবেষকদের জানা ছিল না। কারণ তেলাপোকারা রাতে চলাচল করে এবং মৌমাছির মতো সহজে এদেরকে দেখা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেলাপোকার মাধ্যমে পরাগায়ণের তথ্য পাওয়া গেছে। যেমন ফ্রেঞ্চ গায়ানার পাথুরে জায়গায় জন্মানো ক্লুসিয়া ব্লাটোফিলা (Clusia blattophila) গাছের ক্ষেত্রে, কিংবা চীনের বিরল ও বিপন্ন ভিনসেটোক্সিকাম হেইনানেনসি (Vincetoxicum hainanense) গাছের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা আছে।
সুয়েতসুগু জাপানের ঘন, চিরসবুজ বনসম্পন্ন ইয়াকুশিমা দ্বীপে তেলাপোকার মাধ্যমে পরাগায়ণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি মূলত বালানোফোরা টবিরাকোলা (Balanophora tobiracola) নামে একটি ছত্রাকের মতো পরজীবী উদ্ভিদে তেলাপোকার সহায়তায় পরাগায়ণ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন।
তেলাপোকা যেহেতু লুকিয়ে থাকে এবং রাতে বের হয়, তাই এই উদ্ভিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বোঝার জন্য তিনি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন, একটি ফুলগাছে একটি ডিজিটাল ক্যামেরা বসান, যা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত প্রতি ৫০ সেকেন্ড পরপর ছবি তোলে। এতে তিনি ৩৪ হাজারের বেশি ছবি পান। সেই ছবিতে দেখা যায়, তেলাপোকারা রাতে ফুলের ওপরে ভ্রমণ করছে। তিনি সেই তেলাপোকাগুলো ধরে এদের শরীরে লেগে থাকা পরাগ গুণে দেখেন।
এই গবেষণা ২০২৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এটি এই ধরনের গাছে তেলাপোকার কার্যকর পরাগায়ণের ‘সরাসরি প্রথম প্রমাণ’ বলে উল্লেখ করেন এই বিজ্ঞানী।
একটি তেলাপোকা একবার ফুলের ওপরে এলে উদ্ভিদে ফল ধরার সম্ভাবনা কতটা বাড়ে, তা জানার জন্য তিনি পাঁচটি ফুলে সূক্ষ্ম জালের আবরণ বসান। এরপর শুধু একবার মারগাটা স্যাটসুমানা (Margattea satsumana) প্রজাতির তেলাপোকাকে (এই উদ্ভিদে সবচেয়ে বেশি আসে এটি) জাল সরিয়ে আবরণের ভেতরে প্রবেশ করতে দেন। তারপর আবার জাল দিয়ে ঢেকে দেন। এক্ষেত্রে পরাগবাহী প্রবেশ না করার সঙ্গে একবার তেলাপোকার প্রবেশের তুলনা করে দেখেন তিনি।
এই গবেষণা ২০২৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এটি এই ধরনের গাছে তেলাপোকার কার্যকর পরাগায়ণের ‘সরাসরি প্রথম প্রমাণ’ বলে উল্লেখ করেন এই বিজ্ঞানী। কারণ তাঁর গবেষণা বলছে, ‘একটি তেলাপোকা ফুলের ওপরে এলে প্রায় ৪০ শতাংশ ফুলে পরাগ নল তৈরি হয়। এটি সফল পরাগায়ণের একটি শক্ত প্রমাণ।’