মরিচের ঝাল রহস্য

ভারতবর্ষে মরিচ এসেছিল স্প্যানিশ ব্যবসায়ীদের হাত ধরে, সেই মোগল আমলে। মাত্র ৪০০ বছরেই এটি আমাদের খাদ্যতালিকার অন্যতম উপকরণে পরিণত হয়েছে। সেই মরিচের ঝাল রহস্য...

মরিচ ছাড়া বাংলাদেশে অধিকাংশ খাবারের কথা আজ ভাবাই যায় না (মিষ্টি খাবারের কথা অবশ্য আলাদা)। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মরিচ এখন এমনভাবেই মিশে গেছে। অথচ ভারতবর্ষে মরিচ এসেছিল স্প্যানিশ ব্যবসায়ীদের হাত ধরে, সেই মোগল আমলে। মাত্র ৪০০ বছরেই এটি আমাদের খাদ্যতালিকার অন্যতম উপকরণে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের তরকারিতে মরিচ খাই আমরা। কেউ কেউ কাঁচামরিচও খান। ফুচকা বা চটপটির সঙ্গেও মরিচ খান অনেকে। সবাই জানেন, মরিচ খেলে ঝাল লাগে। প্রচণ্ড ঝালের কারণে পানিও বেরিয়ে আসে অনেক সময় চোখ দিয়ে। প্রশ্ন হলো, কেন? মরিচ খেলে ঝাল লাগে কেন?

শুনে অবাক হতে পারেন, মরিচ এক ধরনের ফল। তবে অন্যান্য ফলের চেয়ে মরিচ গোত্রের উদ্ভিদগুলো খানিকটা ভিন্ন। এসব উদ্ভিদের ভেতরে ‘ক্যাপসাইসিন’ নামে এক ধরনের রাসায়নিক উৎপন্ন হয়। মরিচ ঝাল লাগার কারণও এটিই—ক্যাপসাইসিনের উপস্থিতি।

শরীরে অ্যান্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক আরেকটি নিউরোকেমিক্যাল নিঃসরণ করে। এর নাম ডোপামিন। এই ডোপামিন মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয়ে আমাদের ভালো লাগা,খুশি থাকা ও সুখের অনুভূতি দেয়।

আমরা যখন ঝাল কিছু খাই, তখন মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন আমাদের মুখে থাকা ‘পলিমোডাল’ স্নায়ুকে (Polymodal Nociceptor Nerves) উত্তেজিত করে তোলে। এই স্নায়ুর কাজ হলো ব্যথা, তাপমাত্রা ও ঝাল শনাক্ত করা। পাশাপাশি এগুলোর তীব্রতার ধারণা সম্পর্কে আমাদের মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় এই স্নায়ু। ঝাল জাতীয় কিছু খাওয়ার সময় মুখে থাকা পলিমোডাল স্নায়ু উত্তেজিত হয় এবং দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুর (Central Nervous System) মাধ্যমে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। আমাদের মস্তিষ্ক সেই সংকেত বিশ্লেষণ করে সেটা কোন ধরনের ব্যথা, তা আমাদের জানিয়ে দেয়।

মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন যখন স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তোলে, তখন মস্তিষ্ক ঝালের মাধ্যমে সৃষ্ট ‘বার্নিং সেনসেশন’ বা ‘পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি’ চিহ্নিত করে। এই ঝাল অনুভূতি থেকে রক্ষার জন্য মস্তিষ্ক থেকে অ্যান্ডরফিন (Andorphine) নামে এক ধরনের নিউরোকেমিক্যাল (এর ভালো বাংলা নেই; সম্ভবত বলা যায়, স্নায়বিক রাসায়নিক) নিঃসৃত হয়। এই অ্যান্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেয়। শরীরে অ্যান্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক আরেকটি নিউরোকেমিক্যাল নিঃসরণ করে। এর নাম ডোপামিন। এই ডোপামিন মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয়ে আমাদের ভালো লাগা,খুশি থাকা ও সুখের অনুভূতি দেয়।

মরিচ নিয়ে কাজ করছেন একজন নারী

মরিচের ঝাল আমাদের লালাগ্রন্থিকে উত্তেজিত করে মুখের ভেতর কিছুটা লালারস নিঃসরণ করে, যেন এই লালা মরিচের ক্যাপসাইসিনের ঘনত্বকে হালকা করে দিয়ে ঝাল লাগার তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে। তাই লালা ঝাল-আক্রান্ত স্থানে ক্যাপসাইসিনের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়।

প্রসঙ্গত একটি দারুণ গবেষণার কথা বলে লেখাটি শেষ করি। এই গবেষণার জন্য ২০২১ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড জুলিয়াস। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা ১৯৯৭ সালে পেইন বা ব্যথা অনুভবের বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আগেই বলেছি, ক্যাপসাইসিন আমাদের মুখের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পলিমোডাল স্নায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। জুলিয়াস চিন্তা করলেন, ক্যাপসাইসিন আর স্নায়ুতন্তুর মাঝে অবশ্যই কিছু আছে। যেটা হয়তো ক্যাপসাইসিনের সঙ্গে স্নায়ুর এই ‘যোগাযোগ’ করিয়ে দেয়। এই ‘মাঝামাঝি কিছুটা’ আসলেই আছে কি না, তা কেউ জানত না। জুলিয়াস ভাবলেন, কিছু যদি থাকে, তাহলে সেটা দেখতে কেমন?

কথায় আছে, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। জুলিয়াস তার মূর্ত প্রমাণ!

স্নায়ু কোষ থেকে জিন সংগ্রহ করে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট জিন পুল বা জিনের আধার বানালেন জুলিয়াস। প্রায় ১৬ হাজার জিন পুল তৈরি করে শুরু করলেন গবেষণা। প্রতিটি জিন পুলকে আলাদা আলাদাভাবে প্রয়োগ করলেন কিডনি কোষে। কিডনি কোষ সেই জিনগুলোকে প্রোটিন আকারে প্রকাশ করতে লাগল। এরপর কিডনি কোষে তিনি ক্যাপসাইসিন প্রয়োগ করলেন। ক্যাপসাইসিন যদি কিডনি কোষকে উত্তেজিত করতে পারে, তাহলে কোষের বাইরে থেকে ক্যালসিয়াম আয়ন কোষের ভেতরে প্রবেশ করবে, আর বিশেষ রঙের সাহায্যে সেই ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি বোঝা যাবে।

আরও পড়ুন
একটি ভাঙা মরিচ
আরও পড়ুন

কথায় আছে, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। জুলিয়াস তার মূর্ত প্রমাণ! ১৬ হাজার জিন পুল থেকে একটি জিন পুল ঠিকই কাজ করল। ১১ নম্বর পুলটি যে কোষে প্রকাশ পেয়েছিল, সেটি কোষের ভেতর ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি অনেক বাড়িয়ে দিল। তার মানে এই জিনটি থাকার কারণে ক্যাপসাইসিন কিডনি কোষকে উত্তেজিত করতে পেরেছে। জিনটি আসলে একটি রিসেপ্টর প্রোটিনের প্রকাশ ঘটায়। জুলিয়াস এর নাম দেন VR1। V আদ্যক্ষরটি এসেছে ভ্যালিনাইল থেকে। ক্যাপসাইসিনে এই রাসায়নিক গ্রুপটি আছে। তাই ক্যাপসাইসিনকে ভ্যালিনয়েড পদার্থও বলা হয়। পরে এই রিসেপ্টরের নাম বদলে দেওয়া হয় TRPV1। এই রিসেপ্টর বা স্নায়ুগ্রাহক আবিষ্কার করার জন্যই ডেভিড জুলিয়াস ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর এর হাত ধরে আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছি মরিচ রহস্যের পেছনের কথা।

লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সায়েন্স ডেইলি, বিজ্ঞানচিন্তা