শীতকালে কি বেশি ঘুম পায়
নভেম্বরের মাঝামাঝি নিয়মিত অভ্যাসটা অনেকের বদলে যেতে থাকে। এমনিতে হয়তো সন্ধ্যায় আড্ডা দিতেন আর সকালে একটু দৌড়াতেন, কিন্তু এই সময়ে শরীরটা যেন কিছুতেই সায় দিতে চায় না। কেমন একটা আলসেমি লাগে! মনটা চায় শুধু কম্বলের নিচে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে, অথবা সোফায় গুটিসুটি মেরে একটা লম্বা ঘুম দিতে।
শীতের আমেজ এলেই আমাদের এমন ঘুম ঘুম পায়। এটা কি শুধু আলসেমি, নাকি কম আলো আর ঠান্ডা আবহাওয়ায় আমাদের সত্যিই বেশি ঘুমের দরকার হয়?
সত্যি বলতে, উত্তরটা ঠিক হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ক্যারিন জনসন বলছেন, ‘দিন ছোট হয়ে এলে যে আমাদের বাধ্যতামূলক বেশি ঘুমের দরকার হয়, তা আমি মনে করি না। তবে এই সময় সবার একটু বেশি ঘুম ঘুম পায়।’
প্রশ্নটা ওখানেই। কেন শীতকালে মানুষ বেশি ঘুম ঘুম অনুভব করে? এর পেছনের রহস্যটা কী? চলুন, সেই রহস্যই খোলাসা করা যাক।
ঘুম ঘুম ভাবের জন্য প্রথমত দায়ী মেলাটোনিন। এই হরমোন আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। আমাদের ঘুম ও জাগার চক্র নিয়ন্ত্রণ করে এই হরমোনই। দিন যখন ছোট হয়ে আসে, তখন সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। তখনই আমাদের শরীরে এই মেলাটোনিন হরমোনের রাজত্ব বেড়ে যায়। আর মেলাটোনিন বেশি মানেই ঘুম ঘুম ভাব, ক্লান্তি আর কম শক্তি!
ঘুম ঘুম ভাবের জন্য প্রথমত দায়ী মেলাটোনিন। এই হরমোন আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। আমাদের ঘুম ও জাগার চক্র নিয়ন্ত্রণ করে এই হরমোনই।
দ্বিতীয়ত দায়ী আমাদের শরীরের ভেতরকার দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম। এই ঘড়িটা সূর্যের আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। কিন্তু শীতকালে যখন দিনের আলো কমে যায়, তখন এই দেহঘড়িটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আমাদের ঘুমের সময়সূচি ওলটপালট হয়ে যায়, আর ক্লান্তি জেঁকে বসে। বিশেষ করে, সকালে যদি ঠিকমতো সূর্যের আলো না পাওয়া যায়, তবে এই ঘড়িটা ঠিকমতো রিসেট হতে পারে না।
শীতকালে আমরা ঘরের ভেতরেও বেশি সময় কাটাই। প্রকৃতির ছোঁয়া কম লাগে, আলো কম পাই। ফলে আমাদের ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটে। সকালে যখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে, তখন বিছানা ছাড়াটা যে কী কঠিন, তা আমরা সবাই জানি! অথচ এই সকালের রোদটাই আমাদের দেহঘড়িকে ঠিক করার জন্য সবচেয়ে জরুরি।
তবে একটা দারুণ খবরও আছে। ২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, শীতকালে আমরা গ্রীষ্মের চেয়ে বেশি আরইএম স্লিপ উপভোগ করি। আরইএম হলো ঘুমের সেই পর্যায়, যখন আমরা স্বপ্ন দেখি। এই ঘুমটা আমাদের মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে, মেজাজ ভালো রাখতে এবং মানসিক স্বচ্ছতার জন্য ভীষণ জরুরি।
প্রাণীরা যেমন শীতকালে হাইবারনেশন বা শীতঘুমে চলে যায়, মানুষেরা তা না করলেও আমাদের মধ্যেও একটা হাইবারনেশন-মোড চালু হয়ে যায়! আমরা একটু ধীরস্থির হয়ে যাই, ভারী বা গরম খাবার খেতে ভালোবাসি, আর একটু বেশিই ক্লান্ত থাকি। কম সূর্যালোকের ক্ষতিপূরণ হিসেবেই হয়তো আমাদের শরীর তখন বেশি বেশি আরইএম ঘুমের ব্যবস্থা করে দেয়।
২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, শীতকালে আমরা গ্রীষ্মের চেয়ে বেশি আরইএম স্লিপ উপভোগ করি। আরইএম হলো ঘুমের সেই পর্যায়, যখন আমরা স্বপ্ন দেখি।
এর সঙ্গে যোগ হয় তাপমাত্রা আর খাবার। সাধারণত আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলে মানুষের ঘুম ভালো হয়। কিন্তু বাইরে ঠান্ডা বলে যদি আমরা ঘরের ভেতর হিটার চালিয়ে বেশি গরম করে ফেলি, তবে হিতে বিপরীত হয়! তখন আরও বেশি ঘুম ঘুম বোধ করি। যদিও আমাদের দেশে হিটার চালানোর তেমন প্রচলন নেই। আবার শীতকালে আমাদের শরীরকে তাপ ধরে রাখার জন্য বেশি কাজ করতে হয়। এতে আরও ক্লান্তি অনুভূত হয়।
আবার শীত এলেই আমাদের ভারী, শর্করাজাতীয় খাবার বেশি খেতে ইচ্ছে করে। এই খাবারগুলো হজম হতে বেশি সময় নেয়। ফলে আমাদের শক্তির মাত্রা কমে যায় এবং ঘুম পায়। সব মিলিয়ে এটা একটা চক্রের মতো।
কিছু মানুষের জন্য এই ক্লান্তিটা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। একে বলে সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা স্যাড (SAD)। এটা এক ধরনের বিষণ্ণতা, যা শীতকালে সূর্যালোকের অভাবে দেখা দেয়। সূর্যালোক কমলে আমাদের শরীরে শুধু মেলাটোনিনই বাড়ে না, সেরোটোনিন নামে মেজাজ ভালো রাখার হরমোনও কমে যায়। এতেও তীব্র ঘুম ঘুম ভাব হয়।
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা স্যাড এক ধরনের বিষণ্ণতা, যা শীতকালে সূর্যালোকের অভাবে দেখা দেয়। সূর্যালোক কমলে আমাদের শরীরে সেরোটোনিন নামে মেজাজ ভালো রাখার হরমোনও কমে যায়।
তাহলে এই শীতের আলসেমি থেকে বাঁচার উপায় কী? উপায় একটাই, রুটিন মেনে চলা। যখন ঘুম পায়, তখন ঘুমান। যখন তরতাজা লাগবে, তখন উঠুন। কিন্তু ঘুমের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় অবশ্যই রাখুন। আর সকালের আলোর গুরুত্ব কোনোভাবেই ভোলা যাবে না। সকালের আলোয় দারুণ উপকার পাওয়া যায়।
শিক্ষার্থীদের যেহেতু স্কুল বা কাজের জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়, তাই তারা একটু আগে ঘুমাতে গেলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে। সন্ধ্যায় মোবাইল বা টিভির মতো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র বন্ধ রাখা বলো। দিনের বেলা একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান, আর অবশ্যই সম্ভব হলে ব্যায়াম করুন। মৌসুমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যদি এক-আধ ঘণ্টা বেশি ঘুমান, তাতে আর ক্ষতি কী!