বিশ্বের দীর্ঘায়ু ৫ প্রাণী

প্রকৃতির অফুরন্ত বিস্ময়ের মধ্যে জীবন্ত প্রাণীদের অপার বৈচিত্র্য আমাদের চিরকাল বিস্মিত করে। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু অদ্ভুত রহস্য। এর একটি হলো কিছু প্রাণীর দীর্ঘায়ু। মানুষের গড় আয়ু যখন সত্তর-আশির কোঠায় সীমাবদ্ধ, তখন পৃথিবীতে কিছু প্রাণী আছে, যাদের জীবনকাল শতাব্দী ছাড়িয়েও চলে যায়।

এই লেখায় আমরা জানব এরকম কিছু বিস্ময়কর দীর্ঘায়ু প্রাণীর কথা। জানব তাদের অসাধারণ আয়ুষ্কালের রহস্য, তাদের জীবনযাত্রার ধরন ও তাদের জীববিজ্ঞানের কিছু অনন্য দিক।

টারিটোপসিস ডোরনি জেলিফিশ

১. চিরঞ্জীবী জেলিফিশ

এই কথাটি সত্যি কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগে, তাই না? কিন্তু প্রকৃতির বিস্ময়কর জগতে এমনই এক জেলিফিস আছে, যাকে ‘অমর’ বলা হয়। এর নাম ব্যাকওয়ার্ড এজিং জেলিফিশ। প্রাণিবিদদের কাছে এটি পরিচিত টারিটোপসিস ডোরনি (Turritopsis dohrnii) নামে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর প্রতিবেদন অনুসারে, এই জেলিফিশের জীবনচক্র অন্যান্য জীবের চেয়ে ভিন্ন।

অন্যান্য জীবের মতো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর দিকে না এগিয়ে টারিটোপসিস ডোরনি ‘ট্রান্সডিফারেন্সিয়েশন’ নামে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পলিপ অবস্থায় ফিরে যায়। পলিপ অবস্থায় টারিটোপসিস ডোরনি জেলিফিশ এটির কোষগুলোকে পুনর্গঠিত করে এবং নতুন জেলিফিশে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াটি প্রাণীটি বারবার চালিয়ে যেতে পারে। এর মানে হলো, এটি কার্যত অমর।

এই জেলিফিশ মানুষের নখের আকারের মতো ছোট। ১৮৮৩ সালে দিকে প্রথম ভূমধ্যসাগরে আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু এর অনন্য ক্ষমতার ব্যাপারে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত কেউ জানত না।   

গ্রিনল্যান্ড হাঙ্গর

২. গ্রিনল্যান্ড হাঙ্গর

পৃথিবীতে ১ হাজারেরও বেশি প্রজাতির হাঙ্গর রয়েছে। এর মধ্যে গ্রিনল্যান্ড হাঙ্গর (Greenland shark) পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় ও দীর্ঘজীবী মেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা আর্কটিক মহাসাগর ও উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে বাস করে। ধীর বৃদ্ধির হার এবং সম্ভবত মেরামতের বিশেষ জিনের কারণে এরা প্রায় ২৭২ থেকে ৫১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

এই গ্রিনল্যান্ড হাঙ্গর সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ২ হাজার ৭৪৩ মিটার বা ৯ হাজার ফুট নিচে পাওয়া যায়। এরা দৈর্ঘ্যে ৭ দশমিক ৩ মিটার বা ২৪ ফুটের মতো হতে পারে। ওজন ১ হাজার ১৭৯ কেজি বা ২ হাজার ৬০০ পাউন্ড-এর বেশি হতে পারে। এরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ০.৩ মিটার বা এক ফুট নড়াচড়া করে, যা এত ধীর যে মনে হয় এরা বুঝি স্থির। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন হাঙ্গরটির বয়স ছিল প্রায় ৩৯০ বছর।

রাফআই রকফিশ

৩. রাফআই রকফিশ

রকফিশ নামটি এসেছে এদের সমুদ্রের তলদেশে পাথরের মধ্যে লুকিয়ে থাকার স্বভাবের কারণে। সমুদ্রে বিভিন্ন প্রজাতির রকফিশ পাওয়া যায়। এরা মাছ হিসেবে সুস্বাদু। তাই এদের শিকার করা হয়। তবে কিছু প্রজাতির রকফিশ ২০০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে। সেবাস্টেস অ্যালেউটিয়ানাস (Sebastes aleutianus) নামের রকফিশ ২০৫ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড গড়েছে।

রকফিশের দীর্ঘজীবী হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। এদের বিপাক ক্রিয়া খুব ধীর, ফলে তাদের কোষ ক্ষয়ের হার কম।

রাফআই (Rougheye) রকফিশ পাওয়া যায় উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে। এদের শরীর কিছুটা লাল ও গোলাপি বর্ণের। একটি প্রাপ্তবয়স্কের রকফিশের গড় আকার প্রায় ৮০ সেমি বা ৩১ ইঞ্চি। এগুলো সাধারণত ১৫০ থেকে ৮০০ মিটার বা ৪৯০ থেকে ২ হাজার ৬২০ ফুট গভীরতায় পাওয়া যায়। রাফআই রকফিশের ওজন সাধারণত ছয় থেকে সাত কেজির মধ্যে হয়। তবে কিছু কিছু মাছ ১৪ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

১৮৪ বছর বয়স্ক জোনাথন

৪. দানবীয় কচ্ছপ

ধীরগতির মানেই যদি হয় দীর্ঘায়ু, তবে প্রথমেই মনে আসবে কচ্ছপের কথা। ধীর গতির এই প্রাণীর জীবনও ধীরগতিতে চলে। গ্যালাপাগোস জায়ান্ট টরটয়েজ প্রজাতির কচ্ছপ গড়ে ১৯০ বছর ধরে টিকে থাকে পৃথিবীতে। বর্তমানে জীবিত সবচেয়ে বয়স্ক কচ্ছপের নাম জনাথন। সেন্ট হেলেনার এই কচ্ছপের বয়স হলো ১৮৪ বছর।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখেছেন, এই দানবীয় কচ্ছপের বিপাক প্রক্রিয়া খুব ধীর গতির। এ কারণে এদের শক্তিও ক্ষয় হয় অত্যন্ত ধীরে। এর কারণ এদের শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা ও জিনগত বৈশিষ্ট্য। ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী কচ্ছপ জোনাথন গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন
বোহেড তিমি

৫. বোহেড তিমি

আলাস্কার উত্তর প্রান্তের কাছে, আর্কটিক মহাসাগরের বরফাচ্ছন্ন সাগরে বাস করে বোহেড তিমি বা বেলেনা মিস্টিসেটাস (Balaena mysticetus)। বোহেড তিমি বেলেনিডা তিমি পরিবারের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী বিশালাকার প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম।

প্রাণিজগতে বোহেড তিমির মুখ এবং মাথা সবচেয়ে বড়, যা তাদের শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তাদের মুখের ওপরের চোয়ালের পৃষ্ঠদিক ধনুকের মতো, যা অন্যান্য তিমিদের থেকে ভিন্ন। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাদের নামকরণ করা হয়েছে বোহেড (Bowhead) তিমি।

রুশ বোহেড তিমি ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা এবং ২০০ টন পর্যন্ত ওজনের হতে পারে। স্ত্রী তিমি কিছুটা ছোট হয়। এদের শরীরের বর্ণ গাঢ় বাদামী বা কালো রঙের এবং মাথার ওপরে সাদা দাগ থাকে। অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক বোহেড তিমির জিন বিশ্লেষণ করেছেন দেখেন, এটি ২৬৮ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: টপটেনজ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, উইকিপিডিয়া