জটিল রোগ নিয়ে গবেষণায় ব্রেকথ্রু পুরস্কার

আলবার্তো অস্কেরিও (বাঁয়ে) ও স্টিভেন হাউজার

২০২৫ সালে জীববিজ্ঞানে ব্রেকথ্রু পুরস্কার পেয়েছে মোট তিনটি দল। এরমধ্যে একটি দলে আছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্ববিদ আলবার্তো অস্কেরিও এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ স্টিভেন হাউজার। তাঁরা মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস নামে একটি জটিল রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন। অন্য দুটি দলের মধ্যে ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ওষুধ আবিষ্কারের জন্য ড্যানিয়েল ড্রাকার, জোয়েল হাবেনার, জেন্স হোলস্ট, লোটে নুডসেন ও স্বেতিয়ানা মোজসভ এবং জিন সম্পাদনার নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য ডেভিড লিউ একই বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন।

তবে এই লেখায় শুধু প্রথম দলের দুই বিজ্ঞানীর গবেষণা নিয়ে আলোচনা করা হবে। হাউজার এবং অস্কেরিও বহু বছর ধরে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। একসময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু এই দুই বিজ্ঞানীর হাত ধরে এসেছে সেই সমস্যার সমাধান।

মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস একটা জটিল রোগ। এ রোগ হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের নার্ভ সিস্টেমের ওপর আক্রমণ করে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাজ হলো শত্রুর আক্রমণ থেকে শরীরকে বাঁচানো। কিন্তু এই রোগের ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ভুল করে নিজের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর আক্রমণ করে। বিশেষ করে এটি মাইলিন নামে একটি ফ্যাটি টিস্যুকে নষ্ট করে। মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের স্নায়ু কোষগুলোকে ঘিরে রাখে এই মাইলিন। এটিই স্নায়ু সংকেতকে দ্রুত পরিবহন করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন এই মাইলিন নষ্ট হয়ে যায়, তখন স্নায়ুগুলো আর ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে দেখা দেয় নানা রোগের উপসর্গ। যেমন, হাত-পা অবশ হয়ে আসা, দুর্বলতা, ব্যথা, মাথা ঘোরা, অস্পষ্ট কথা বলা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

এই রোগ নিয়ে প্রায় ৪৫ বছর আগে কাজ শুরু করেন স্টিভেন হাউজার। তিনি তখন আন্দ্রেয়া নামে এক তরুণীর চিকিৎসা করছিলেন। মেয়েটি কাজ করত হোয়াইট হাউসে। হঠাৎ করেই এই রোগ তার জীবন এলোমেলো করে দেয়। সেই অসহায় তরুণীর অবস্থা দেখে হাউজার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি এই রোগের কারণ খুঁজে বের করবেন। তৈরি করবেন এর প্রতিষেধক। তখন হাউজারের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর।

আগেই বলেছি, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের কোনো ভালো চিকিৎসা তখন ছিল না। আসলে এই রোগের কারণ সম্পর্কে তখন ঠিকভাবে জানতেনই না চিকিৎসকেরা। শুধু জানা ছিল, আমাদের ইমিউন সিস্টেমই ভুল করে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর ওপর আক্রমণ করে। আর এ জন্য বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের টি-সেল নামে একটি কোষকে দায়ী করেছিলেন।

কিন্তু হাউজার এই ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি বি-সেল নামে অন্য আরেকটি রোগ প্রতিরোধকারী কোষকেও এজন্য দায়ী ভেবেছিলেন। কিন্তু শুধু ভাবলেই তো হবে না, পরীক্ষা করেও প্রমাণ করতে হবে। হাউজার এই বি-সেল নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমে ছোট বানরের ওপর পরীক্ষা করে দেখেন, বি-সেলও স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। শুরুর দিকে অনেকে তাঁর এই ধারণা মেনে নেননি। কিন্তু হাউজার তাতে দমে জাননি। নিজের দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি জেনেনটেকের সাহায্যে রোগীদের ওপর পরীক্ষা চালান। ফলাফল পান ইতিবাচক। দেখা যায়, বি-সেলকে লক্ষ্য করে তৈরি করা ওষুধ মস্তিষ্কের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আর হাউজারের এই আবিষ্কারের ফলে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত অনেক রোগীর নতুন চিকিৎসার পথ খুলে যায়।

যদিও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের এখনো কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণা নতুন আশা দেখাচ্ছে।

অন্যদিকে আলবার্তো অস্কেরিও নামে আরেক বিজ্ঞানী ভাবছিলেন, কেন এই রোগটা উত্তর গোলার্ধের মানুষের বেশি হয়। তিনি ভেবেছিলেন, এই রোগের সঙ্গে সম্ভবত কোনো ভাইরাস জড়িত। তাই তিনিও নিজের মতো গবেষণা চালিয়ে যান। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে লাখ লাখ তরুণের ওপর গবেষণা চালান। অবশেষে ২০২২ সালে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। প্রমাণ করে দেখান, এপস্টেইন-বার ভাইরাস বা ইবিভি নামে খুব সাধারণ একটি ভাইরাসও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের জন্য দায়ী। এই ভাইরাসের কারণে সাধারণত ‘মনো’ রোগ হয়। অবশ্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষেরই মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগ হয় না। কিন্তু যাদের মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগ হয়েছে, তাদের প্রায় সবার শরীরেই এই ভাইরাস পাওয়া গেছে।

এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এখন এ রোগের কারণ আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। যদিও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের এখনো কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণা নতুন আশা দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, অস্কেরিও মনে করেন, তাঁদের এই গবেষণা হয়তো অ্যালজাইমার্স বা অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিসের (এএলএস) মতো অন্য স্নায়ুরোগের কারণ বুঝতেও সাহায্য করবে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, মেডিকেল এক্সপ্রেস ও সায়েন্টেফিক আমেরিকান