শীতে সুরক্ষা

তীব্র ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে এ বছর। শৈত্যপ্রবাহ বইতে শুরু করেছে সারা দেশে। পরিবেশের তাপমাত্রা নেমে গেছে ঝপ করে। কিন্তু বাংলাদেশে আর কতই-বা শীত পড়ে! এ সময় কানাডা বা উত্তর আমেরিকার তাপমাত্রা মাইনাসের অনেক নিচে নেমে যায়। ঝড়ো বাতাস বইলে তো কথাই নেই। আর অ্যান্টার্কটিকা? বাপ রে! কিন্তু ও রকম জায়গাতেও তো মানুষ থাকে। কীভাবে এই ভীষণ ঠান্ডা বা শীতল পরিবেশে টিকে থাকে মানুষ?

মানবদেহের কোর টেম্পারেচার বা অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হলো ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৩৬ ডিগ্রিতে নামলেই আমরা শীত অনুভব করি, কাঁপতে থাকি

গবেষকেরা বলেন, মানুষ মূলত গ্রীষ্মপ্রধান বা গরম এলাকার প্রাণী। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ উষ্ণ এলাকাতেই বাস করত। কেননা গরমের সঙ্গে যতটা খাপ খাওয়াতে অভ্যস্ত মানুষ, শীতের সঙ্গে ততটা নয়। মানবদেহের কোর টেম্পারেচার বা অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হলো ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৩৬ ডিগ্রিতে নামলেই আমরা শীত অনুভব করি, কাঁপতে থাকি। আরেক ডিগ্রি নিচে নামলে, মানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মোটামুটি শরীর অসাড় হয়ে যায়, স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে আসে, ত্বকের নিচে রক্তনালি কুঁচকে যায়। তার মানে শরীরের তাপমাত্রার সামান্য এক দুই ডিগ্রি পরিবর্তনই আমাদের জন্য সহ্য করা কঠিন। যখন পরিবেশের তাপমাত্রা হু হু করে নামতে থাকে, তখন দুটো উপায়ে মানুষ নিজের দেহের এই কোর টেম্পারেচারকে রক্ষা করে। একটা হলো শিভারিং টেকনিক, মানে শরীরের মাংসপেশির কাঁপুনির মাধ্যমে বাড়তি তাপ বা হিট উত্পাদন করা। আর দ্বিতীয়টি, স্বাভাবিক আচরণগত পরিবর্তন। যেমন দেহভঙ্গি পাল্টানো, বাড়তি পোশাক গায়ে চাপানো বা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্থানে আশ্রয় নেওয়া ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
দেহের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রক্ত চলাচল অব্যাহত রাখার জন্য বাইরে নাকের ডগা, গাল, হাত পায়ের আঙুলে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে এই জায়গাগুলো সাদা বা ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে

ঠান্ডার মুখোমুখি হলে প্রথম যে ব্যাপারটা ঘটে, তা হলো আমাদের ত্বকের নিচের রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে, যাতে ত্বক থেকে বেশি তাপ হারাতে না পারে। এর ফলে রক্তসংবহনতন্ত্রে একটা পরিবর্তন আসে। দেহের জলীয় অংশ (ফ্লুইড ভলিউম) হঠাৎ খানিকটা বেড়ে যায়, ওটা বের করে দেওয়ার জন্য আবার বারবার প্রস্রাবের বেগ চাপে। এই জন্য শীতকালে আমাদের বারবার বাথরুমে যেতে হয়। এ ছাড়া ত্বকের নিচের রক্তনালি সংকুচিত হওয়ার কারণে ত্বক প্রথমে লালচে, তারপর সাদা, সবশেষে নীল দেখাতে পারে। এরপর শুরু হয় কাঁপুনি বা শিভারিং। মাংসপেশিগুলো আমাদের অজান্তেই সংকুচিত, প্রসারিত হয়, মানে কাঁপতে থাকে। এতে শরীরে বাড়তি তাপ বা হিট উত্পন্ন হয়। এই কাঁপুনির মাধ্যমে বিশ্রামরত একজন মানুষের দেহে আগের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি তাপ উত্পন্ন হতে পারে। বলে রাখি, এই কাজটার জন্য আমরা দেহে সঞ্চিত খাদ্য গ্লাইকোজেন ব্যবহার করি। তাই যার শরীরে গ্লুকোজের স্টোর বা সঞ্চয় যত বেশি, সে তত ভালো অভিযোজিত হয়। একই সঙ্গে আমাদের আচরণে পরিবর্তন হয়। আমরা গুটিসুটি মেরে যাই, যাতে সারফেস এরিয়া কম উন্মুক্ত থাকে (এমনকি এটা শিশুরাও করতে পারে), আমরা দ্রুত গরম জামাকাপড়, কম্বল, কাঁথা খুঁজতে থাকি বা খোলা জায়গা ছেড়ে ঢাকা বা ঘেরা জায়গায় চলে আসি।

আরও পড়ুন

এখন দেখা যাক দীর্ঘ সময় ধরে এক্সট্রিম টেম্পারেচারে যথেষ্ট গরম জামা কাপড় ছাড়া থাকলে কী হতে পারে। প্রথমেই হবে ফ্রস্ট নিপ। মানে দেহের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রক্ত চলাচল অব্যাহত রাখার জন্য বাইরে নাকের ডগা, গাল, হাত পায়ের আঙুলে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে এই জায়গাগুলো সাদা বা ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। একসময় অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যায়। স্নায়ু হয়ে যায় অসাড়। ফ্রস্ট নিপ একটি সতর্কসংকেত। এরপরই দেখা দেবে ফ্রস্ট বাইট। এ সময় ত্বকের তাপমাত্রা ফ্রিজিং পয়েন্টের নিচে চলে যাওয়ার কারণে ত্বকের নিচের কোষগুলোর মৃত্যু বা ধ্বংস শুরু হয়। আরও গভীর স্তরে চলে গেলে (যেমন পেশি, হাড়) স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফ্রস্ট বাইটের পর ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গটা কেটে ফেলে না দিলে আর মানুষটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। এ জন্য প্রায়ই পর্বতারোহী বা অভিযাত্রীদের হাত–পায়ের আঙুল কাটা পড়তে শোনা যায়। পুরো শরীরের তাপমাত্রা বা কোর টেম্পারেচার একটু বেশি সময় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়সের নিচে থাকলে ধীরে ধীরে হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস, রক্তনালির কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যাবে। আর মানুষটির করুণ মৃত্যু ঘটবে।

গবেষণা বলছে, গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে দুনিয়াজুড়ে মানুষের মৃত্যুহার প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এর বেশির ভাগের কারণ ফ্লু, নিউমোনিয়া, হাইপোথারমিয়া, ফায়ার ইনজুরি ইত্যাদি। বয়স্করাই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকেন। কারণ, তাঁদের শিভারিং টেকনিক অত দ্রুত শুরু হতে পারে না। রক্তনালি ও স্নায়ু তাঁদের আগে থেকেই অকেজো আর ত্বকের নিচের চর্বির স্তর (যা ইনসুলেটর হিসেবে কাজ করে) প্রায় নেই বললেই চলে। শীতের দেশের মানুষেরা যত ভালো অভিযোজিত হতে পারে, গরম দেশের মানুষ ততটা পারে না। তাই আমাদের মতো গরম দেশের কারও পক্ষে অ্যান্টার্কটিকা বা বরফের দেশে গিয়ে দ্রুত খাপ খাওয়াতে সমস্যা হয়। আরেকটি কথা, ঠান্ডা আবহাওয়ার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হলো শৈত্যপ্রবাহ বা উইন্ড চিল। সে কারণে নিউইয়র্ক শহরে এই জানুয়ারিতে মাইনাস ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যথেষ্ট গরম জামাকাপড় পরে আপনি দিব্যি বাজারসদাই করে বেড়াতে পারবেন। কিন্তু এ সময় যদি ঘণ্টায় ১০ মাইল বেগে শীতল ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে, তবে আপনার এই একই তাপমাত্রায় মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান তাপমাত্রা অনুভূত হবে। আর এতে আপনার দেহের কোষগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যে ফ্রিজিং বা জমে যেতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ