পাখির ডিমের রঙে এত বৈচিত্র্য কেন
‘চড়ুই পাখি বারোটা,/ ডিম পেড়েছে তেরোটা,/ একটা ডিম নষ্ট,/ চড়ুই পাখির কষ্ট।’ এমন ছড়া আমরা অনেকেই পড়েছি। প্রকৃতিতে একেক পাখি একেক সংখ্যায় ডিম পাড়ে। কোনো পাখি দুটি, কোনো পাখি চারটি। একেক পাখির ডিমের রং একেক রকম। কোনো পাখির ডিম সাদা, কোনোটা আবার নীল, কোনোটা লালচে বা ছাই রঙের। এর কারণ কী? বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এ বিষয়ে কী বলছেন, তা জানার আগে কোন পাখি কী রঙের ডিম পাড়ে, একটু জেনে নিই।
সাধারণত যেসব পাখি গর্তে, সুড়ঙ্গে, গাছের খোঁড়লে বা ঝোলানো বাসায় ডিম পাড়ে, সেসব পাখির ডিম সাদা হয়। যেমন বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, মুনিয়া, ধনেশ, নীলকণ্ঠ, ঘুঘু, পায়রা বা হরিয়াল। অপর দিকে পানকৌড়ি, পেলিক্যান ও ফ্লেমিঙ্গো পাখির ডিমের রং নীলচে সাদা। ফটিকজল, বুলবুলি, ডাহুক, সারস ও কিছু প্রজাতির চিলের ডিম হয় লালচে সাদা। কাস্তেচরা ও রাজহাঁস যে রঙের ডিম পাড়ে, তাকে আমরা বলতে পারি সবুজে সাদা। আর ডুবুরি পাখির ডিমের রং ছাই বা ধূসর সাদা।
কিশোর বয়সে যখন বাগেরহাটের ফকিরহাটে নিজ বাড়িতে থাকতাম, তখন বিভিন্ন পাখির নানা রকমের বাসা আর হরেক রঙের ডিম দেখে অভিভূত হয়েছি।
এবার আসা যাক নীল রঙের ডিমের কথায়। শালিক, গোশালিক, গাঙশালিক, ছাতারে, চোখ গেল, বউ কথা কও, চাতক—এসব পাখির ডিম নীল রঙের হয়। অবশ্য চোখ গেল, বউ কথা কও, চাতক ও অন্যান্য কোকিল প্রজাতির পাখি, যেগুলো অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, সেসব পাখির ডিমের সঙ্গে মিল রেখে সেই রঙের ডিম পাড়ে।
বিভিন্ন প্রজাতির বক, যেমন কোচবক, কানিবক, খয়রাকানার ডিম সবুজে নীল রঙের হয়। অপর দিকে শ্যামা পাখির ডিম নীলচে সবুজ রঙের হয়।
পাতিকাক, দাঁড়কাক, টুনটুনি, শিকরা বা তুর্কিবাজ, নীল টুনির ডিমের রং সবুজে নীল। এই ডিমে ছিট দেখা যায়। এক প্রজাতির বক আছে, যেগুলোর ডিম সবুজ রঙের।
দিনকানা বা রাতচরা পাখির ডিমকে আমরা বলতে পারি ফিকে লাল। একপ্রকার বাজপাখি আছে, যেগুলো ডিম কমলা বাদামি রঙের। তিতির ও জলমুরগি পাটকিলে, বাদামি, হালকা বাদামি রঙের ডিম পাড়ে। জলপিপি ও জলময়ূরের ডিম ব্রোঞ্জ রঙের হয় এবং এর ওপর ছোপ ছোপ দাগ থাকে।
কুট, কাদাখোঁচা পাখির ডিমের রং হলদেটে পাথুরে রঙের। ধূসর তিতির, নাকতা হাঁস ফিকে ঘিয়ে রঙের ডিম পাড়ে।
বিভিন্ন প্রজাতির বটেরা বা কোয়েল, হট্টিটি, খড়মা, বিলচোরা ও অন্য মাঠের পাখি, যেগুলো খোলা মাঠে ডিম পাড়ে, এদের ডিমের রং হয় বাদামি বা মেটে; যার ওপর থাকে খয়েরি, নীল বা গাঢ় রঙের দাগছোপ। তা ছাড়া বাবুবাটান ও ছোট পানচিলও এ রকম ডিম পাড়ে।
ডিমের রঙে কেন এত বৈচিত্র্য
এলাকাভেদে ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ডিমের রং বদলে যেতে পারে। নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভল্যুশন জার্নালে ডিমের রঙের বৈচিত্র্য নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের গবেষক টিম বার্কহেড মনে করেন, ডিমের রং কী হবে, সেটা স্থির হয়ে যায় জরায়ুতেই। যে স্থানে পাখি ডিম পাড়ছে, সেখানকার আবহাওয়া, আশপাশের পরিবেশ, বাসার গঠন, শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা—সবকিছু বিচার করে সংকেত পাঠায় পাখির মস্তিষ্ক। সেই সংকেতের ভিত্তিতে জরায়ুতে ডিমের গঠন সম্পূর্ণ হয়। কখনো তার প্রোটিনবেষ্টনী মজবুত ও পিচ্ছিল হয়, কখনো ডিমের খোলসে রুক্ষভাব আসে, আবার কখনো রঙে বৈচিত্র্য আসে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিমের খোসা বা বাইরের আবরণে রঙের কারণ নানা রকম রঞ্জক। দুটি রঞ্জকের মধ্যে বেশি সক্রিয় প্রোটোপরফিরিন, যা ডিমে লালচে খয়েরি আভা আনে এবং বিলিভারডিন, যার কারণে ডিম ঘন নীল বা সবুজ রঙের হয়। এ দুই রঞ্জকের কমবেশিতে রঙেও বৈচিত্র্য আসে। যেমন মধ্য ইউরোপ ও উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার পাখি কেট্টিস ওয়ার্বলারের ডিমে প্রোটোপরফিরিন বেশি থাকে, তাই ডিমের রং ঘন লাল বা লালচে খয়েরি হয়। আবার দুই রঞ্জকের কমবেশিতে নানা রঙের মিশ্রণ দেখা যায় ডিমের খোসায়।
গবেষক মার্ক ই হবার তাঁর দ্য বুক অব এগস বইয়ে লিখেছেন, বিশ্বের নানা দেশের কিছু ফ্লাইক্যাচার বা চটক পাখি নানা রঙের ডিম পাড়ে। এদের ডিমের রং বদল হতে থাকে। জাপানি কোয়েল কখনো খয়েরি রঙের ডিম পাড়ে, আবার কখনো নীল রঙের। এটা অবশ্য তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভোলার চরফ্যাশনে পাতিহাঁসের নীলচে ছোপযুক্ত কালো রঙের ডিম পাড়া নিয়ে সারা দেশে সাধারণ মানুষ তো বটেই, প্রাণিবিজ্ঞানীদের মধ্যেও ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছিল। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, সেটা ছিল বাংলাদেশে কোনো হাঁসের কালো রঙের খোলসযুক্ত ডিম পাড়ার প্রথম ঘটনা।
এ সম্পর্কে কথা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পাখিগবেষক আ ন ম আমিনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বিজ্ঞানচিন্তাকে বললেন, প্রাণিদেহের রক্তকণিকা ভেঙে বিলিভারডিন নামে যে উপাদান বের হয়, এটা কমবেশি হওয়ার কারণে ডিমের খোলসের রং নীলচে বা সবুজাভ হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে জরায়ুতে ডিমের খোলসটি পরিণত হওয়ার সময়ে তাতে গাঢ় সবুজ রঙের পিত্তরস বেশি থাকতে পারে। ওই দুটি উপাদান জরায়ুতে বেশি থাকলে তা থেকে ডিমের রং কালো হতে পারে।
পাখির ডিমের রঙের বৈচিত্র্যের সম্ভাব্য কারণের মধ্যে জলবায়ুর বৈচিত্র্য একটি। তাই তো শীতপ্রধান দেশের পাখিদের ডিমের রং যা হবে, গ্রীষ্মপ্রধান বা নাতিশীতোষ্ণ এলাকার পাখির ডিমের রং তার চেয়ে বেশ আলাদা হবে। এর কারণ, ডিমের ভেতরে তাপমাত্রার ভারসাম্য ধরে রাখা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাঢ় রং সূর্যরশ্মি শোষণ করে বেশি, ফলে শীতপ্রধান এলাকায় ডিমের ভেতরে উষ্ণ ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি বা আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে ভ্রূণকে বাঁচায় এই গাঢ় রঙের খোলস।
সাধারণত দেখা যায়, যেসব পাখি মজবুত বাসা তৈরি করতে পারে না বা খোলা জায়গায় ডিম পাড়ে, সেসব পাখির ডিমের রং সব সময়ই গাঢ় রঙের হয়।
ডিমের গাঢ় রং পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকে, নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে। ফলে সহজে ডিম চিনে উঠতে পারেন না শিকারিরা। হালকা রঙের প্রতি শিকারিরা আকৃষ্ট হন বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ওয়াইল্ডটিমের প্রধান নির্বাহী ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ডিমের রঙে ভিন্নতা এনে প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে উদ্ভব হওয়া পাখিরা নানা অভিযোজনের ভেতর দিয়ে আজও টিকে আছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে সারা পৃথিবীতে যে পরিবর্তনের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার সঙ্গে দ্রুত অভিযোজিত হতে না পারলে কী হবে, তা এখনই ভাবা যাচ্ছে না।