জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার নতুন সমাধান দিলেন বিজ্ঞানীরা
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো ভবিষ্যতের গল্প নয়, এটা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। পৃথিবী গরম হচ্ছে, গলছে বরফ। বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে খুঁজছেন বাঁচার উপায়। কেউ বানাচ্ছেন বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেওয়ার বিশাল সব মেশিন, কেউবা কলকারখানার ধোঁয়ায় ফিল্টার বসাচ্ছেন।
এসব উচ্চপ্রযুক্তির সমাধান শুনতে দারুণ লাগে, বিনিয়োগও আসছে প্রচুর। কিন্তু কাজের কাজ কি হচ্ছে? এখন পর্যন্ত খুব একটা নয়।
ঠিক এই হতাশার সময়ে একদল বিজ্ঞানী এবং উদ্যোক্তা হাজির হয়েছেন এক অদ্ভুত, অথচ সহজ সমাধান নিয়ে। তাঁরা বলছেন, দামি মেশিনের পরিবর্তে ট্রাক ভরে কাঠের গুঁড়ো, মরা গাছের ডালপালা আর আবর্জনা এনে মাটির নিচে পুঁতে ফেলুন! এতেই নাকি জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধান হবে। বেঁচে যাবে পৃথিবী!
বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম উড ভল্টিং বা বায়োমাস ব্যুরিয়াল। চলুন, এই জাদুকরি বিজ্ঞানের বিস্তারিত গল্পটা শোনা যাক।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আমরা যদি প্রতিবছর আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া কাঠ বা গাছের অংশ মাটির নিচে বিশেষ কায়দায় পুঁতে ফেলি, তবে বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখা সম্ভব। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব হবে। শুনতে সংখ্যাটা ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া ঠেকাতে বা কোরাল রিফ বাঁচাতে এই সামান্য তাপমাত্রাই বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
গাছ যখন মরে যায় বা পাতা ঝরে পড়ে, তখন সেগুলো মাটিতে পচে যায়। পচনের ফলে সেই জমানো কার্বন আবার গ্যাস হয়ে বাতাসে ফিরে আসে। অর্থাৎ লাভ বিশেষ হয় না।
গবেষণার প্রধান লেখক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাস্তুবিদ ইকি লু বলেন, ‘বাতাস থেকে কার্বন কমাতে হলে আমাদের জমি, সাগর বা মাটির নিচে নতুন কোনো ভল্ট বানাতে হবে।’
কিন্তু তা মাটির নিচে কেন? আমরা জানি, গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির জলবায়ুবিজ্ঞানী নিং জেং বলেন, ‘ফসিল ফুয়েল পুড়িয়ে আমরা যে কার্বন ছাড়ি, তার চেয়ে ছয় গুণ বেশি কার্বন গাছপালা প্রতিবছর শুষে নেয়।’ নিং জেং গত দুই দশক ধরে বায়োমাস ব্যুরিয়াল নিয়ে কাজ করছেন।
কিন্তু সমস্যা হলো, গাছ যখন মরে যায় বা পাতা ঝরে পড়ে, তখন সেগুলো মাটিতে পচে যায়। পচনের ফলে সেই জমানো কার্বন আবার গ্যাস হয়ে বাতাসে ফিরে আসে। অর্থাৎ লাভ বিশেষ হয় না।
সাধারণত গাছ পচে গেলে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। মিথেন কার্বনের চেয়েও প্রায় ২৮ গুণ বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস। তাই প্রাকৃতিকভাবে গাছ পচতে দেওয়াটাও পরিবেশের জন্য সব সময় ভালো নয়।
কিন্তু উড ভল্টিংয়ের বুদ্ধিটা হলো, কাঠ বা গাছকে পচতে দেওয়া যাবে না। মাটির কয়েক ফুট নিচে, বিশেষ করে কাদামাটির নিচে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। আর অক্সিজেন না থাকলে ব্যাকটেরিয়া কাঠ পচাতে পারে না। ফলে কার্বনটা কাঠের ভেতরেই আটকা পড়ে থাকে, বাতাসে মেশে না।
আমরা যদি প্রাকৃতিকভাবে পচে যাওয়া কাঠের সামান্য একটি অংশও এভাবে মাটির নিচে সংরক্ষণ করতে পারি, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে ১ হাজার কোটি টন কার্বন সরানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সহজ হবে।
এই কাঠগুলোকে যদি পুড়িয়ে ফেলা বা পচতে দেওয়ার বদলে মাটির নিচে ভল্ট করা যায়, তবে ২১০০ সালের মধ্যে প্রায় ৭৭০ বিলিয়ন টন কার্বন বাতাস থেকে সরানো সম্ভব হবে।
কিন্তু এত কাঠ আসবে কোথা থেকে? এতে বন উজাড় হবে না তো? গবেষকেরা বলছেন, এর জন্য জ্যান্ত বন কাটার দরকার নেই। লু এবং তাঁর দলের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে গাছ কাটার পর যে বিপুল পরিমাণ কাঠ আবর্জনা হিসেবে পড়ে থাকে, সেটাই যথেষ্ট। পরিসংখ্যান বলছে গাছ প্রতিবছর প্রায় ১৭০ বিলিয়ন টন কার্বন শুষে নেয়। এর মধ্যে ১৪ বিলিয়ন টন কার্বন কাঠের মধ্যে জমা হয়। এই ১৪ বিলিয়ন টনের পুরোটাই কোনো না কোনোভাবে নষ্ট হয়। যেমন, মরা ডালপালা, ‘স’ মিলের আবর্জনা, পুরোনো ফার্নিচার বা ঘরবাড়ি ভাঙার পর পাওয়া কাঠ হিসেবে।
এই কাঠগুলোকে যদি পুড়িয়ে ফেলা বা পচতে দেওয়ার বদলে মাটির নিচে ভল্ট করা যায়, তবে ২১০০ সালের মধ্যে প্রায় ৭৭০ বিলিয়ন টন কার্বন বাতাস থেকে সরানো সম্ভব হবে।
ভাবতে পারেন, বাস্তবে কি এটা সম্ভব? নাকি শুধুই খাতা-কলমের গল্প? যুক্তরাষ্ট্রের হামবোল্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক কেভিন ফিঙ্গারম্যানের মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণার অঙ্ক ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবে এটা করা কঠিন। কারণ, মাটির নিচে পুঁতে রাখা কাঠগুলো আসলেই পচছে কি না বা সেখান থেকে কতটা কার্বন আটকা পড়ল, তার নিখুঁত হিসাব রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তিনি বলেন, ‘মাটির নিচে একটা কাঠের স্তূপের কী পরিণতি হচ্ছে, তা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।’
তবে এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বেশ কিছু স্টার্টআপ কোম্পানি মাঠে নেমেছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে আছে উডক্যাচ কোম্পানি। এই কোম্পানিটি দাবানলের ঝুঁকি কমাতে জঙ্গল থেকে মরা ডালপালা ও আবর্জনা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলছে। তাদের দাবি, তাদের প্রথম প্রজেক্টেই ১ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মেশা থেকে আটকানো সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানায় আছে মাস্ট রিফরেস্টেশন কোম্পানি। দাবানলে পুড়ে যাওয়া গাছ সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলছে তারা। আগে এই গাছগুলো এমনিতেই পুড়িয়ে ফেলা হতো। ফলে তা থেকে আরও বেশি কার্বন ছড়াত। তারা কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আবার বনায়ন করছে। প্রথম ধাপে তারা ৫ হাজার টন কার্বন সরিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে ৩০ হাজার টন সরানোর পরিকল্পনা করছেন।
বিজ্ঞানী নিং জেংয়ের নিজের কোম্পানি কার্বন লকডাউন। তারা মাটির নিচে বিশেষ ভল্ট তৈরি করে কাঠ পুঁতছেন। নিং জেংয়ের গবেষণা বলছে, কাদামাটির নিচে কাঠ হাজার বছর ভালো থাকে। ২০১৩ সালে তাঁর দল মাটির নিচ থেকে ৩ হাজার ৭৭৫ বছরের পুরোনো একটি রেড সিডার গাছের গুঁড়ি উদ্ধার করেছিলেন। সেটি মাটির নিচে অক্সিজেনের অভাবে প্রায় অবিকৃত ছিল!
কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। যেমন, কাঠ পুঁতে ফেলার পর সেখান থেকে মিথেন গ্যাস লিক হচ্ছে কি না, তা সব সময় মনিটর করতে হবে।
কানাডায় বিজ্ঞানীরা মাটির নিচে চাপা পড়া এমন কিছু গাছের সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলো প্রায় ৫০ হাজার বছর আগের, অথচ এখনো পচেনি! এর মানে হলো, ঠিকঠাক পুঁতে রাখতে পারলে কাঠ হাজার হাজার বছর কার্বন ধরে রাখতে পারে।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। যেমন, কাঠ পুঁতে ফেলার পর সেখান থেকে মিথেন গ্যাস লিক হচ্ছে কি না, তা সব সময় মনিটর করতে হবে। মাস্ট এবং কার্বন লকডাউন কোম্পানিগুলো মাটির ওপরে সেন্সর বসিয়ে রেখেছে, যাতে মিথেন লিক হলে ধরা পড়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞানী হলি জিন বাক বিষয়টাকে খুব ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘বড় বড় মেশিন বসিয়ে বা পাইপলাইন টেনে কার্বন সরানোর চেয়ে মাটির নিচে কাঠ পুঁতে ফেলাটা মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। মানুষ এটাকে প্রাকৃতিক মনে করে।’
উচ্চ প্রযুক্তির ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার মেশিন দিয়ে ১ টন কার্বন সরাতে খরচ হয় প্রায় ৬০০ থেকে ১০০০ ডলার। সেখানে উড ভল্টিং বা কাঠ পুঁতে ফেলার পদ্ধতিতে ১ টন কার্বন সরাতে খরচ হতে পারে আনুমানিক ১০ থেকে ৫০ ডলার।
মোদ্দাকথা হলো, প্রযুক্তি আমাদের অনেক দূর নিয়ে গেছে, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু প্রকৃতির সমস্যা সমাধানের জন্য মাঝে মাঝে প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে হয়। মাটির নিচে কাঠ পুঁতে ফেলার এই সহজ বুদ্ধিটি যদি সত্যিই কাজ করে, তবে হয়তো কোনো বিশাল মেশিনের পরিবর্তে আমাদের পায়ের নিচের মাটিই হয়ে উঠবে পৃথিবীকে বাঁচানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার!