কোষ কীভাবে বোঝে তাকে কী কাজ করতে হবে
৩০ ট্রিলিয়ন কোষের বিশাল এক সমাজ আমাদের শরীর। কিন্তু একটা কোষ কীভাবে বোঝে তাকে মস্তিষ্কের অংশ হতে হবে নাকি পায়ের হাড়? এর পেছনে কাজ করে কোন রাসায়নিক? জীববিজ্ঞানের সঙ্গে গণিতবিদ অ্যালান টুরিংয়ের কী সম্পর্ক?
আমাদের সমাজে একজন ডাক্তার হার্ট সার্জারি করেন, একজন প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনিয়ার ব্রিজ বানান। আবার কৃষক ফলান ফসল। সমাজটা সুন্দরভাবে চলছে, কারণ প্রত্যেকে তার নিজের কাজটা জানে। এখন যদি একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়কে দিয়ে হার্ট সার্জারি করানো হয়, তবে কী হুলুস্থূল কাণ্ডটাই না ঘটবে!
আমাদের শরীরটাও কিন্তু ঠিক এমন একটা বিশাল সমাজ বা সভ্যতা। আমরা সবাই জীবন শুরু করি মাত্র গুটিকয়েক কোষ দিয়ে। এরপর আমরা বড় হই, আর সেই কোষগুলো ভাগ হয়ে হয়ে প্রায় ৩০ লাখ কোটি কোষে পরিণত হয়!
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই ৩০ লাখ কোটি কোষের মধ্যে কেউ হয়ে যায় নিউরন বা মস্তিষ্কের কোষ, কেউ হয় লিভারের কোষ, আবার কেউ হাড় বা চামড়ার কোষ। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, একটা কোষ কীভাবে জানে যে তাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে এবং কী কাজ করতে হবে? তার কাছে কি কোনো ম্যাপ বা জিপিএস থাকে? চলুন, জীববিজ্ঞানের এই জাদুকরী রহস্য উন্মোচন করা যাক।
এই রহস্যের মূলে আছে বিশেষ কিছু রাসায়নিক অণু। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন মরফোজেন। সহজ করে বললে, মরফোজেন হলো একধরনের সংকেত। এরা কোষের চারপাশে একটা ঘনত্বের তারতম্য তৈরি করে। ব্যাপারটা অনেকটা পারফিউমের মতো। ঘরের এক কোণায় যদি একটি পারফিউমের বোতল খোলা হয়, তবে বোতলের কাছে গন্ধ খুব কড়া থাকবে। আর দূরে গেলে গন্ধ হবে হালকা। কোষের ডিএনএ এমনভাবে প্রোগ্রাম করা থাকে যে সে তার চারপাশের এই মরফোজেনের ঘনত্ব মাপতে পারে।
কোষটি যখন দেখে মরফোজেনের ঘনত্ব খুব বেশি, তখন সে বুঝে নেয় আমাকে মস্তিষ্কের কোষ হতে হবে। আবার ঘনত্ব কম হলে সে ভাবে আমাকে পায়ের হাড় হতে হবে। বিষয়টা সহজে বোঝানোর জন্য এভাবে অতি সহজভাবে উদাহরণ দিলাম। বাস্তবে কাজটা এত সহজভাবে হয় না।
মায়ের পেটে যখন ভ্রূণ বড় হতে থাকে, তখন প্রথমেই ঠিক করতে হয় কোনটা মাথা আর কোনটা নিচের অংশ। এই গুরুদায়িত্ব পালন করে রেটিনয়িক অ্যাসিড নামে একটি মরফোজেন।
এখানে জানিয়ে রাখি, মরফোজেন শব্দটি ১৯৫২ সালে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ অ্যালান টুরিং। তিনি শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনকই ছিলেন না, জীববিজ্ঞানেও তাঁর অবদান ছিল। টুরিং ধারণা করেছিলেন, চিতাবাঘের গায়ের ছোপ বা জেব্রার ডোরাকাটা দাগগুলো আসলে এই মরফোজেনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলেই তৈরি হয়। তাঁর এই থিওরি প্রমাণ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬০ বছর!
যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি। মায়ের পেটে যখন ভ্রূণ বড় হতে থাকে, তখন প্রথমেই ঠিক করতে হয় কোনটা মাথা আর কোনটা নিচের অংশ। এই গুরুদায়িত্ব পালন করে রেটিনয়িক অ্যাসিড নামে একটি মরফোজেন।
এটি ভ্রূণের এক প্রান্তে বেশি থাকে এবং অন্য প্রান্তে কম। এই সংকেত পেয়ে কোষগুলো তাদের অবস্থান বুঝে নেয় এবং সেই অনুযায়ী হক্স জিন সক্রিয় করে। এই জিনগুলোই কোষকে হুকুম দেয়, তুমি মাথা বানাও, আর তুমি মেরুদণ্ড বানাও।
রেটিনয়িক অ্যাসিড কিন্তু পরে তার কাজ বদলে ফেলে। শরীর গঠন হয়ে গেলে এটি আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং শুক্রাণু তৈরিতে সাহায্য করে। জীববিজ্ঞানে কোনো কিছুই ফেলনা নয়!
শরীর যখন বুঝতে পারে তার মাথা আর পায়ের অবস্থান, তখন অন্য মরফোজেনরা মাঠে নামে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রোটিনটির নাম হলো সনিক হেজহগ। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! ভিডিও গেমের সেই নীল রঙের সনিকের নামেই এর নামকরণ। এই প্রোটিনটি আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং হাত-পা গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে। এটি ঠিক করে দেয় আপনার হাতের কড়ে আঙুল কোনটা হবে আর বুড়ো আঙুল কোনটা।
আমাদের শরীর আসলে এক বিশাল ও জটিল অর্কেস্ট্রা। এখানে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ প্রতি মুহূর্তে রাসায়নিক সংকেত আদান-প্রদান করছে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে এবং নিজের অবস্থান নিশ্চিত করছে।
বিজ্ঞানীরা যখন ফ্রুট ফ্লাই বা ফলের মাছি নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখন দেখেছিলেন এই জিনের অভাবে মাছিগুলোর গায়ে স্পাইক তৈরি হচ্ছে। দেখতে অনেকটা হেজহগের মতো লাগছিল বলেই এমন অদ্ভুত নাম! এ ছাড়া আরও আছে বোন মরফোজেনিক প্রোটিন। এই প্রোটিন হাড় এবং তরুণাস্থি তৈরির নির্দেশ দেয়।
তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু খুব জটিল। কোষকে সব সময় সঠিক ঘনত্ব মাপতে হয়। আর্থার ল্যান্ডার নামের একজন বিজ্ঞানী বলছেন, এই মাপজোক নিখুঁত রাখতে কোষেরা মাঝেমধ্যে নিজেরাই মরফোজেন ধ্বংস করে ফেলে, যাতে নতুন করে সিগন্যাল পাওয়া যায়। এটা অনেকটা ডাবল চেক করার মতো।
কিন্তু মাঝে মাঝে এই সিস্টেমেও ভুল হয়। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। ভুল সিগন্যাল পেয়ে কোনো কোষ যদি ভুল জায়গায় ভুল অঙ্গ তৈরি করা শুরু করে, তখন তৈরি হয় টেরাটোমা। এটি একধরনের টিউমার, যার ভেতরে মাঝে মাঝে দাঁত, চুল, এমনকি ছোটখাটো মস্তিষ্কের টিস্যুও পাওয়া যায়! এটি হলো শরীরের সেই আনাড়ি মিস্ত্রি, যে ভুল জায়গায় দেয়াল তুলে ফেলেছে। টেরাটোমা শব্দটিও এসেছে গ্রিক শব্দ টেরাস থেকে। এর অর্থ দানব।
আমাদের শরীর আসলে এক বিশাল ও জটিল অর্কেস্ট্রা। এখানে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ প্রতি মুহূর্তে রাসায়নিক সংকেত আদান-প্রদান করছে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে এবং নিজের অবস্থান নিশ্চিত করছে। এই নিখুঁত যোগাযোগের ফলেই আমরা সুস্থভাবে বেঁচে আছি, হাত-পা নাড়ছি এবং এই লেখাটি পড়ছি।
সামান্য একটা কোষের এই ঠিকানা চেনার ক্ষমতা যে কতটা বিস্ময়কর, তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়!